নতুন পোস্ট

6/recent/ticker-posts

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) এর জীবনী বাংলা

 


বায়েজীদ বোস্তামী (র) জীবন কাহিনী

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর অন্তঃস্বত্তা মাতা যখনই কোন সন্দেহজনক খাদ্য গ্রহণ করতেন, তখনই অনুভব করতেন, তাঁর পেটের সন্তানটি অনবরত কাঁপছে। যতক্ষণ ঐ খাবার পেটে থাকবে, ততক্ষণ ধরে এ কাঁপুনি চলবে। শেষ পর্যন্ত মুখে আঙুল পুরে বমি করে তাঁকে ঐ খাবার ফেলে দিতে হত। আর বাচ্চাটিও স্থির হয়ে যেত। মায়ের গর্ভে থেকেই ঐ শিশু বেলায়েত অর্জন করেন। আল্লাহর এ এক অমূল্য সম্পদ।

যথাসময়ে ঐ মহিমান্বিতা নারী এক মহাজ্যোতিময় শিশুর জননী হলেন। এ শিশুই হলেন সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তপন্থী হযরত বায়েজীদ বােস্তামী । (র)।

বােস্তাম শহরে হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর জন্ম। পিতা ছিলেন এক ধর্মনিষ্ঠা মুসলমান। কিনতু পিতামহ ছিলেন একজন মূর্তিপূজক। অতি অল্প বয়সেই বায়েজীদ বােস্তামী (র) পিতৃহীন হন। কিন্তু জননী ছিলেন এক আলােকময়ী নারী। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর মতো এক মহাতাপসকে গর্ভে ধারণ করার জন্য তাঁর মতাে এক জননীর প্রয়ােজন ছিল। পিতার অবর্তমানে তিনিই পুত্রকে আলাের পথে এগিয়ে দিলেন। তাঁকে ভর্তি করে দিলেন এক মাদ্রাসায়।

পাঠ করলেন তিনি। ঐ আয়াতে ছিল-আমার প্রতি ও তােমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। সূরা লুকমানের আয়াত সেটি। তিনি তাঁর শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরলেন। 

অসময়ে তাকে বাড়ি ফিরতে দেখে মা উৎকণ্ঠিত হলেন। কিন্তু বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, আমি পবিত্র কুরআনে আল্লাহর নির্দেশ পাঠ করলাম যে, আল্লাহ ও তােমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। কিন্তু মা গো, আমি তাে একসঙ্গে তা পারব না। তাই আমি আপনার কাছে ছুটে এসেছি। হয় আপনি আল্লাহর কাছ থেকে আমার দাবি ছাড়িয়ে নিন, না হয় আমার ব্যাপারে আপনার অধিকার আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিন। আমিও মনে-প্রাণে একজনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে আত্মনিয়ােগ করি।

পুত্রের কথায় জননীর হৃদয় আনন্দে উদ্বেলি হল। তিন পরম খুশিতে নিজের অধিকার ত্যাগ করে তাঁকে আল্লাহর হাতেই সােপর্দ করলেন।  জননীর এ আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। তাঁর এই ত্যাগের মহিমায় আল্লাহ তাঁর পুত্রকে উন্নত মর্যাদাদান করেন। আর পুত্র ও তাঁর মহীয়সী জননীর প্রতি ভক্তিনিষ্ঠার বিজয়-বৈজয়ন্তী উড়িয়ে দিয়েছেন।

তখন অনেক রাত। মা বললেন, বাবা বায়েজীদ, আমাকে এক গ্লাস পানি দাও তো। বড় পিপাসা পেয়েছে। মায়ের জন্য পানি আনতে গিয়ে বায়েজীদ বােস্তামী (র) দেখেন, বাড়িতে কোথাও এক ফোটা পানি নেই। তাহলে? ঐ রাতেই ছুটলেন নদী থেকে পানি আনতে। কিন্তু পানি এনে দেখেন, মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঘুম থেকে মাকে জাগানাে ঠিক হবে না। কিন্তু তারও ঘুমানাে চলবে না। 

যে কোন সময় তিনি পানি চাইতে পারেন। অতএব পানির পাত্র হাতে তিনি সারা রাত মায়ের শিয়রে দাঁড়িয়ে রইলেন। শীতের রাত। হিমেল বাতাসে আর কনকনে ঠাণ্ডায় এর হাত-পা অবশ হয়ে এল। ওদিকে দু'চোখ বেয়ে নামছে ঘুম। কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করে তিনি মায়ের ঘুম ভাঙার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলেন।

রাত শেষ হলাে। পূর্ব আকাশে ফুটে উঠল আলাের গােলাপ-লাল ফুল। মায়ের চোখ খুলে যেতেই তিনি তাঁর দণ্ডায়মান পুত্রকে দেখতে পেলেন। বিচলিত হয়ে বললেন, এ ঠাণ্ডায় সারা রাত ধরে তুমি অত কষ্ট করতে গেলে কেন বাবা! পানির গ্লাসটা শিয়রে রেখে দিলেই তাে পারতে। বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, মা গাে, আপনার পিপাসার কথা মনে রেখেই আমি আর ঘুমুতে পারিনি। দাঁড়িয়েই আছি সারা রাত। 

পুত্রগর্বে মায়ের বুক ভয়ে গেল। দু'চোখ বেয়ে নেমে এল আনন্দের আপ্লুত অশ্রুধারা। আল্লাহর দরবারে হাত উঠিয়ে তিনি মােনাজাত করলেন, প্রভু গাে, আমার ছেলেকে আপনি আপনার বৃদ্ধুদের নেতা বানিয়ে দিন। জননীর এ আকুল প্রার্থনা কি ব্যর্থ হয়? আরও একবার। মা বিছানায় শুয়ে পড়েছেন। ঘরের দরজা খােলা। হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। তিনি ছেলেকে একখানি পাল্লা বন্ধ করতে বলে ঘুমিয়ে পড়লেন।

কিন্তু দরজার কোন্ পাল্লা তিনি বন্ধ করবেন? মাকে আর জিজ্ঞেস করা যায় না। কেননা, তাতে তাঁর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে। আর তা হবে তাঁর পক্ষে ক্লেশকর। তিনি করলেন কী, এক খান খুলে দিয়ে ওখানা বন্ধ করেন। আরেকবার ওখানা খুলে দিয়ে এখানা বন্ধ রাখেন। আর এভাবে রাত ভাের হয়। দরজার পাল্লা নিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন সারা রাত। 

মায়ের যখন ঘুম ভাঙল, তখন ছেলেকে ঐ অবস্থায় দেখে বললেন, তুমি এরূপ করছ কেন বাবা?ছেলে সব কথা খুলে বললেন। ছেলের জন্য তার কষ্ট হল খুব। কিন্তু আনন্দও কম পেলেন না। এমন পুত্র রত্ন পেয়েছেন বলে তিনি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। আর পুত্রের মঙ্গল কামনা করে আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন।

বলাবাহুল্য, মহিমময় আল্লাহ সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থনা কবুল করেন। ধন্য জননী আর ধন্য পুত্র জননীর কাছে বিদায় নিয়ে তিনি সিরিয়া যাত্রা করেন। সেখানে পৌছে একটানা তিন বছর নির্জন অরণ্যে তিনি আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হন। শুধু তাই নয়, এ সময়ে তিনি অন্তত একশাে তেরাে জন সিদ্ধপুরুষের সঙ্গে দেখা করে তাদের প্রসন্ন দৃষ্টি ও আর্শীবাদ লাভ করেন। এদের অন্যতম ছিলেন হযরত জাফর সাদেক (র)।

একদিন হযরত জাফর সাদেক (র) তাঁকে তাক থেকে একখানি বই আনতে বলেন। কিন্তু বইখানি কোন তাকে রয়েছে তিনি জানতেন না। জিজ্ঞেস করলে হযরত জাফর সাদেক (র) বললেন, তুমি কতদিন ধরে এখানে আছে, অথচ কোন তাকে বই আছে, জানাে না?

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বলেন, আপনার সামেন মাথা উঁচু করে এদিকে-ওদিকে তাকাবার তাে আমার প্রয়ােজন ছিল না। কোন কিছু দেখার জন্য আমি এ দরবারে আসিনি। হযরত জাফের সাদেক (র) বুঝলেন, তাঁর এ শিষ্যের উপাসনা ও ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে। তিনি তাঁকে তাঁর শহরে ফিরে যেতে বললেন।

পীরের নির্দেশ তিনি ফিরে এলেন মায়ের কাছে, বােস্তাম শহরে। পুত্র বিরহে বিরহাতুরা জননী তখন আল্লাহর কাছে মােনাজাত করছিলেন, প্রভু গাে, আমার পুত্রের মঙ্গল করুন। আপনার ওলীগণ যেন তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন। তাদের দোয়া যেন ফলপ্রসূ হয়। তাঁকে ধর্মবলে বলীয়ান করুন। হে আল্লাহ! তাঁর পবিত্র ইচ্ছা পূর্ণ করুন।

মা তখন বৃদ্ধা। অতি দুর্বল। কণ্ঠস্বর অতি ক্ষীণ। কিন্তু বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে বায়েজীদ বােস্তামী (র) এ মায়ের মরমী প্রার্থনা শুনলেন। বুক ঠেলে কান্না এল তাঁর। তিনি এবার দরজায় করাঘাত করে ডেকে উঠলেন, মাগাে, আপনার অধম সন্তান আপনার কোলে ফিরে এসেছে।

মমতাময়ী মা দরজা খুলে দিয়ে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়লেন, বাছা আমার! এত দেরি করে এলে? কেঁদে কেঁদে আমি যে অন্ধ হয়ে গেছি। আমার পিঠ বেঁকে গেল। মা ও ছেলের এই আনন্দ-বিধুর মিলনে আকাশ ও পৃথিবী নড়ে উঠল।

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) মার্জিত রুচির শিষ্টাচারসম্পন্ন পুরুষ ছিলেন। তার বাড়ি থেকে সজিদের দূরত্ব ছিল চল্লিশ কদমের মতাে। কিন্তু নামাযের উদ্দেশে রওনা দিয়ে তিনি রাস্তায় কোনদিন থুথু নিক্ষেপ করেননি। এক সিদ্ধপুরুষকে তিনি কিবলার দিকে ফিরে গুখু ফেলতে দেখেন। তা দেখে তাঁর মন এত অপ্রসন্ন হয়ে ওঠে যে, তিনি তাকে দেখা করতে গিয়েও তার দরবার থেকে ফিরে আসেন।

কাবা শরীফ কোন সুলতান বাদশাহর দরবার নয়, আল্লাহর ঘর। অতএব সেখানে যথাসাধ্য দ্রুত যেতে হবে এমন কোন কথা নয়। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বলেন, বরং আল্লাহর পবিত্র ঘরের মর্যাদা ও সম্মানের প্রশ্ন সামনে রেখে সেখানে অন্যভাবে যাওয়া উচিত। তিনি তাই ধীরে সুস্থে, নফল নামায আদায় করতে করতে দীর্ঘ বারাে বছর ধরে পথ চলতে চলতে মকা-মােয়াজ্জমায় উপস্থিত হন। মক্কায় হজ্জ সম্পন্ন করে তিনি মদিনা গমন করেন। 

তিনি আলাদা করে মদিনার পাক রওজাভূমি জিয়ারত করার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন। কেননা, তার মনে হয় মক্কায় হজ্জের উদ্দেশে উপস্থিত হয়ে ঐ সঙ্গে রওজাভূমি জিয়ারত করা রওজার জন্য অমর্যাদাকর। সেখানে স্বভাবে গমন করতে হবে। যাই হােক, তার সহযাত্রী হওয়ার জন্য প্রচুর লােক প্রস্তুত হয়। তিনি কিন্তু এত ভিড় পছন্দ করলেন না। 

কিন্তু তাদের নিবৃত্ত করাও সম্ভব হলাে না। অগত্যা দলবল নিয়েই তাকে যেতে হলাে। অবশেষে একদিন ফজরের নামাজ আদায় করে তিনি সঙ্গীদের উদ্দেশে বললেন, আমি যে তােমাদের প্রভু। তােমরা আমার সামনে উপাসনা করছ না কেন? তার কথায় লােকজন অবাক। তারা ভাবল, নিশ্চয়ই তার মাথা খারাপ হয়েছে। তাই, নিজেরাই তাঁর কাছ থেকে কেটে পড়ল।

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) যে ঐ ধরনের আপত্তিকর মন্তব্য করেন, তা তার নিজের নয়। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানানাের ফলে ঐ কথা তার মুখ থেকে নিঃসৃত হয়।

আবার মদীনা থেকে তিনি যখন বােস্তামে ফিরছেন, তখনও ঐ একই অবস্থা। অজস্র লােক তাঁর প্রত্যুদগমনে ভিড় করে। আর তিনি অস্বস্তি বােধ করেন। হয়তাে তার মনে অহস্কার দেখা দিতে পারে। হয়তাে আল্লাহ থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন।

ভিড় বর্জন করার জন্য তিনি একই পন্থা অবলম্বন করলেন। তখন রমযান মাস। অথচ দিনের বেলায় রুটি কিনে সকলের সামনে খেতে শুরু করলেন। আর তা দেখে লােকের ধারণা হলাে, সত্যিই তার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। সুতরাং এক-দুই করে সবাই তাঁর কাছ থেকে সরে গেল। কেউ কেউ আবার সহানুভূতি প্রকাশ করে বিদায় নিল।

তার এ কাজটি আপাতদৃষ্টিতে শরীয়ত-বিরােধী মনে হলেও, অন্যদিক দিয়ে এর অনুমােদনও পাওয়া যায়। তিনি তখন মুসাফির। আর মুসাফিরের জন্য সফরকালে রমযান মাসে রােযা ভঙ্গ করার সুস্পষ্ট বিধান আছে।

একবার হজ্জ পালন করে তিনি তাঁরও সঙ্গীদের মালপত্র চাপিয়ে দিলেন উটের পিঠে। একজন কেউ বলল, উটের বােঝা ভারী হয়ে গেছে। আপনি কেবল আপনার মালপত্র রাখুন। বাকিগুলাে আমরা বয়ে নিয়ে যাব। বায়েজীদ বােস্তামী (র) তাকে বললেন, একটু ভালাে করে তাকিয়ে দেখ তাে। 

লােকটি অবাক হয়ে দেখে, সমস্ত মালপত্র উটের পিঠ থেকে অন্তত এক হাত শন্যে কুলছে। তখন বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, আমি যদি আমার অবস্থা তােমাদের কাছে গােপন রাখি, তাহলে তােমরা আমাকে দোষী সাব্যস্ত কর। আর যদি প্রকাশ করি, তবে তােমরা তা দেখতে পাও না। আমার সমস্যা বুঝছ তাে? আমি এখন কোন পথ ধরব বলতে পার?

সত্যিই হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর সাধনা বড় কঠিন। জটিল এবং দুর্বেদ্য। উপমা সহকারে তিনি তাঁর সাধনার ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেছেন। মানুষের নফস বা কু-প্রবৃত্তি যেন কয়লা সদৃশ। প্রথমত, তিনি কয়লাকে প্রভাবে অর্থাৎ তামসিকতায় ভুগছেন। তখন উপাসনার অগ্নিকুতে ফেলে দিয়ে কয়লা তিনি উত্তপ্ত করেন। আর তওবা ও অনুতাপের হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে তাকে আয়নার মতাে স্বচ্ছ করেন। এ নিয়ে পাঁচ বছর অতিবাহিত হয়। 

নানা ধরনের ইবাদত- উপাসনায় নিজেকে তিনি গড়ে তােলেন। পরে, পুরাে একটি বছর নিজের প্রতি সৃক্ষ্ দুষ্টি ফেলে তিনি দেখতে পান, অহঙ্কারের রশি তার কাঁধে। এ রশি ছিন্ন করার জন্য আরও পাঁচ বছর তিনি কঠোর সাধনায় রত হন। আর নব মুসলমান হয়ে যান। তখন মানবসমাজকে তাঁর মৃত বলে মনে হয়। আর তিনি তাদের ওপর জানাজা আদায় করে তাদের থেকে আলাদা হয়ে যান, যেমন জানাজা আদায়কারীরা মৃত ব্যক্তি থেকে আলাদা হয়ে যায়। তারপর তিনি আল্লাহর নৈকট্যলাভে সক্ষম হন। 

একবার দেখা যায়, মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) কান্নাকাটি করছেন। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি নিজেকে ঋতুমতী নারীর মতাে মনে করছি। ঋতু অবস্থায় তারা যেমন মসজিদে ঢুকতে সাহস করে না, তেমনি আমিও আমার অপবিত্রতার কারণে মসজিদে ঢুকতে ভয় পাচ্ছি। একবার এক হাবশীর কথায় তিনি হজ্জযাত্রা থেকে ফিরে আসেন। হাবশী বলেছিল, আপনি আল্লাহকে বােস্তানে ফেলে রেখে যাচ্ছেন কেন?

আরও একবার, হজ্জের পথে এক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞেস করে, আপনি কোথায় যাচ্ছেন তিনি তাঁর উদ্দেশের কথা জানান। তখন আবার প্রশ্ন, সঙ্গে টাকাকড়ি কিছু আছে কি? তিনি বলেন, আছে। দুশাে দীনার। লােকটি বলল, আমি গরিব মানুষ। সংসার চালাতে পারি না। আপনি দয়া করে টাকাগুলাে আমাকে দিয়ে দিন। আর আমাকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে দেশে ফিরে যান। আপনার হজ্জ আদায় হবে। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) তাই করলেন। টাকাকড়ি যা ছিল, সব নিয়ে ফিরে এলেন বােস্তামী । 

এক রাতে দেখা গেল, তিনি মসজিদের ছাদের ওপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। আর এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেন সারা রাত। তিনি যখন প্রস্রাব করলেন, তখন দেখা গেল প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। এর কারণ কী? তিনি বলেন, আমি যথাযথভাবে আল্লাহর উপাসনা করতে পারিনি। আর ছেলেবেলায় একটি পাপকাজ করেছিলাম। তাই আমি এত ভীতিগ্রস্ত যে আমার হৎপিগুটি বিগলিত হয়ে রক্তে পরিণত হয়েছে। আর তাই বেরিয়ে আসছে প্রস্রাবের সঙ্গে।

হযরত ঈসা বােস্তামী (র) তার ধ্যান সম্বন্ধে বলেন, দু জানুর মধ্যে মাথা রেখে চোখের দৃষ্টি অবনত করে তিনি ধ্যানে বসতেন। অনেকক্ষণ পর যখন মাথা তুলতেন, তখন তাঁর মুখ থেকে শুধু আহ ধ্বনি উচ্চারিত হতাে।

একবার ধ্যাররত অবস্থায় তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে আমার পবিত্রতা আমারই শ্রেষ্ঠতম গৌরব। ধ্যান ভাঙলে তাকে তা বলা হলাে। তিনি চমকে উঠলেন। সর্বনাশ! তিনি তাঁর শিষ্যদের বললেন, আবার যদি তার মুখ থেকে এ ধরনের কথা বের হয়, তাহলে তারা যেন তাঁকে টুকরাে টুকরাে করে কেটে ফেলে। এতটুকু সমীহ করবে না। আল্লাহর কী ইচ্ছা। আবারও তিনি ধ্যানরত অবস্থায় ঐ একই কথা উচ্চারণ করলেন। 

তার নির্দেশমতাে শিষ্যরা যখন তাকে হত্যা করতে উদ্যত হলাে, তখন দেখা গেল সমস্ত ঘর জুড়ে বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর বিশাল আকৃতি। আর সেই বিরাট বিস্তৃত মূর্তির সঙ্গে ছােট ছােট আরও অসংখ্য বায়েজীদ বােস্তামী (র) মূর্তি। শিষ্যগণ ঐ মূর্তির ওপরেই ছুরিকাঘাত করতে শুরু করল। কিন্তু তার কিছুই ক্ষতি হলাে না। 

তিনি সম্পূর্ণ অক্ষত রইলেন আরও কিছুক্ষণ পর, একটু একটু করে ক্রমশ তিনি স্বাভাবিক অবয়বে ফিরে এলেন। তাকে সমস্ত ঘটনা জানানাে হলাে। তিনি স্বাভাবিক অবয়বে ফিরে এলেন। তাকে সমস্ত ঘটনা জানানাে হলাে। তিনি বললেন, এর মধ্যে আমার কোন হাত নেই। যা কিছু ঘটেছে, সবই  ঘটেছে আল্লাহর ইচ্ছায়। 

একদিন তার হাতে ছিল এক পাকা আপেল। তিনি আপেলটির দিকে তাকিয়ে বললেন, এটা লতীফ। লতীফ আল্লাহর একটি নাম-যার অর্থ পবিত্র ও সূক্ষ্মদর্শী। সাথে সাথে দৈববাণী শােনা গেল: আমার নামকে তুমি আপেলের মধ্যে প্রয়ােগ করলে? তােমার কি এতটুকু লজ্জা নেই? আর এ অপরাধের জন্য, তার মন থেকে আল্লাহর নাম ভুলিয়ে দেয়া হলাে। চল্লিশ দিন ধরে তার এ শাস্তি বহাল রইল। এরপর অনুতপ্ত হয়ে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন, জীবনে আর কোনদিন বােস্তামের কোন ফল স্পর্শ করবেন না।

একবার তাকে মনে হলাে, একালের তিনিই শ্রেষ্ঠ ওলী। অবশ্য, সে সঙ্গে তাঁর এও মনে হয় যে, এ তার অহমিকা। যা হােক, প্রচুর অস্বস্তি নিয়ে তিনি খােরাসানের পথে রওনা হলেন। তারপর এক জায়গায় পৌছে তিনি আল্লাহর দরবারে আরজ করলেন, যতক্ষণ না তাঁর এ দ্বন্দ্ব দূর হয়, ততক্ষণ ওখান থেকে এক পা-ও নড়বেন না। তিনদিন তিনরাত কেটে গেল। চতুর্থ দিনে দেখলেন, দূর থেকে এক উট্টারােহী তার দিকে এগিয়ে আসছেন। 


তাঁর খুব কাছে এসে উট সওয়ার ভীষণ কুদ্ধ হয়ে বললেন, বায়েজীদ, তুমি কি এ চাও যে বায়েজীদ-সহ সমগ্র বােস্তাম শহরের ধ্বংস করে দিই? তার কথা শুনে হযরত বায়েজীদ (র)-এর সম্বিৎ ফিরে আসে। তিনি আগন্তুকের পরিচয় জিজ্ঞেস করেন। তিনি কোথা থেকে আসছেন, তাও জানতে চান।

আগন্তুক বললেন, তুমি যখন আল্লাহর দরবারে শপথ করছিলে, তখন আমি ছিলাম এখান থেকে তিন হাজার মাইল দূরে। সেখান থেকে আমি আসছি। তোমাকে সাবধান করে গেলাম, তুমি তােমার মন নিয়ন্ত্রণে রেখাে। এ কথা বলে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

এ অভিজ্ঞতা অর্জনের প্রয়ােজন ছিল তার। হযরত আবু মুসা (র) তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য আপনাকে বড় কোন বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল কি? তিনি বলেন, আসলে আল্লাহর সাহায্য ছাড়া মনকে তাঁর দিকে নিয়ে যাওয়াই কঠিন। আর তিনি যদি এ ব্যাপারে সাহায্য করেন, তাহলে আর কষ্টের কিছু নেই।

হযরত আবু তুরাব (র)-এর এক শিষ্য সাধনাবলে মারেফাত বিষয়ে উচ্চস্থানের অধিকারী হন। আবু তুরাব (র) তাকে বলেন, হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর সাহচর্য তােমার পক্ষে খুব কার্যকর হতাে। শিষ্য বলেন, আমি তাে বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর প্রাপ্ত আল্লাহকে রােজ শতবার দেখে থাকি। আবু তুরাব (র) বললেন, তুমি তা দেখছ তােমার হিসাবে। বস্তুত দীদারে এলাহীর রকমফের রয়েছে।

মুরশিদের কথা আবু তুরাব শিষ্য একদিন হযরত বায়েজীদ (র)-এর দরবারে উপস্থিত হলেন। আবু তুরাব (র)-ও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) তখন কোথাও যাচ্ছিলেন। রাস্তায় দেখা হয়ে গেল। আর যেই শিষ্যের চোখের সঙ্গে তার চোখ মিলল, অমনি বিপুল ভয়ে শিষ্যের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর চাহনি তিনি সহা করত পারলেন না। শরীরে শুরু হলাে কম্পন। আরকিছু ক্ষণ পরে তিনি মারা গেলেন।

হযরত ইয়াহইয়া মাআয় (র) একজন সিদ্ধ সাধক ছিলেন। তিনি হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-কে এখানি পত্র লেখেন। তার মর্ম নিম্নরূপ। 

হযরত, এমন এক ব্যক্তি সম্বন্ধে আপনার কী ধারণা যিনি আজলের এক পেয়ালা পানি পান করে আত্নবিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছেন এবং এখনও ঐ অবস্থায় রয়েছেন? আর এক কথা। আপনার কাছে একটি গােপন তথ্য জানতে চাই। তবে যখন আপনি আর আমি জান্নাতের তুবা গাছের ছায়াতলে বসে বিশ্রাম নেব, তখন সেটি আপনার কাছে প্রকাশ করব।

এক পত্রবাহক মারফত তিনি পত্রখানি পাঠিয়ে দিলেন। আর সে সঙ্গে একখানি রুটি পাঠান। অনুরােধ করেন, তিনি যেন সেটি খান। কেননা, সে রুটির খামির তৈরী হয়েছে পবিত্র জমজমের পানির দ্বারা। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) এর উত্তরে লেখেন, এখানে এমন এক ব্যক্তি আছেন, যিনি আজলের দরিয়া সমূহের সমস্ত পানি পান করে চিৎকার করছেন, আরও আছে কি?

আর শুনুন ভাই, তুবা গাছের ছায়ায় বসার জন্য জান্নাতের কী দরকার। যেখানে আল্লাহর স্মরণে থাকেন, সেখানেই জান্নাত। সেখানেই তুবা গাছ। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) হযরত ইয়াহইয়া (র)-এর গুপ্ত প্রশ্নটিরও উত্তর লিখে দেন। পত্রের শেষে তিনি লেখেন, আপনার পাঠানাে রুটি খেতে পারলাম না। কেননা, জমজমের পানি দিয়ে এর খামির প্রস্তুত হলেও আটা কোন জায়গাৱ তো লেখেননি। 

চিঠির উত্তর পেয়ে হযরত ইয়াহইয়া (র) হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য বেরিয়ে পড়লেন। তাঁর সঙ্গে দেখা না করে সারারাত তিনি বাইয়ে কাটিয়ে দিলেন। জানতে পারলেন হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) রয়েছেন কবরস্থানে। তিনিও সেখানে গেলেন। দেখলেন তিনি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন-সে সন্ধ্যা থেকে।

রাত শেষ হয়ে যখন পুবালী আলাে ফুটে উঠল আকাশে, তখন নীরবতা ভঙ্গ করে গভীর সুরে তিনি তার প্রতিপালকের উদ্দেশে, বলে উঠলেন, প্রভু গো, আমি আপনার কাছে আপনার সাহায্য ও অনুগ্রহ ছাড়া আর কিছু চাই না। হযরত মাআয (র) মনে করলেন তার ধ্যান ভঙ্গ হয়েছে। তাই তিনি তাঁর দিকে অগ্রসর হয়ে সালাম জানালেন। আর গত রাতের অবস্থা জানতে চাইলেন। 

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, আল্লাহ পাক আজ রাতে আমাকে বিশটি মাকান চিনিয়ে দিলেন। কিন্তু আমি বললাম, প্রভু গাে, ওসবে আমার প্রয়ােজন নেই। কেননা, সেগুলি শুধু পর্দা বা আবরণ বিশেষ। হযরত ইয়াহইয়া (র) বললেন, প্রভু যখন নিজে থেকে আপনাকে দিতে চাইলেন, তখন আপনি মারেফাতের প্রার্থনা করলেন না কেন?

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, মারেফাতে আমার কী প্রয়ােজন? একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া কোন কিছুতেই আমার প্রয়ােজন নেই। তখন ইয়াহইয়া (র) তাঁর কাছে কিছু উপদেশ চাইলেন তিনি বললেন, যদি আল্লাহ্ আপনাকে হযরত আদম (আ)-এর মতাে দানশীলতা, হযরত জিব্রাইল (আ)-এর মতাে পবিত্রতা, হযরত ইব্রাহিম (আ)-এর মতাে বন্ধুতা, 

হযরত মুসা (আ)-এর মতাে প্রেমানুরক্তি, হযরত ঈসা (আ)-এর মতাে বিশুদ্ধতা ও শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মতো ভালােবাসা দান করেন, তবুও আপনি কেবল আল্লাহকেই কামনা করবেন। অন্য কিছুর ওপর মনােযােগ দেবেন না। কেননা, সবকিছুই উদ্দেশ্য পূরণের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। অবএব আপনি শুধু আল্লাহর সাহায্য সম্বল করে একমাত্র তার সন্তুষ্টিই কামনা করবেন।

একবার হযরত যুননুন মিশরী (র) তাঁর কাছে একখানি খুব সুন্দর জায়নামাজ পাঠান। তিনি বলেন জায়নামাযের দরকার নেই। তবে একখানা মসনদ হলে ভালাে হয়। অতএব একদিন মসনদও এল। কিন্তু আসলে তিনি তাে মসনদ চাননি। জায়নামায নেবেন না বলেই মসনদের উল্লেখ করেন। কাজেই তিনি মসনদ বর্তমান, তার আবার অন্য মসনদের দরকার কী!

শীতের এক রাত। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) শুয়ে ছিলেন এক গভীর জঙ্গলে। তাঁর গায়ে ছিল পশমের এক শরু কম্বল। নিদ্রিত অবস্থায় তাঁর যা হলাে, তাতে গােসলের প্রয়ােজন। কিন্তু প্রচণ্ড শীত। গােসল করতে মন গড়িমসি করতে লাগল। তখন তিনি ভাবলেন, প্রবৃত্তিকে শাস্তি না দিলে সে জব্দ হবে না। অতএব একটি কুয়াের পানিতে সুন্দর ভাবে গােসল করে সারারাত সেই ভেজা কম্বল পরেই কাটিয়ে দিলেন।

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) ফিরেছেন কবরস্থান থেকে। পথে এক যুবকের সঙ্গে দেখা। এক আমীর তনয়। বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে এনতার ফুর্তি করছে। তিনি নরম কথায় তাকে থামতে বললেন। তাতে যুবকের রাগ হলাে। সে তাকে অশ্লীল ভাষায় গালি-গালাজ করতে শুরু করল। তখন তিনি পাঠ করলেন-লা-হওলা অলা কুওয়্যাতা ইল্লাবিল্লাহ। সুমতি দেবার শক্তি আল্লাহ ছাড়া আর কারাের নেই। তার কথা শুনে যুবক আরও বিরক্তও ক্রুদ্ধ হয়ে বাদ্যযন্ত্র দিয়ে তাঁর মাথায় সজোরে আঘাত করল। আর মাথা ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ে তাঁর সারা শরীর লাল হয়ে গেল। ঐ অবস্থায় তিনি বাড়ি ফিরলেন। অবশ্য যুবকের বাদ্যযন্ত্রটিও ভেঙে যায়।

পরদিন সকালে তিনি বাদ্যযন্ত্রের মূল্য বাবদ কিছু টাকাও মিষ্টি হালুয়া এক লােক মারফত যুবকের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। আর একখানি চিঠিও দিলেন। গতকাল আমার মাথায় আঘাত করায় তােমার বাদ্যযন্ত্রটি ভেঙে গিয়েছে। তার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ কিছু টাকা পাঠালাম। আর তােমার মুখে যে তিক্ততার পরিচয় পেলাম, তা দূর করার জন্য কিছু মিষ্টি হালুয়াও পাঠিয়ে দিলাম। আশা করি, তা খেয়ে মুখের তিক্ততা দূর করবে।

চিঠি পড়ে যুবক হতবাক। যাকে অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ করলাম, মাথা ফাটিয়ে সর্বাঙ্গ রক্তরঞ্জিত করলাম, আর সে কিনা.......। বুকের ভেতর যেন ভাবনার ঘুর্ণিপাক খেয়ে গেল। সে ছুটে গেল হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর দরবারে। আর লুটিয়ে পড়ল তাঁর পায়ের তলায়। ক্ষমা চাই, ক্ষমা। বলাবাহুল্য, বায়েজীদ বােস্তামী (র) তাকে ক্ষমা করলেন।

এক গলিপথ দিয়ে তিনি চলেছেন। সঙ্গে রয়েছে শিষ্যের দল। হঠাৎ উলটোদিক থেকে এসে পড়ল এক কুকুর। বায়েজীদ বােস্তামী (র)ও শিষ্যগণ একপাশে সরে গেলেন। কুকুরটি চলে গেল। শিষ্যগণ জিজ্ঞেস করলেন, মানুষ হলাে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। আর কুকুর নিকৃষ্ট। 

তৎসত্ত্বেও আপনি তাকেই পথ ছেড়ে দিলেন? হযরত বায়েজীদ বােস্তামী বললেন, কুকুরটি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আজলের দিনে আমাকে কুকুর আর আপনাকে শ্রেষ্ঠ ওলী হিসেবে কেন নির্দিষ্ট করা হলাে? আমার এমনকি অপরাধ ছিল, আর আপনারই এমনকি পুণ্য ছিল, যার ফলে এমন তারতম্য হলাে? এই প্রশ্নটি মনে উদয় হওয়ায় সৌজন্য প্রকাশ্যের জন্য আমি ওকে পথ ছেড়ে দিয়েছি।

আরও একদিন একটি কুকুর তাঁর পাশ দিয়ে গেল, তিনি তার কাপড়ের আঁচল সরিয়ে নিলেন। কুর বললাে, আপনি এরকম করলেন কেন? আমার শরীর শুকনাে হলে তাে না পাক নয়। আর যদি ভেজাও হয়, তাহলে আপনার ছোঁয়া লাগলে আপনি পানি দিয়ে ধুয়ে পাক করে নিতে পারতেন। কিন্তু আপনি যা করলেন, তা নিছক অহঙ্কার ছাড়া কিছু নয়। আর এ অহঙ্কার রূপ অপবিত্রতা সাত সমুদ্রের পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললেও তা কখনও পবিত্র হবে না।

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, তা ঠিক। তােমার অশুচিতা বাইরের। আর আমার অপবিত্রতা ভেতরের। অতএব এস, আমরা একত্রে অবস্থান করি, তাতে আমার অশুচিতা কিছুটা দূর হতে পারে। কুকুর বলল, তা হতে পারে না। কেননা আমি আল্লাহর বিতাড়িত ও ঘৃণিত জীব। আর আপনি তাঁর প্রিয় দাস। দ্বিতীয়ত, আমি বর্তমান ছাড়া অন্য দিনের একখানা হাড়ও সঞ্চয় করি না। কিন্তু মানুষ সারা বছরের খাবার সংগ্রহ করে রাখে। আমাদের উভয়ের মধ্যে রয়েছে প্রকৃতিগত ব্যবধান। 

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) দুঃখ করে বললেন, হায়, কী আফসােস! আমি একটি কুকুরের সংস্পর্শে থাকারও উপযুক্ত নই। তাহলে মহান আল্লাহর নৈকট্যলাভের উপযুক্ত কিভাবে হতে পারি? প্রশংসা সেই মহান আল্লাহপাকের, যার সৃষ্ট এক নিকৃষ্ট জীব থেকেও মানুষের শিক্ষা হয়। বােস্তামরে এক বিখ্যাত সাধক প্রায় ত্রিশ বছর ধরে হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর সান্নিধ্য লাভ করেন। তিনি একদিন দুঃখিত চিত্তে বললেন, কত নামায, রােযা, উপাসনা করলেন। কিন্তু মুরশিদ বায়েজীদ বােস্তামী (র) যে মারেফাত শেখাচ্ছেন তা থেকে কোন ফল পাওয়া গেল না। এর কারণ কী?

বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, ত্রিশ বছর কেন ত্রিশ হাজার বছরও যদি উপাসনা, কর আর তােমার স্বভাব না বদলায় তাহলে মারেফাতের এক বিন্দু ঘ্রাণও তুমি পাবে না। তার কারণ কী হুজুর? তিনি বললেন। তার কারণ, বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, তুমি তােমার জীবনকে পার্থিব পােশাক দিয়ে ঢেকে রেখেছ।

এর প্রতিকারের উপায় কি?

উপায় আছে। কিন্তু তুমি তা গ্রহণ করবে কি?

নিশ্চয়ই। আপনি বলুন হুজুর।

তবে যাও। মাথা মুড়িয়ে ফেল। পরনের সুন্দর পােশাক খুলে ফেলে মােটা কম্বল পর। আর শহরের যে এলাকার লােক তােমাকে ভালাে করে চেনে, সেখানে গিয়ে বস। আর কিছু আখরােট নিয়ে শিশুদের ডেকে বল, তােমাদের মধ্যে যে একটি ধাক্কা দেবে তাকে একটি আর যে দুটি ধাক্কা দেবে, তাকে দুটি আখরােট দেব। এভাবে শহরের সব এলাকায় ঘুরে ঘুরে যেখানে তােমাকে সবচেয়ে বেশি অপমান করা হবে, তুমি সেখানে অবস্থান করবে। এ হলাে প্রতিকার বা সংশােধনের একমাত্র উপায়।

তার সাধক-শিষ্য বলে উঠলেন, সুবাহানাল্ললি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু। মহান আল্লাহ পাক পবিত্র। তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই।

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন: একজন কাফির বা মুশরেক এ পবিত্র বাক্য পাঠ করে মুসলিম হয়ে যায়। কিন্তু তুমি এ কালাম পাঠ করে মুশরিক হয়ে গেলে। সে কী হুজুর। তুমি এ কালাম পাঠ করে নিজের গৌরব বােধ করলে, আর এর দ্বারা আল্লাহর গৌরবহানি করলে। হুজুর। আমি আপনার এ নির্দেশিত উপায় অবলম্বন করতে পারব না। তাই আমি বলেছিলাম, বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, তুমি স্বভাব পরিবর্তনের পন্থা গ্রহণ করবে না। 

সমকালের অন্যতম বিখ্যাত পীর হযরত শাকীক বলখী (র)। তাঁর এক মুরীদ হজে যাবেন। হযরত শাকীক (র) জানতেন, বায়েজীদ বােস্তামী (র) মক্কা শরীফে অবস্থান করছেন। তিনি তাঁর শিষ্যকে তার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। মুরীদ হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর দেখা করলে তিনি তার পীরের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। মুরীদ বললেন, তিনি হযরত শাকীক (র)-এর শিষ্য। তাঁর গুরু সৃষ্টির মুখাপেক্ষী নন। 

তিনি তাওয়াক্কুলকে শক্তভাবে ধরে আছেন। আকাশ যদি তামার মতাে আর মাটি লােহার মতাে হয়, জমি যদি ফসল না দেয়, আকাশ থেকে যদি বৃষ্টি না ঝরে, পৃথিবীর সকল প্রাণী যদি তার পরিবারভূক্ত হয়, তবুও তিনি তাওয়াকুলকে ছেড়ে দেবেন না। মুরীদের কথা শুনে হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, এ যে একেবারে কুফরী ও শেরেকীর লক্ষণ। 

বায়েজীদ যদি একটি কাক হয়ে যায়, তবুও সে যেন তার শহরে কখনও উড়ে না যায়। তিনি শাকীক বলখী (র)-এর মুরীদকে আরও বললেন, ক্ষুধার্ত হলে মানুষের কাছ থেকে খাদ্য গ্রহণ করে তুমি ক্ষুধা দূর করবে। এটা কোন অন্যায় নয়। সেক্ষেত্রে তাওয়াকুলের কথা মুখে পর্যন্ত আনবে না। কারণ, আমার ভয় হয়, ঐ অবস্থায় তুমি এমন পাপ করে বসবে, যার ফলে তােমার শহর পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

মুরীদ দেশে ফিরে গিয়ে তার মুরশিদকে সব কথা বললেন। হযরত শাকীক বলনী (র) বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর কথার মর্ম বুঝতে পারলেন। আর তার নিজের ভুলও ধরে ফেললেন। কিন্তু সেটা শিষ্যকে জানতে দিলেন না। বললেন, হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) নিজে কেমন লােক, তা কেন তুমি জিজ্ঞেস করলে না? মুরীদ কোন জবাব দিতে না পেরে আবার চলে গেলেন হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর দরবার। আর তার পীরের প্রশ্নটি তুলে ধরলেন। বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, এ তােমাদের মস্ত বড় একটি ভুল। আগেই বলেছি, আমি মুতাওয়াক্কির নই। যদি তা-ই হতাম তাহলে একটা কেউকেটা হতাম। কিন্তু যেহেতু আমি কিছুই নই, অতএব আমার তাওয়াকুলের প্রশ্নই ওঠে না।

হযরত শাকীক বলনী (র) শিষ্য বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর এ কথার গৃঢ় রহস্য উপলব্ধি করতে না পেরে আবার ফিরে এলেন হযরত শাকীক বলনী (র)-এর কাছে। এসে দেখলেন তিনি মুমূর্ষ। মৃত্যু আসন্ন। দেরি না করে তিনি বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর কথাগুলি গুরুর কাছে নিবেদন করলেন। হযরত শাকীক (র) অন্তিম মুহুর্তে তার ভুল বুঝতে পারলেন। আর তওবা করলেন। কিছুক্ষণ পরেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।

হযরত আহমদ খাজরুই (র) সমকালের এক বিখ্যাত সাধক। তারও শিষ্য ছিল অসংখ্য একজন শিষ্য তাে হাওয়ায় ভেসে যেতে বা পানিতে হেঁটে যেতে পারতেন। প্রায় এক হাজার শিষ্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে তিনিও একদিন হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর দরবারে হাজির। সেখানে গিয়ে তিনি তাঁর শিষ্যদের বললেন, হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর সামনে দাড়াবার যােগ্যতা যাদের আছে, একমাত্র তারাই আমার সঙ্গে এস। সবাই ভেতরে গেলেন। শুধু একজন দাঁড়িয়ে রইলেন দরজায়।

আর হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) তাদের বললেন, আপনাদের মধ্যে যে সর্বোও, তাঁকে ভেতরে ডাকুন। অতঃপর লােকটিকে ডেকে আনা হলাে। শুরু হলাে আলাপ-আলােচনা।

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, ভাই আহমদ, এভাবে এখানে-ওখানে আর কত ঘুরে বেড়াবেন? হযরত আমহদ খাজরুই (র) বললেন, আপনার হয় জানা নেই, পানি এক জায়গায় আবদ্ধ থাকলে তার রং ও গন্ধ খারাপ হয়ে যায়।

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, তাহলে আপনি সমুদ্র হয়ে যান না কেন? সমুদ্রের পানির বর্ণ-গন্ধ বিকৃত হয় না।

আলােচনা ক্রমশঃ মারেফাতের উচ্চস্তরে উঠে গেল। আর হযরত আহমদ খাজরুই (র) সে সব কথার পূঢ়ার্থ অনুধাবন করতে না পেরে বার বার বলতে লাগলেন, দয়া করে একটু সহজভাবে বলুন। তখন বায়েজীদ বােস্তামী (র) আলােচনার স্তর নামিয়ে দিলেন। আর তিনি কিছু বুঝতেও পারলেন। আহমদ খাজরুই (র) বললেন, এখানে আসার আগে আপনার বাড়ির সামনে আমি ইবলিশকে বন্দী অবস্থায় দেখলাম। এটা যদি একটু বলেন।

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, আমার সঙ্গে সে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল, বােস্তাম শহরে সে প্রবেশ করবে না। কিন্তু সে তার কথা রাখেনি। তাই তাকে বন্দী করে রেখেছি।

শয়তানকে যিনি বন্দী করতে পারেন, তার আল্লাহপ্রদত্ত শক্তি সম্পর্কে আর কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। মাঝে মাঝে দেখা যেত, হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (রা)-এর বাড়িতে মহিলাদের প্রচুর ভিড়। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বলেন, ওরা ফেরেশতা। কালাম শেখার জন্য তাঁর কাছে আসে। একবার প্রথম আকাশের একদল ফেরেশতা এসে তাঁর সঙ্গে উপাসনা করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। 

তিনি তাদের জানান, আল্লাহর সাধনা করার শক্তি তার নেই। কিন্তু, তবুও সপ্ত আকাশ থেকে দলে দলে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়ে ঐ একই ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আর তিনিও ঐ একই উত্তর দিলেন। তখন তারা জিজ্ঞেস করেন, আপনার এ শক্তি কি কখনও হবে? তিনি বলেন, শেষ বিচারের দিনে যখন হিসেব-নিকেশ শেষ হবে, তখন তিনি আল্লাহর ধ্যান করতে করতে পবিত্র আরশ প্রদক্ষিণ করবেন। এক রাতে অপার্থিব আলােয় আলােকিত হয়ে উঠল হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর ঘর। 

তিনি তখন আলাের উদ্দেশ্যে বলেন, হে আলাে, এ যদি শয়তানের কারসাজি হয়, তাহলে আমাকে প্রতারিত করার সাধ্য তােমার নেই। আর তুমি যদি আল্লাহর নিকটবর্তী ফেরেশতাগণের তরফ থেকে এসে থাক, তাহলে তােমাকে সেবা করার সুযােগ দাও, যাতে আমি অলৌকিক শক্তির অধিকারী হয়ে মরতৰা হাসিল করতে পারি।

এক রাতে উপাসনা করে তিনি কোন তৃপ্তি অনুভব করলেন না। তিনি তার সেবককে বললেন, দেখ তাে বাড়িতে কিছু আছে কি না। খাদেম খুঁজে এক গুচ্ছ আঙুর পেলেন। তিনি তখনই সেগুলি গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে বললেন। আর সেটা করা মাত্র তিনি উপাসনার স্বাদ পেতে লাগলেন। প্রতিবেশিদের প্রতি তিনি যথেষ্ট কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন। এক দরিদ্র ইহুদি রুজি রােজগারের জন্য প্রায়ই বাইরে বাইরে কাটাতাে। তাতে তার পরিবারবর্গের খুবই অসুবিধা হতোে। এমনকি তেলের অভাবে ঘরে আলাে জুলত না। তার একটি শিশুসম্তান ছিল। রাতের বেলায় সে খুব কান্নাকাটি করত। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (রাঃ) ঐ ঘরে আলাে জ্বালাবার ব্যবস্থা করে দেন।

ইহুদি ফিরে এসে এ কথা শুনে খুব খুশি। হযরত বায়েজিদ বােস্তামী (র)-এর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধ বেড়ে যায়। তিনি তার স্ত্রীকে বলেন, শুধু বাইরের আঁধারে নয়, আমরা রয়েছি ভেতরের আঁধারে। চল, তাঁর কাছে গিয়ে এ আঁধার দূর করি। সপরিবারে হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর কাছে গিয়ে তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ইসলামের আলাে এসে তাঁদের মনের কালিমা ও আঁধার দূর করে দেয় ।

এক অগ্নিপূজককে ইসলাম গ্রহণ করতে বলা হয়। তিনি বলেন, বায়েজীদ বােস্তামী (র) যে ইসলাম পালন করেন, তা অনুসরণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তােমরা যে ইসলাম নিয়ে আছ, তার প্রতি আমার এতটুকু শ্রদ্ধা নেই। অর্থাৎ বায়েজীদ বােস্তামী (র) কতদুর ধর্মনিষ্ঠা ছিলেন, তার এ মন্তব্য থেকে বেশ স্পষ্ট হয় া

একদিন হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) তাঁর শিষ্যদের বললেন, আল্লাহর একজন ওলী আসছেন। চল, আমরা তাকে সসম্মানে এগিয়ে আনি।


সত্যিই সেদিন একটা গাধার পিঠে চড়ে হযরত ইব্রাহিম হারবী (র) এসে হাজির। তিনি হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-কে বললেন, আপনি কী করে জানলেন যে আমি আসছি? হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, আল্লাহ আমাকে জানিয়ে দেন যে, তার এক বন্ধু আসছেন। তাঁকে সসম্মানে বরণ করে তার দ্বারা আল্লাহর দরবারে আমি যেন সুপারিশ করিয়ে নেই।

হযরত হারবী (র) বললেন, আপনার এবং আমার মিলিত সুপারিশ রাসূলুল্লাহ (স)-এর সুপারিশের তুলনায় খুবই নগণ্য। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) চুপ করে রইলেন।

যা হােক, পরে তাঁরা এক সঙ্গে খেতে বসলেন। কিন্তু হযরত হারবী (র)-এর মনে হলাে, এ খাবার বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর মত এক জ্ঞানী সাধকের পক্ষে সঙ্গত নয়। বায়েজীদ বােস্তামী (র) তাঁর মনের কথা টের পেলেন। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। আহার ও বিশ্রামের পর তাঁকে নিয়ে গেলেন ঘরের এক দেওয়ালের কাছে। হাত দিয়ে দেওয়ালে আঘাত করা মাত্র একটি ফুটো হয়ে গেল। বায়েজীদ বােস্তামী (র) তার অতিথিকে বললেন, এ ফুটো দিয়ে বাইরেটা দেখুন। হযরত ইব্রাহিম হারবী (র) দেখলেন, বাইরে এক বিশাল সমুদ্র। আর বিপুল তার তরঙ্গোচ্ছাস। 

বায়েজীদ বােস্তামী (র) আবার বললেন, চলুন, সমুদ্রে গােসল সেরে নেই। কিন্তু হযরত হারবী (র) বললেন, ওখানে গোসল করার শক্তি নেই আমার। আল্লাহ আমাকে তেমন ক্ষমতা দেননি। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, আপনি বন-জঙ্গলের যবের যে রুটি খান, তাতে বুনাে জন্তুর মলত্যাগ করে। আপনি সে খবর রাখেন না। অথচ মনে মনে ভাবেন, যারা উপাদেয় খাবার খায়, তারা ধর্মনিষ্ঠ হতে পারে না।

এ কথায় বড় লজ্জা পেলেন হযরত হারবী (র)। বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর কাছে তিনি ক্ষমা চেয়ে নিলেন।

একবার বােস্তামে শুরু হয়ে গেল দুর্ভিক্ষ। অনাবৃষ্টির এ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। শহরবাসী আল্লাহর দরবারে আকুল প্রার্থনা জানাল। বৃষ্টির জন্য এস্তেস্কা নামায আদায় করল। কিন্তু কিছুই হলাে না। এক ফোটা বৃষ্টি ঝরল না আকাশ থেকে। হযরত বায়েজীদ (র) তখন শহরের বাইরে ছিলেন। হঠাৎ তিনি ফিরে এলেন। আর সবাই তাকে ধরে বসল, তিনি যেন বৃষ্টির জনা আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন। 

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) দুই জানুর মধ্যে মাথা রেখে আল্লাহর উদ্দেশে কী যেন বললেন কিছুক্ষণ। তারপর জনগণকে বললেন, যাও, বাড়ি ফিরে গিয়ে পানি নিকাশ নালাগুলি পরিস্কার কর। এখুনি বৃষ্টি হবে। আর তারা বাড়ি পৌছবার আগেই সারা আকাশ ছেয়ে খেল ঘন কালাে মেঘে। মূষলধারে শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। আর তা স্থায়ী হলাে দীর্ঘক্ষণ।

শরীরটা ভালাে যাচ্ছিল না হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) এব । চুপচাপ বসে আছেন। আর এভাবে বসে থাকতে থাকতে দেহ অবসন্ন হয়ে এল। একবার পা দুখানি সামনের দিকে ছড়িয়ে দিলেন। সেদিকে শহরের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি বসে ছিলেন। তার দেখাদেখি তিনিও তার পা দুখানি প্রসারিত করলেন। বড় অহঙ্কারী ব্যক্তি তিনি। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) প্রতি তার প্রচ্ছন্ন ঈর্যাও ছিল । মাঝে মাঝে হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর সভায় এসে বসতেন। আর চুপচাপ তার কথা শুনতেন। 

কিন্তু সেদিন তিনি যখন দেখলেন হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) তাঁর পদযুগল প্রসারিত করলেন, তখন তাঁর খুব রাগ হলাে। আর তিনি ও তাঁর পা ছড়িয়ে দিলেন সামনের দিকে। সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা বলে উঠলেন, এ আপনি কী করছেন? পা গুটিয়ে বসুন। কিন্তু হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, আহা থাক না। উনি একটু আরামে বসুন। কিছুক্ষণ পর হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) পা গুটিয়ে পুনরায় স্বাভাবিকভাবে বসলেন। আর ভদ্রলােক ও পা টেনে বসতে চাইলেন।

 কিন্তু তা আর হলে না। পা গুটানাে গেল না। সােজা হয়েই থাকল। এবার তিনি বুঝতে পারলেন যে, আল্লাহর বন্ধুর প্রতি তিনি যে ঈর্ষা পােষণ করেন, বা আজ যে আচার আচরণ দেখিয়েছেন, এ তারই ফল। নিজের ভুল বুঝতে পেরে তিনি হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর পা জড়িয়ে কেঁদে উঠলেন। আমাকে মাফ করুন হজুর। আমি বুঝতে পারিনি। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) তার মাথায় হাত রেখে বললেন, আমি আপনাকে মাফ করেছি। মনে রাখবেন, মনের পবিত্রতাই মানুষের পরম সম্পদ। 

যার মন পবিত্র ও কালিমাশূন্য, আল্লাহ তার ইচ্ছা পূরণ করেন। বােস্তাম শহরের এক দরবেশের মনেও তেমনি অহঙ্কার ছিল। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-কে তিনিও তার চেয়ে ক্ষুদ্র বলে মনে করতেন। অবশ্য তিনিও মাঝে মাঝে তার দরবারে গিয়ে বসতেন। আর এমন ভঙ্গি করতেন। যাতে মনে হতো, তার তুলনায় তিনি সত্যিই এক উঁচু দরের সাধক।

একদিন তিনি হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর কাছে একটি বিষয় জানতে চাইলেন। আর তিনি তা বুঝিয়ে দিলেন। কিন্তু মনে যার ব্যাধি, তিনি অত সহজে বুঝবেন কেন? তাই, আবারও বললেন, বিষয়টি আরও বিশদ করুন। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) তার মনের কথা খুব ভালাে করে জানতেন। তাই বললেন, আরও বিশদ জানতে হলে আপনাকে যেতে হবে ঐ অদূরবর্তী পর্বত গুহায়। ওখানে আমার এক বন্ধু আছেন। তার কাছে গিয়ে জেনে আসুন।

কথামত দরবেশ সত্যিই সেখানে গেলেন। গুহার মধ্যে ঢুকতে যাবেন, একটি বিশাল বিষধর সাপ ফণা তুলে ফোঁস ফোঁস করে তার দিকে তেড়ে এল। কোন রকমে প্রাণ নিয়ে ফিরে এলেন। আর হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর কাছে এসে বললেন, আপনি আমাকে মেরে ফেলার যােগাড় করেছিলেন আর কী! খুব বেঁচে গেছি। তখনও আতঙ্কে ভয়ে তিনি ঠক ঠক করে কাঁপছিলেন। 

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) তার অবস্থা দেখে বললেন, সামান্য একটি প্রাণী দেখেই আপনার এত ভয়! আল্লাহর সামনে গিয়ে যেদিন দাঁড়াবেন, না জানি সেদিন আপনি কী করবেন। আত্মভিমানী সাধকের সব অহঙ্কার গড়িয়ে গেল। একদিন আবু সাঈদ সাইখােরানী নামে একজন সাধক এলেন হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর অলৌকিক শক্তি পরখ করে দেখতে। আর তিনি তা বুঝে ফেললেন। তাই বললেন, আপনি আমার শিষ্য আবু সাঈদ রায়ীর কাছে যান। আপনার উদ্দেশ্য পূরণ হবে।

আবু সাঈদ রায়ী তখন ধ্যানমগ্ন সাধক সাইখােরানী এলেন। উপাসনা শেষ করে তিনি দরবেশের আগআগমনের হেতু জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, আমি কিন্তু আঙুর খেতে চাই। আবু সাঈদ রায়ীর হাতে ছিল একখানি কাঠের ছড়ি। সেটিকে দু'টুকরাে করে, এক টুকরাে তার সামনের মাটিতে পুঁতলেন। আরেক টুকরাে দিলেন আগাস্তুক দরবেশের হাতে। 

কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল-দুখণ্ড ছড়িই দু’টি ফলন্ত আঙুর গাছে পরিণত হয়েছে। থােকা থােকা আুর কুলছে। তবে দরবেশের হাতে যে খণ্ডটি ছিল, সে গাছের আঙুর ঝুলছে। তবে দরবেশের হাতে যে খণ্ডটি ছিল, সে গাছের আঙুর কালাে। আর তিনি যেটি মাটিতে পুঁতেছিলেন, সে গাছটির আঙুর সাদা।

অভিমানী দরবেশ এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। আবু সাঈদ রায়ী বললেন, এর কারণ হলাে নিয়ত। আমি খােলা মনে আল্লাহর কাছে এ অলৌকিক শক্তি কামনা করেছি। আর আপনি এটা দেখতে চেয়েছেন আমাকে পরীক্ষা করতে। যে কোন কাজের ফলাফল নিয়ত অনুযায়ী নির্ধারত হয়। আপনার নিয়ত ছিল কালাে। অতএব আঙুরও হয়েছে কালাে। 

তারপর তিনি তাঁকে একখানি সাদা কম্বল দিয়ে খুব সাবধানে রাখতে বললেন। কম্বলখানা নিয়ে ঐ দরবেশ গেলেন হজ্জ করতে। তিনি খুব সাবধানেই রেখেছিলেন। তবুও আরাফাতের ময়দানে তা হারিয়ে গেল। এরপর তিনি যখন আবার বােস্তামে এলেন, দেখলেন কম্বলখানা রয়েছে আবু সাঈদ রায়ীর কাছেই।

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর মুরশিদ ছিলেন এক বৃদ্ধা মহিলা। একবার এক বনের পাশে তাঁর সঙ্গে বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর দেখা হয়। মাথায় আটার বস্তা নিয়ে তিনি পথ চলছিলেন খুব কষ্ট করে । হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-কে দেখে তাকে সেটি তাঁর বাড়ি পৌছে দিতে বললেন আর ঠিক ঐ সময় বন থেকে বেরিয়ে আসে একটি বাঘ। 

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বাঘটিকে কাছে ডেকে, তার পিঠে আটার বস্তা তুলে দিয়ে বৃদ্ধার বাড়িতে দিয়ে আসতে বলেন। বাঘ রাজি হয়। তিনি মহিলাকে জিজ্ঞেস করেন, পাড়ায় গিয়ে তিনি লােকনকে কি বলবেন? বৃদ্ধা জবাব দেয়, বলব যে আজ এক আত্মভিমানী অত্যাচারীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বলেন, সে কি! আমি আবার আত্নম্ভরী হলাম কিভাবে? বৃদ্ধা বলেন, বাঘ কখনও বােঝা লয় না। অথচ তুমি তার পিঠে বােঝা চাপিয়ে দিলে। এটা কি বাঘের ওপর জুলুম করা হলাে না? আর তােমার মনের ইচ্ছাটা এই যে, তােমার অলৌকিক শক্তির কথা আমাদের পাড়ায় প্রচারিত হােক। আর সবাই তােমার স্তুতি প্রশংসা করুক। এটা কি আত্মম্ভরিতা নয়?

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) তার কথা উল্লেখ করে বলতেন, ঐ বৃদ্ধাকে আমি আমার শ্রেষঠ মুরশিদ হিসেবে গণ্য করেছি। 

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। হযরত আহমদ খাজরুই (র) স্বপ্ন যােগে আল্লাহ পাকের পবিত্র জ্যোতির সাক্ষাৎ লাভ করেন। তিনি তখন বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর মর্যাদা সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। আল্লাহ জানান, তোমরা শুধু নিজেদের প্রয়ােজনের কথা বল। কিন্তু বায়েজীদ শুধু আমাকেই খোঁজে। তার মধ্যে অন্য কিছু নেই। সুতরাং আল্লাহর দরবারে তাঁর মর্যাদা কতখানি উন্নত ছিল, এ থেকে স্পষ্ট বােঝা যায়। 

একবার হযরত শাকীক বলখী (র) তার শিষ্য আবু তুরাবকে নিয়ে। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর দরবারে আসেন। সেখানে অন্য আরও অতিথি ছিল। যথাসময়ে অভ্যাগতদের নিয়ে হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) খেতে বসলেন। হযরত শাকীক বলখী (র) ও তার শিষ্য সেদিন রােজা রেখেছিলেন। তবুও নিমন্ত্রণ রক্ষা ও হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর প্রতি সৌজন্য প্রদর্শনের জন্য শাকীক বলখী (র) নফল রােজা তরক করে আহারে অংশগ্রহণ করলেন। 

কিন্তু আবু তুরাব খেতে রাজী হলেন না। তখন বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর অন্যান্য অতিথি ও শিষ্যগণ বললেন, নফল রােজা তরক করে যদি নিমন্ত্রণ রক্ষা করা হয়, তাহলেরােযা ও নিমন্ত্ণ রক্ষা-দুটি পূণ্য পাওয়া যায়। কিন্তু তবুও আবু তুরাব রােযা ভাঙতে সম্মুত হলেন না। এবার কথা বললেন-হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)। বললেন, তােমরা হয়তাে জান না, এ লােকটি আল্লাহ থেকে বহু দূরে পড়ে রয়েছে।

কয়েকদিন পর দেখা গেল, চুরির অপরাধে আবু তুরাব গ্রেপ্তার হয়েছেন। আর বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তার হাত কাটা হয়েছে।

 তাঁর কৃতজ্ঞতা বােধও ছিল অসাধারণ। একবার জামে মসজিদের কোণায় হাতে ছড়িখানা দাঁড় করিয়ে রেখে তিনি নামায পড়ছিলেন। কোনভাবে সেখানা মেঝেতে পড়ে যায়। আর এক বৃদ্ধ ব্যক্তি আবার তা খাড়া করে রাখেন। নামায শেষ করে ঘটনাটি শােনা মাত্র তিনি ঐ বাড়ি গিয়ে তার এ কাজের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। 

পাছে মনের মধ্যে একবিন্দু অহঙ্কার আসে, এ ভয়ে তিনি সদা-সর্তক থাকতেন। এরবার দজলা নদী তাঁর সম্মানে স্ফীত হয়ে তরঙ্গোচ্ছাস নিয়ে তাঁর পায়ের ওপর আছড়ে পড়ে। তাতে বিন্দুমাত্র গৌরববােধ করেননি তিনি। বলেন, তার দীর্ঘ ত্রিশ বছরের সংগ্রাম ও সাধনা নিমেষের মধ্যে নষ্ট হােক, এ তিনি চান না। তিনি শুধু তার প্রতিপালকের সন্তুষ্টির প্রত্যাশী। অলৌকিকতা তাঁর কাম্য নয়। 

একবার তিনি স্থির করেন, পরিবার-পরিজনের গুরুদায়িত্ব আল্লাহর হাতেই ছেড়ে দেবেন। আর এ মর্মে, মােনাজাতের জন্য তিনি আল্লাহর দরবারে প্রায় হাত ওঠাতে গেছেন, হঠাৎ মনে হলাে, কাজটা রাসূলুল্লাহ (স-এর সুন্নতের বিরুদ্ধে যাবে। কেননা, রাসূলে করীম (সাঃ) তাঁর পরিবার পরিজনের ভার আল্লাহর হাতে সােপর্দ করেননি। আর সেটা মনে হওয়া মাত্র তিনি তার সংকল্প পবিত্যাগ করলেন। 

তিনি বলেছেন, তারপর থেকে আল্লাহ অবশ্য এ ব্যাপারটি খুব সহজ করে দেন। ইমামের পেছনে নামায আদায় করে মসজিদে বসেছেন হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) ইমাম সাহেব ও তাঁর কাছে এসে বসলেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি বায়েজীদ বােস্তামী (র)-কে তাঁর জীবিকা নির্বাহের উপায় অবলম্বন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি জানালেন, প্রথমে তার নামাজের কাজা আদায় করে তিনি তার প্রশ্নের জবাব দেবেন।

অবাক হয়ে ইমাম বলেন, এ মাত্র তাে নামাজ পড়লেন। কাজা পড়বেন কেন? হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর সুস্পষ্ট উত্তর, যিনি রুজিদাতাকেই  চিনতে পারেননি, তার পেছনে নামায পড়া দুরস্ত হয়নি। বলা বাহুল্য, ইমাম সাহেব আর কথা খুজে পেলেন না। 

তাঁর শিক্ষা হয়ে গেল। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) নিজেই বলেছেন, তাঁর আপাত-সংগত কার্যকলাপ দেখে যারা তাঁর পেছনে নিন্দাবাদ করে, তারা আল্লাহর ক্রোধে পতিত হয়, আর যারা তাঁকে স্বাভাবিক অবস্থায় দেখে তাঁর প্রশংসা করে, তাঁরা পুণ্যের অধিকারী হয়। তিনি প্রায় বলতেন, যদি রােজ কিয়ামত একটু তাড়াতাড়ি আসে, তাহলে তিনিও তাড়াতাড়ি গিয়ে জাহান্নামের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেন। তাহলে জাহান্নামের কিছুটা স্নিগ্ধ হয়ে যেত। আর জাহান্নামবাসীরাও ঈষৎ শাস্তি পেত।

কিছু লােক তাকে বলে, হাতেম ইবনে আসাম (র) বলেন যে, যারা কিয়ামতের দিন জাহান্নামীদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে না, তারা আমার মুরীদই নয়। একথা শুনে হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বলেন, আর যারা জাহান্নামবাসীদের জান্নাতে পাঠাবার জন্য নিজেরা জাহান্নাম বরণ না করবে, তারা আমার মুরীদ নয়। অর্থাৎ গুণগত দিক দিয়ে তাঁর শিষ্যবর্গকে কেমন হতে হবে, তিনি তার আভাস দিলেন।

আল্লাহ যখন তাকে প্রভূত আলৌকিকতা দান করেছেন, তখন তার উচিত ছিল পথভ্রষ্টদের সরলপথে ফিরিয়ে আনা। কিন্তু তিনি তা করছেন না কেন? তাকে এ প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেন, যারা নিজেরাই দূরে সরে যায়, তাদের আমি কিভাবে আল্লাহর পথে টেনে আনতে পারি?

মাথা নিচু করে তিনি বসে আছেন। আত্মগত। তিনি উপবিষ্ট বটে। কিন্তু তার মধ্যে তিনি নেই। আর ঠিক এ অবস্থায় এ জ্ঞানী ব্যক্তি তাঁর কাছে এলেন। বললেন, আপনাকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? তিনি কোন উত্তর দিলেন না। বরং প্রশ্ন শােনা মাত্র আরও চিন্তাক্লিষ্ট হলেন। 

তারপর আচমকা জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরে এলে তিনি বলে উঠলেন, প্রভু গাে, কেন কেন জানি না, আপনি আজ আমার মুখ থেকে নিজের মারফাতের কথা প্রকাশ করালেন। আল্লাহর ভয়ে ভীত এই মানুষটি একদিন কাপছেন, একজন কেউ তার এ অবস্থা কথা জানতে চাইলে বললেন, দীর্ঘ ত্রিশ বছরের কঠোর সাধনার বলে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তা তুমি বুঝবে না।

আরবের মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড লড়াই চলছে খ্রীষ্টান সেনাদের। যুদ্ধক্ষেত্রে সাধ্যমতাে যুদ্ধ করছেন। কিন্তু এক সময় হটে আসতে বাধ্য হন। তখন হঠাৎ কিছু মুসলিম সেনার মুখ থেকে বেরিয়ে এল হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) আমরা বিপন্ন। সাহায্য করুন। আর এই আর্তকণ্ঠ গিয়ে পৌছাল কয়েকশাে মাইল দূরে যেখানে হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বােস্তামে অবস্থান করছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এক মুঠো ধুলাে নিয়ে শূন্যে উড়িয়ে দিলেন। 

আর যুদ্ধরত মুসলিম সেনারা দেখতে পেলেন, বিশাল এক অগ্নিশিখা একদিক থেকে ধেয়ে আসছে খ্রীষ্টান বাহিনীর দিকে। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে প্রাণরক্ষার তাগিদে তারা যে যেদিকে পারেন, ছুটে পালালেন। যুদ্ধে জয়ী হলেন মুসলিম সেনাদল। শিষ্যসহ মােরাকাবায় তিনি মগ্ন। আর এ সময়ে এলেন এক দরবেশ। আর তিনিও মােরাকাবায় বসলেন। ধ্যান ভগ্ন হবার পর দরবেশ তাঁকে বললেন, এতক্ষণ আপনি কোথায় ছিলেন? হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, আল্লাহর দরবারে। দরবেশ বললেন, আমিও তাে ছিলাম সেখানে। কই, আপনাকে দেখলাম না?

তিনি বললেন, আপনি ছিলেন পর্দার বাইরে। আর আমি ভেতরে। আমাকে দেখবেন কী করে? তিনি আরও বললেন, যে ব্যক্তি তরীকতের সুন্নত অনুসরণ না করে নিজেকে তরীকতপস্থী বলে, স্পষ্টতই সে মিথ্যাবাদী। সত্য এ যে, শরীয়ত বাদ দিয়ে কখনও তরীকত লাভ করা যায় না।

বিপদের সময় তিনি আল্লাহর কাছে ধৈর্যধারণের শক্তি প্রার্থনা করতেন। বলতেন, প্রভু, আপনি যখন খাবার জন্য আমাকে রুটি দিয়েছেন, তখন তরকারীও দান করুন। তবেই তা ভালােভাবে রুটি খেতে পারব। অর্থাৎ, আল্লাহ যদি বিপদ দিয়েছেন তাে, ধৈর্যের ক্ষমতাও দান করুন।

একবার হযরত আবু মুসা (র) তাঁর কাছে জানতে চান, কিভাবে তাঁর রাত কাটে। তিনি বলেন, আল্লাহর ধ্যানে থেকে কখন দিন যায় রাত আসে, তিনি বুঝতে পারেন না। তিনি আরও বলেন, আল্লাহ তাকে জানিয়েছেন, উপাসনা যথেষ্ট হয়েছে। এবার তিনি যদি তার সাক্ষাৎ চান তাে, তাঁর দরবারে সুপারিশের জন্য দুটি বস্তুু পাঠান, যা তাঁর খাজাঞ্চি খানায় নেই। কিন্তু বস্তু দুটি কী? আল্লাহ জানান, সে দু’টি হলাে, বিনয় ও নম্রতা। তিনি আরও বলেন, অপদস্থ হও। বিপদ-আপদ বরণ কর। কেননা আমার মধ্যে এ বস্তুু দুটি নেই।

এ মহাজ্ঞানী মহাতাপস যখন আল্লাহর গুণাবলির বিবরণ দান করতেন, তখন স্বাভাবিক অবস্থায় থাকতেন। কিন্তু যখন আল্লাহর সত্তা সম্পর্কিত বক্তব্য রাখতেন তখন নিজের মধ্যে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারতেন না। এ অবস্থায় প্রায়ই তিনি বলতেন, যখন যেখানে থাকি, আল্লাহকে খুব কাছেই দেখতে পাই। অন্য যে কোনও সাধকের তুলনায় তাঁর তত্ত্বজ্ঞান ছিল গভীর। 

একজন দরবেশ বললেন, আমি আল্লাহর সে দাসের প্রতি অশ্চর্যবােধ করি যে, আল্লাহকে জানার পরও তার উপাসনা করে না, কিন্তু হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, আমি আশ্চর্যবােধ করি সেই লােকের প্রতি, যে আল্লাহকে জানার পর উপাসনায় রত হয়। তার এ মন্তব্যের অর্থ হলাে, আল্লাহকে সত্যিকারের জানা বা চেনার পর মানুষের আর স্বাভাবিক জ্ঞান-বুদ্ধি থাকেনা। 

তখন তার পক্ষে উপাসনার গুরুত্ব উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজের কথা বলেন। প্রথমবার হজ্জ করতে গিয়ে তিনি কাবাঘর জিয়ারত করেন। দ্বিতীয়বারে কাবাঘরের মালিক অর্থাৎ আল্লাহর জিয়ারত করেন। কিন্তু তৃতীয় দফায়, না কাবা, না তার মালিক, কাউকে দেখতে পাননি। কেননা, তখন তিনি আল্লাহকে এত বেশি স্মরণ করতে থাকেন যে, তিনি তাঁর ভেতরের এবং বাইরের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন।

আল্লাহর ধ্যানে তিনি এমন গভীর ভাবে মগ্ন হন যে, তাঁর আত্মবিস্মৃতিও ঘটে। একদিন একটি অভদ্র লােক তার বাড়ির দরজায় এসে বায়জীদ কোথা', 'কোথায় বায়েজীদ' বলে চিৎকার করতে থাকে। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলেন, অনেকদিন থেকে আমিও তাঁকে খুঁজছি । কিন্তু কোথায় তিনি লােকটি হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-কে চিনত না। সুতরাং এ কথার মর্ম উপলব্ধি করার ক্ষমতা তার ছিল না। 

এ ঘটনার যারা প্রত্যক্ষদর্শী, তারাও কিন্তু হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-কে এ বিষয়ে কোন প্রশ্ন করল না। তারা এর গৃঢ়ার্থ জানতে চাইল মিশরের প্রখ্যাত সাধক হযরত যুননুন মিশরী (র)-এর কাছে। হযরত যুননুন (র) বলেন, তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে আল্লাহর মধ্যে বিলীন হয়ে গেছেন। তাই এখন আর নিজেকে চিনতে পারেন না। তাঁর সাধনার স্বরূপ উপলব্ধি করা সত্যিই কঠিন। 

বিশেষ করে উচ্চ পর্যায়ে। তবে নিম্নতম স্তরের অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, নফস বা প্রবৃত্তিকে আল্লাহর পথে আকৃষ্ট করার জন্য তিনি একবার খুব চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রবৃত্তি তাঁর কথা শােনে না। তিনিও নাছােড়বান্দা। সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নন। তিনি তার পানি বন্ধ করে দিলেন। আর তাকে বলে দিলেন, যদি এখনও তুমি উপাসনায় রত না হও, তাহলে পিপাসায় ছটফট করে মারা যাবে।

অতএব তাঁর সাধনা যে বড় কঠোর ছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। একমাত্র আল্লাহ ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। সুতরাং পার্থিব কোন কিছুই তার মনে থাকত না। এ আত্মভােলা মানুষটির সেবায় নিযুক্ত ছিলেন তাঁর এক শিষ্য দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে। কিন্তু যখনই তিনি তাকে কোন কাজ করতে বলতেন, তখনই তার নাম জিজ্ঞেস করতেন। 

বেচারা একদিন জিজ্ঞেস করেই বসলেন, আপনি কি আমাকে পরিহাস করছেন হুজুর? এভাবে বারবার আমার নাম জানতে চান কেন? হযরত বললেন, না, না। আমি পরিহাস করছি না। তবে আল্লাহর নাম আমার অন্তরকে সম্পূর্ণরূপে দখল করেছে। সেখানে তাই অন্য নামের কোনও ঠাই নেই আর আমিও সবকিছু ভুলে যাই।

তাঁর উচ্চ মর্যাদা লাভ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ছেলেবেলায় এক চাঁদনী রাতে তিনি বাইরে বেড়াতে গিয়েছেন। হঠাৎ তার চোখের সামনে প্রতিভাত হয় এক অনিন্দ্যসুন্দর দরবার, যার তুলনায় পৃথিবীটাও তুচ্ছ হয়ে যায়। তিনি তখন তার প্রতিপালকের উদ্দেশে বলেন, আপনার এই অনুপম দরবার সকলের দৃষ্টির আড়ালে কেন প্রভু? তখন অদৃশ্যবাণী ধ্বনিত হয়-আমার এ দরবারে কেবল উপযুক্তরাই আসতে পারে। তখন মনে হলাে, যারা অনুপযুক্ত, তিনি তাদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলবেন। 

কিন্তু পরক্ষণে মনে হলাে, এ কাজ তাে শুধু রাসূলে করীম (স)-এর তখন আবারও উচ্চারিত হলাে আকাশ বাণী-তুমি আমার প্রিয় নবীর প্রতি যে সম্মান দেখালে, তার পুরস্কারস্বরূপ আমিও তােমার মর্যাদা বাড়িয়ে দিলাম। দুনিয়াতে তুমি সুলতানুল আরেফীন নামে খ্যাত হবে।

 একবার এশার নামায শেষ করে তার মনে হলাে, ঠিক কবুলের উপযােগী হলাে না। কাজেই তিনি আবার নামায পড়লেন। কিন্তু এবারেও সে একই অবস্থা। যথাযথভাবে নামায আদায়ের জন্য তিনি সারা রাত ধরে এশার নামায পড়লেন। কিন্তু তবুও তার আত্মতুষ্টি এল না। 

হতাশ হয়ে তিনি ভাবলেন, যেমন তিনি, তেমনি তার নামাযও। ওটা কি করে ভালাে হবে? তখন তিনি আল্লাহর উদ্দেশে বললেন, নামাজ্যনিষ্ঠা দাস হবার বহু চেষ্টা করলাম। কিন্তু সব বৃথা গেল। এখন আমি আর কী করতে পারি? আপনি আমাকে আপনার বেনামাজী বান্দাদের অন্তভূর্ক করে দিন

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর প্রভাতী সাধনা প্রত্যেক্ষ করার জন্য একদিন এক ব্যক্তি তাঁর কাছে থাকল। সে দখল, আল্লাহ' বলে খুব জোরে চিৎকার করে উঠে তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। তাতে তাঁর মাথায় ভীষণ চোট লাগল। এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিন বলেন, আল্লাহর আরশের কাছাকাছি গিয়ে আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহ কোথায়? তখন উত্তর হলাে, তাঁকে দুনিয়ায় বসবাসকারী মানুষের ভয় ও ব্যথিত হৃদয়ের মধ্যে খোঁজ কর। অতঃপর আমি যখন তাঁর নিকটবর্তী হলাম, তখন আমাকে জিজ্ঞেস করা হলাে, তুমি কী চাও বল?

আমি বলাম, যা কিছু হয় দিন। তখন বলা হলাে, আমার স্থায়ী নৈকটা লাভ করতে হলে নিজেকে বিলীন করে দাও। আমি আবার বললাম, কিছুটা বরকত ও ফায়েজ হাসিল ব্যতীত আমি এখান থেকে বিদায় হবাে না। তখন আবার জিজ্ঞেস করা হলাে, তুমি আমার কাছে কী চাও বল তখন আমি সমগ্র সৃষ্টির মাগফেরাত প্রার্থনা করলাম । 

বলা হলাে,ভালাে করে তাকিয়ে দেখ। আমি দেখলাম, প্রতিটি সৃষ্টির সঙ্গে তার মুক্তির জন্য একজন করে সুপারিশকারী রয়েছে। কিন্তু আল্লাহ পাকের সর্বাধিক করুণা এসেছে আমার ওপরে। তখন আমি কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর আবার বললাম, ইবলীসকেও ক্ষমা করুন।

এবার উত্তর হলাে, সে যে আগুনের তৈরি । আগুনের সঙ্গে আগুনেরই মিল, কিন্তু তুমি যে আশুন থেকে পরিত্রাণের চেষ্টা কর।  অতঃপর আল্লাহ আমার সামনে দুটি বিশেষ প্রতিদান রাখলেন। কিন্তু আমি তার কোনটিই গ্রহণ করতে রাজি হলাম না। তখন আবার প্রশ্ন, তবে তুমি কী পেতে চাও বল। আমি উত্তর দিলাম, আমি কোন কিছুরই প্রত্যাশী নই। অপ্রত্যাশিতভাবে যা পাওয়া যাবে, আমি তাতেই খুশি। 

একজন কেউ হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর কাছে দোয়া চান। তিনি আল্লাহকে বলেন, প্রভু গাে, আপনার দাস আমার উসিলা করে আপনার নিকট প্রার্থনা করছে। তার মনের ইচ্ছা কী, আপনি জানেন প্রভু। আল্লাহ হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর প্রার্থনা মঞ্জুর করতেন।

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-হেটে চলেছেন রাজপথ ধরে। হঠাৎ তার এক ভক্ত এসে পদচিহ্নের ওপর পা ফেলে ফেলে পেছনে পেছনে আসতে লাগল। আর বলতে লাগল, একেই বলে মুরশিদের কদম পর চলা বা প্রকৃত অনুবর্তিতা। কিছুক্ষণ পর অনুসরণকারী নিবেদন করল, আপনি আপনার ছেড়া কম্বলের একটি টুকরাে দান করুন। আশা করি তার বরকতে আমি উপকৃত হবাে।

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, তােমার দুটো কথাও দুটো ধারণাই ভ্রান্ত। প্রকৃত অনুবর্তিতা হলাে কথা ও কাজের চর্চা করা। কম্বলের টুকরাে চাওয়া ও অবান্তর। যতক্ষণ না তুমি আমলের মতাে আমল করছ, ততক্ষণ কম্বল তাে দূরের কথা, আমার গায়ের চামড়া তুলে নিলেও তা কোন কাজে আসবে না।

একদিন তিনি রাস্তায় দেখলেন, এক পাগল বারবার আল্লাহর উদ্দেশে বলছে, প্রভু আমার ওপর কৃপা বর্ষণ কর। তিনি পাগলকে বললেন, তুমি এমনকি পুণ্যচর্চা করেছ যারা দ্বারা আল্লাহর কৃপা কামনা করছ? পাগল বলল, প্রভুর কৃপা বর্ষিত হলেই তাে আপনা থেকে পুণ্যচর্চা শুরু হয়ে যাবে। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, তােমার এ কথাটি অবশ্যই অর্থবহ।

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বলেন, আল্লাহর উপাসনা দ্বারা অভীষ্ট অর্জনের পথের বাধা সত্তরটি পৈতা ছিড়তে তিনি সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু অবশিষ্ট রয়েছে একটি। সেটিও ছিন্ন করার শক্তি কামনা করে আল্লাহর দরবারে তিনি বহু কান্নাকাটি করলেন। কিন্তু তাকে জানিয়ে দেয়া হলাে, ওটা ছিড়ে ফেলা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। 

কিন্তু তিনি আরও বেশি করে কঠোর সাধনার দ্বারা আল্লাহর দরবারে বারবার আঘাত হানলেন। সবশেষে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার সমুখীনও হলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলাে না। শেষে অসংখ্য বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে যদিও বা পৈতা ছিন্ন করলেন, কিন্তু দৃঢ় হৃদয়ে আল্লাহর দরবার অভিমুখী অগ্রসর না হওয়া পর্যন্ত তিনি গৌরবময় সােপানে আরােহন করতে পারেননি। পরে অবশ্য আল্লাহর অশেষ কৃপায় সাফল্য লাভ করেন। 

একবার তিনি তাঁর শিষ্যদের উপদেশ দিচ্ছিলেন, আল্লাহ ছাড়া কোন কিছুই কামনা করাে না। আল্লাহ যখন তােমাদের হয়ে যাবে, তখন দেখবে সব কিছুই তােমাদের। অজ্ঞাতবশত মানুষ অনেক কিছু কামনা করে। কিন্তু সেগুলি তাকে আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। প্রথম দিকে আমি নিজেও এ ধরনের ভুল করি। অর্থাৎ ত্রিশ বছর ধরে আমি আল্লহর দরবারে নানা 

জিনিস চেয়েছি। কিন্তু যখন মারেফাতের প্রথম স্তর অতিক্রম করলাম, তখন আমার অজ্ঞতা দূর হলাে। আমি আল্লাহকে বললাম, প্রভু গাে, কোন কিছুই আমার চাই না। শুধু আপনি আমার হয়ে যান। এর ফল আমি পেয়েছি। যখন সত্যিই আমি কোন কিছুর মুখাপেক্ষী থাকলাম নাম, তখন একবার হজ্জে  গিয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হলাম। দেখলাম, এর আগে যে কাবাঘর আমি প্রদক্ষিণ করেছি বহুবার, এবার সে কাবারঘরই আমাকে প্রদক্ষিণ করছে।

হযরর বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর কাছে শেষ রাত্রির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কেননা তিনি বলতেন, ঐ নিস্তব্ধ প্রহরে প্রেম হয়, তা অন্য সময় সম্ভব নয়। আর এ জন্য, শেষ রাতের একটি পলকের বিনিময়ে তিনি আট জান্নাত বা দু’জগতের রাজত্ব গ্রহণ করতেও রাজি ছিলেন না।

একদিন বােস্তাম শহরে এল এক রূপসী বারাঙ্গানা। আর মক্ষিরানীর মতাে সে শহরের তরুণদের আকৃষ্ট করল। উপাসনা, ধর্ম-সব যায় যায়। অভিভাবক সমাজ এর প্রতিকার কামনায় হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর দ্বারস্থ হলেন। আর তিনি প্রতিকারের আশ্বাসও দিলেন।

কর্মপন্থা স্থির করে ওই রাতেই তিনি রূপসীর ঘরে গেলেন। সঙ্গে কিছু টাকাও নিলেন। রূপসী তাঁকে চেনে না। একজন খদ্দের বলেই ভাবল। সুতরাং নিয়মমাফিক তাঁকে অভ্যর্থনা করে বসার আসন দেখিয়ে দিল। তিনিও যথারীতি আসন গ্রহণ করলেন। আর গণিকার কাছ থেকে বেশি টাকার বিনিময়ে সারা রাত তার হুকুম তামিলের প্রতিশ্রুতিও আদায় করে নিলেন।

এবার তিনি টাকাগুলি সামনে রেখে বললেন, অযু গােসল করে পাক পবিত্র হয়ে তুমি আমার সঙ্গে দু'রাকায়াত নামায আদায় কর। বারাঙ্গনার জীবনে এ এক অভিনব অভিজ্ঞতা। এমন খন্দের সে এর আগে কখনও দেখিনি। তাঁর কথাবার্তা হাবভাবও বিচিত্র মনে হচ্ছে। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায়। তাকে নিয়ে দু'রাকায়াত নফল নামায পড়লেন। নামায শেষে তিনি হাত ওঠালেন আল্লাহর দরবারে, প্রভু গাে, আপনার এ পথভ্রষ্টা দাসীকে আমি জায়নামাজের ওপর আপনারই দিকে মুখ ফিরিয়ে দিলাম। আপনার চরণমূলে ঝুঁকিয়ে দিলাম তার মাথা। এবার আপনি তার অন্তরকে আপনার প্রতি আকর্ষণ করুন।

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর প্রার্থনা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে গেল। গণিকার মনে সৃষ্টি হলাে ভাবান্তর। যেন অন্তর জুড়ে শুরু হলো তুমুল আলােড়ন। সারা জীবনের সঞ্জিত পদপ্রান্তে। হে মহান, তওবা করে আমাকে পাপমুক্ত করুণ। আমি চিরদিন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) সঙ্গে সঙ্গে তাকে তওবা পড়িয়ে দিলেন। কথিক আছে, এ বিখ্যাত বারাঙ্গানা পরবর্তীকালে এক বিশিষ্ট সাধিকায় রূপান্তরিত হন।

চারজন জ্ঞানী ব্যক্তি এসেছেন হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর দরবারে। সৃক্ষ মারেফাত তত্ত্বের আলােচনা হবে। একটি ঝকঝকে সাদা পেয়ালায় কিছু মধু ও একগাছি চুল এনে আলােচনা সভায় রাখা হলাে। জ্ঞানী ব্যক্তিরা এর উদ্দেশ্য অনুমাণ করে এ বিষয়ে নিজ নিজ মত ও মন্তব্য প্রকাশ করলে

প্রথম জন । মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধি এ পেয়ালা থেকেও উপাদেয়। আর মমতা এ চুল থেকেও সূক্ষ্ম। দ্বিতীয় জন। স্বর্গের পেয়ালা এ পেয়ালা থেকেও উত্তম। জান্নাতের মধুর স্বাদ এ মধুর চেয়েও উকৃষ্ট। আর পুলসিরাত এ চুল থেকেও সরু।

তৃতীয় জন।। মুমিনের অন্তর এ পেয়ালা থেকেও উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ। এ মধুর মিষ্টতার চেয়ে আল্লাহর কালামের মাধুর্য আরও উন্নত। আর হক হকুকের জ্ঞান এ চুল থেকেও সূক্ষ্মতম । চতুর্থ জন।। ইখলাসের পরিপাট্য এ পেয়ালা অপেক্ষা বেশি। উপাসনা-ধ্যান এ মধুর চেয়েও মধুরতর। আর পবিত্রতা ও ধর্মনিষ্ঠা এ চুলের চেয়ে সূক্ষ্মতর।

 সব শেষে মুখ খুললেন হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)। বললেন, মারেফাত বিদ্যা এ পেয়ালা থেকে বেশি স্বচ্ছ। আল্লাহর প্রেমের স্বাদ ও মধুর চেয়েও মধুরতর। আর আল্লাহর ভয় এ ফুল অপেক্ষা সরু ও তীক্ষ্ণ।

 বায়েজীদ বোস্তামী (র)  আল্লাহর আনুগত্য প্রসঙ্গে

১. আল্লাহর, আনুগত্য অক্ষুন্ন হলে মৃত্যুর পূর্বে মৃত্যুবরণ কর। . 

২. ক্ষুধার্ত থাকায় লাভ কি? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ক্ষুধার্ত থাকলে ফেরাউন আমি তােমাদের আল্লাহ' এই কথা বলার সুযােগ পেত না।

একজন বললাে, আল্লাহর আনুগত্যের ব্যাপারে মনে হয় অলৌকিক ক্ষমতাও অন্তরায়। যেমন, আপনি পানির ওপর হাঁটতে পারেন শূন্যে উড়তে পারেন, এক রাতে মক্কায় পৌছাতে পারেন। এগুলাে কি মনের মধ্যে অহঙ্কার সৃষ্টি করে না? তিনি বলেন, এ তােমার ভূল ধারণা। এক টুকরাে কাঠও পানিতে ভাসতে পারে। ক্ষুদ্র বালুকণাও বাতাসে উড়তে পারে। যাদুকরও একে রাতের মধ্যে হিন্দুস্তান থেকে বেলুচিস্তানে যেতে পারে। অতএব অলৌকিক শক্তি কী এমন বস্তু যে, তার দ্বারা অহমিকা সৃষ্টি হবে।

৩. আল্লাহর অনুগত্য লােকের কর্তব্য কি? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আল্লাহ ছাড়া অন্য দিকে মন না দেয়া।

৪. আল্লাহকে পাওয়ার পথ কি? তার উত্তর: অহম বা আমিত্ব বর্জন করা।

৫. তিনি বলেন, দু'টি জিনিস ধ্বংস ডেকে আনবে। (১) আল্লাহর সৃষ্টিকে সম্মান না করা (২)আল্লাহর অবদানকে স্বীকার না করা।

 ৬. আল্লাহ আপন ইচ্ছায় কি তার দাসদের জান্নাতবাসী করেন না?

তার উত্তর: হ্যাঁ, তা করেন বৈকি! তবে কথা হলো, আল্লাহ যাকে উচ্চস্তরে নিয়ে গেছেন, তার আর জান্নাতের দরকার কি?

 ৭. আল্লাহকে যারা পেয়েছেন, তারা জান্নাতের শােভা বর্ধন করেন ঠিকই। কিন্তু জান্নাত তাদের জন্য এক আযাব ছাড়া অন্য কিছু নয়

৮. আল্লাহ তার প্রিয়জনদের তিনটি স্বভাব দান করেন। (১) সমুদ্রতুল্য বদান্যতা, (২) সূর্যসম উদারতা ও (৩) ভূতলতুল্য নম্রতা।

৯, আল্লাহ যাকে যােগ্য ও উপযুক্ত মনে করেন, তার পেছনে এক ফেরাউন লাগিয়ে দেন।

১০. সৎ সংসর্গ সতকার্য থেকে উত্তম। আর কুসংসর্গ কুকার্য থেকে নিকৃষ্ট।

১১. গৌরব ও মর্যাদার লােভে যে বিদ্যালাভ করে তার থেকে দূরে থাকা কেননা, প্রতি মুহুর্তে আল্লাহর রহমত তাদের থেকে দূরে সরে যায়।

১২. মুসলমান হয়ে মুসলমানের ক্ষতি করা কঠিন পাপ কাজে লিপ্ত হওয়ার চেয়েও মারাত্নক।

১৩, মানুষের মনােভাব এরূপ হতে হবে যে, আমার মতাে খারাপ আর কেউ নেই। আমার কোন মূল্যেই নেই। এ ধরণের মনােভাব ত্যাগ-তিতিক্ষা জ্ঞানার্জন ও পুণ্যচর্চা থেকেও উত্তম।

 ১৪. জ্ঞান অর্জন করতে হবে জ্ঞানী ব্যক্তির কাছ থেকে।

১৫. মানুষ যদি নিজেকে চিনতে পারত তাে কত যে ভালাে হতাে! নিজেকে নিজে চিনতে পারলে পূর্ণ মারেফাত অর্জিত হয়।

১৬, দুনিয়ার এমন কী মহিমা আছে যে, মানুষ তাকে ভুলতে পারে না? আল্লাহর প্রেমিক যারা, দুনিয়াকে ভুলে যাওয়া তাদের পক্ষে মােটেই কঠিন নয়। 

১৭. যারা আল্লাহকে চেনে না, আগুন তাদের শাস্তি দেয়। কিন্তু যারা চেনে, আগুনের পক্ষে তার অসহ্য।

১৮. যে আল্লাহকে চিনেছে, কারাে কাছে তার কিছু চাইবার নেই। কিন্তু যে আল্লাহকে চেননি, সে অপরের মুখাপেক্ষী এবং মর্যাদাহীন।

১৯.পূর্ণমাত্রায় প্রয়াস ও প্রযত্ন করে আল্লাহর রহমতের ও পডর ভরসা রাখতে হবে।

 ২০, পার্থিব সম্পদের প্রতি লােভ করলেও) আকৃষ্ট হতে নেই। দুঃখ দুর্দশায় হতাশ হতে নেই। কেননা, আল্লাহর সামান্যতম নির্দেশে তা দূর হতে পারে।

সবাই বিস্ময় প্রকাশ করলে তিনি তাঁর কথার ব্যাখ্যা দেন যে, সক্তর বছর পর্যন্ত তিনি পার্থিব ঝামেলায় জড়িত ছিলেন। মাত্র গত চার বছর ধরে তিনি তার মা'বুদকে দেখছেন। অতএব ঐ বছর ছাড়া বাকি জীবনকে তিনি আয়ুর মধ্যে গণ্য করেন না।

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর দীদারে ইলাহীর স্বরূপঃ| হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) একদিন আল্লাহ পাককে স্বপ্নে দেখলেন। আল্লাহ্ জিজ্ঞেস করলেন, তােমার মনের ইচ্ছা কি? তুমি কি চাও? হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, প্রভু আমার! আপনার ও আমার ইচ্ছার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তখন প্রভু বললেন, তাহলে আমি যেমন তোমার, তেমনি তুমিও আমার হও। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, আপনার দিকের পথ আমাকে দেখিয়ে দিন। আল্লাহ বললেন, আমিত্ব বর্জন কর। পথ মিলে যাবে। তিনি প্রভুর নির্দেশ মেনে নিলেন।

অতঃপর তিনি একাগ্র চিত্তে তাঁর দিকে চোখ মেলে চাইলেন। আল্লাহ তাঁকে পর নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত করলেন। আলােকিত করলেন তার জ্যোতি দিয়ে। বহু গঢ় কথা তার কাছে ব্যক্ত করলেন। তার গরিমা ও শান-শওকত দেখালেন। তখন হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) তার নিজের দিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখলেন, আল্লাহ পাকের গরিমাময় ঐশ্বর্য আর আভিজাত্যের তুলনায় তাঁর নিজের গৌরণ অতি নগণ্য ও নিষ্প্রভ তুলনায় তার জ্যোতি ও অনুজ্জ্বল।

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এথ সম্মানও মর্যাদা তার প্রতিপালকের সম্মান ও মর্যাদার কাছে নিতান্ত হেয় প্রতিপন্ন হলাে। কিন্তু আরও গভীর দৃষ্টি নিয়ে দেখতে পেলেন যে, তাঁর নিজের  নূর তারই নূর থেকে, সম্মানও তারওই সম্মান থেকে। তিনিই তাে সবকিছুর উৎস। তিনি নিবেদন করলেন, প্রভু গাে, এ কী ব্যাপার? প্রভু বললেন, হ্যা তাই। সবকিছুই আমি এবং সবকিছুই আমার। আমি ও আমার ছাড়া কোন কিছু নয় ও কোনকিছুই নেই। শুধু কাজটি তােমার দ্বারা প্রকাশ পায় মাত্র। আর তা করার শক্তি, সাধ্য ও সফলতা আমার দ্বারাই ঘটে।

অতঃপর তাঁর প্রভু তাঁর অন্তদৃষ্টি ও বহিদৃষ্টি ঢেলে দিলেন। আর এ অবস্থায় তিনি তাঁর তৌহীদ রূপ প্রদর্শন করলেন। তখন হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) আমিত্ব বিসর্জন দিয়ে হৃদয়কে সঞ্জীবিত করলেন। এবার প্রভু খুব দয়া করে তার গুপ্ত তত্ত্বে তাকে প্রকাশ্য জ্ঞান দান করলেন। অর্থাৎ তার দীদার লাভে ধন্য হলেন। এবার তাঁর পার্থিব কামনা-বাসনা নির্মূল হলাে। আর এভাবে সবকিছুকে পরিহার ও পরাভূত করে তিনি কিছুদিন একা-একা কাটিয়ে দিলেন।

অতঃপর দয়াময় প্রভু তার প্রতি আরও দয়াপরবশ হলেন। তিনি তার নূর দিয়ে হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর চোখ করলেন। আর তা দিয়ে তিনি সমগ্র সৃষ্টিকে প্রত্যক্ষ করলেন।

তারপর তারই প্রদত্ত জ্ঞান করে তিনি তাঁরই কাছে নিবেদন করলেন, প্রভু গাে, আমি আপনাকে ছাড়া অবস্থান করব তা আমার কাম্য নয়, আমি আপন অস্তিত্বে সন্তুষ্ট নই। প্রভু আমাকে আপনি আমি ছাড়া করে রাখুন। প্রভু বললেন, তা উত্তম। কিন্তু শরীয়তের সীমা করে চল। আদেশ ও নির্দেশের সীমা লঙ্ঘন করাে না। তবেই তােমার সাধনা সফল হবে। তাঁর দাস বললেন, প্রভু, আমি তাে নিজেই কিছুই জানি না ও বুঝি না একেবারেই অজ্ঞ। আপনিই আমাকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করুন।

প্রভু প্রশ্ন করলেন, এ কথা তুমি কোথায় শিখলে? দাস উত্তর দিলেন, প্রশ্নকর্তাই তা বেশি জানে না। কেননা এ প্রশ্নও তাঁর। জবাবও তাঁর। ক্রমে ক্রমে মনে হলাে, প্রভু তাঁর ওপর খুশি হয়েছেন। তিনি দাসের মনে আনন্দের ঢেউ তুলে দিলেন। তারপর বলেন, তােমার মনে যে বাসনা রয়েছে তা প্রকাশ কর।

তাঁর উত্তর: প্রভু গাে, আমার বাসনা তা শুধুই আপনি। আমি কেবল আপনাকে চাই। আর কিছুই আমার কাম্য নয়। কিছুক্ষণ নীরব থেকে প্রভু বললেন, হ্যা, তুমি ঠিকই বলেছ। তুমি আল্লাহরই প্রত্যাশী। আর এ জনৌই দেখতে ও শুনতে পেলে।

দাস বললেন, তা আমার ক্ষমাতয় নয়। বরং তা প্রভু ইচ্ছায় ঘটেছে। তারপর তিনি তার মহান প্রতিপালকের প্রশংসা করলেন। 

এবার প্রভু তাকে তাঁর গৌরবের পাখা দান করলেন। মাথায় পরিয়ে দিলেন গৌরকবের তাজ। আর গৌরবের আকাশে উড়তে লাগলেন। আর প্রভুরই সাহায্যে তার অপূর্ব গুণাবলী অবলােকন করলেন। তিনি এবার তার একত্বের দুয়ার খুলে দিলেন। আর তাঁর দপ্তরে দাসের নামও নথিবদ্ধ করলেন। আর এবার তার কাছে প্রভুর তৌহীদ আবিষ্কৃত হলাে।

অতঃপর তার প্রতিপালক বললেন, এখন আর কেউ তােমার ভেতরে আমিত্বের লক্ষণ দেখবে না। তারপর এক পরীক্ষার আগুনে পুড়িয়ে পবিত্র করে তিনি তাঁর দাসকে জিজ্ঞেস করলেন, এ দুনিয়া কার? বল এ রাজত্ব কার দাস বলবেন, আপনার  বল, ক্ষমতা কার? সবই আপনার।

অতঃপর দাসকে পরিয়ে দেয়া হলাে ধৈর্যের পােশাক। আর এর ফলে দাস মানবীয় স্বতাব মুক্ত হলেন। আর অর্জন করলেন তৌহীদের জবান। মনে হলাে তার আল্লাহর রহমতের প্রশংসাতে তার চোখ আল্লাহর অনুপম সৌন্দর্য রাশিতে এবং তার হৃদয় আল্লাহর অনির্বচনীয় আলােকমালায় রূপান্তরিত হলাে। 

এখন তার দৃষ্টি সসীম নয়, অসীমের পানে প্রসারিত। তিনি এখন চিরঞ্জীব। তাঁর আর মৃত্যুর আশঙ্কা নেই। এখন তিনি আর নিজে চলেন না। নিজে উপাসনা করেন না। সবকিছু অনুষ্ঠিত হচ্ছে মহিমময় প্রভুর ইশারা-ইঙ্গিতে। তিনি কেবল উপলক্ষ মাত্র।

অতঃপর তিনি তাঁর প্রতিপালককে বললেন, হে প্রভু, আমি তাে এখন আপনার দরবারেরই অধিবাসী। প্রতিপালকে বললেন, কিন্তু মানুষ যা তােমাকে দেখতে চাই। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, কিন্তু আমি তাে তাদের দেখতে চাই না। তবে আপনি যদি আমাকে যদি থাকতে হয়, তাহলে তারা যেন আপনার গুণাবলি আমার মধ্যে দেখতে পায়। বিশেষ করে আপনি আপনার তৌহিদ দিয়ে আমাকে সাজিয়ে দিন। লােকে আমার দিকে তাকিয়ে যেন আপনাকেই দেখে।

আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা মজ্ঞুর করে তাঁর মাথায় মর্যাদার তাজ পরিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, এবার আমার সৃষ্টির নিকটে এস। তিনি দরবার থেকে পা বাড়ানাে মাত্র একটা আছাড় খেলেন। তখন প্রভু বললেন, তােমরা আমার বন্ধুর অবস্থা দেখ। সেই আমাকে ছাড়া কিছুই জানে না, কিছুই বােঝে না। আমার পথ ছাড়া তার অন্য কোন পথ জানা নেই। 

তিনি দরবেশগণের শেষ সীমানায় উপনীত হয়ে নিজেকে নবী-রাসূলগণের পংক্তির কাছাকাছি দেখতে পেলেন। তারপর ক্রমশ তিনি আল্লাহ পাকের এত কাছাকাছি পৌঁছালেন যে মনে হল, এত কাছে আর কোন মানুষ পৌঁছায়নি। তখন গভীর দৃষ্টি মেলে দেখলেন, তার মাথা রয়েছে আল্লাহর এক নবীর পায়ের নীচে। তখন তিনি বুঝলেন, আউলিয়াদের মর্যাদার শেষ সীমা হতে নবী-রাসূগণের মর্যাদা শুরু।

অতঃপর তার আত্মাকে যখন ফেরেশতা ও জান্নাত-জাহান্নাম দেখানাের উদ্দেশ্য একদিকে আহবান করা হলাে। তখন নবী-রাসূলগণের সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাৎ হয়ে গেল। তিনি তাদের প্রত্যেককে সালাম জানালেন। সবশেষে পৌছালেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর পবিত্র আত্মার কাছে। কিন্তু সেখানে রয়েছে অসংখ্যা অগ্নি-সমুদ্র। ভয়ে তার পা বাড়াবার সাহস হলাে না। তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়ে গেলেন। প্রভুর দীদার লাভ হলাে বটে। 

কিন্তু তৌহীদের প্রাপ্তর অতিক্রম করে রাসূলে করীমের নিজস্ব দরবারে আর পৌছানাে গেলাে না। আল্লাহর নিজস্ব দরবারেই রাসূলে করীমের শিবির দৃষ্টিগােচর হলাে। প্রবল বাসনা থাকা সত্ত্বেও তিনি সেদিকে আর অগ্রসর  হতে পারলেন না। প্রচণ্ড ব্যথা পেলেন মনে। এতদূর এসে ও শেষ অবধি ওদিকে আর যাওয়া হলনা। প্রচুর কাছে এ দুঃখের কথা তিনি প্রকাশ করলেন। প্রভু বললেন, ওদিকে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে যদি যেতে চাও, তাহলে আমার প্রিয় বন্ধু হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সুন্নত ও তরীকা মজবুত কর।

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) এর মােনাজাতঃ 

জীবনের অন্তিম পূর্বে হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বড় করুণ সুরে তাঁর প্রতিপালকের দরবারে মােনাজাত করেন। অত্যন্ত মর্মর্ম্পর্শী সে মােনজাত নিম্নরূপ। প্রভু আমার! আর কতদিন আপনি আর আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকব? আমার আমিত্ব দূরে করে দিন প্রভু। তবেই আমি আপনার মধ্যে বিলীন হতে পারব। প্রভু গো, আমি যখন আপনার সঙ্গে থাকি। তখন আমি সকলের শীর্ষে অসীম ও প্রবল হয়ে বিরাজ করি। কিন্তু আমি যখন একা, তখন আমি অধম-সসীম ও দুর্বল হয়ে থাকি।

প্রভু গাে, আপনারই অসীম কুদরতে দারিদ্র ও ক্ষুধা আমাকে আপনার নিকটবর্তী করেছে। হে মাবুদ! জ্ঞানী-গুণী হওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। আপনার যদি ইচ্ছা হয়, তাহলে আপনার প্রিয়জনের তালিকায় আমাকে নাম অন্তর্ভূক্ত করে আপনার গােপন রহস্যের প্রাণ দান করুন।

হে প্রভু, আমার আশান্ত হৃদয়ে আপনার বাণী যে কত মধুর, পাপীদের প্রতি আপনার আশ্বাস যে কত সান্ত্বনা, আর অচেনা-অজানা পথে আপনার জ্যোতি যে কত উজ্জ্বল আর আশাব্যজ্ঞক, পার্থিব জীবনবাদীরা তার কিছুই বুঝতে পারে না।

প্রভু, আমি আপনার এক অন্ধপ্রেমিক। আমি দুর্বল, অনাথ ও মুখাপেক্ষী। আশ্চর্য এ যে, মহাপরাক্রমশালী অধীশ্বর হওয়া সত্ত্বেও আপনি এ হীন অভাজনকে প্রেম দান করেন। 

প্রভু গাে, আমি আমার জীবনব্যাপী সাধনা কিংবা গভীর রজনীর নামাজের কথা বলছি না। কুরআন পাকের খতম-সমূহের হিসেব করছি না। দরুদ ও মােনাজাতের কথা উল্লেখ করছি না। আপনি ভালােভাবেই জানেন, আমার এতটুকু নির্ভরতা, বিশ্বাস বা গৌরব নেই। তবে এসব আমি উল্লেখ করছি এজন্য যে, আমার কৃতকর্মের জন্য আমি খুবই লজ্জিত। 

প্রভু আমার! আপনার অন্তহীন করুণার কথা কিভাবে বললাে! ঐ কৃপাগুণেই আমি এরূপ ভাবতে পারছি। না হলে আমার যে সবই ব্যর্থ হয়ে যায়।

প্রভু গাে, আপনার কোন কাজই কোন কারণের অধীন নয়। আর উপাসনাই আপনার সমীপে উপস্থিত হওয়ার সম্বল নয়। আর পাপীরা যে আপনার দরবারে স্থান পাবে না, তা-ও কোন কথা নয়। আপনার কুদরত অপরিসীম, অন্তহীন। যাকে ইচ্ছা পাপ-সমুদ্রে ডুবে থাকলেও ক্ষমা দ্বারা তাকে পবিত্র করেন।

ওগাে দয়াময়, আমার আমলকে খুব বেশি মূল্যে ও গুরুত্ব দিয়ে আমি তাতে লিপ্ত হয়েছি। কিন্তু এখন আমার মনে হয়, তার মূল্যে আপনার মর্জির ওপরে। আমার আবেদন এই যে, আমার যে আমলগুলি আপনার দরবারে অনুপযুক্ত সেগুলিকে বাতিল করে আমার ওপর দয়া বর্ধণ করুন। আর আমার পাপের ময়লাও ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে দিয়ে আমাকে নিষ্কলুষ করুন-যাতে আমার আমলসমূহ আপনার দরবারে উপযুক্ত হয়।

হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর ইন্তেকালের পূর্বক্ষণহযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বােস্তামী দীর্ঘজীবী ছিলেন।আজীবন মাৱেফাতের গভীর গহীন পথে দুরহ সাধনায় লিপ্ত হয়ে অবশেষে একদিন প্রিয় মাশুকের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য উন্মুখ হয়ে পড়েন। আর মাশুকও তাঁর পরম প্রিয়জনকে নিজের কাছে নেবার জন্য ডাক পাঠালেন। আর সে ডাকে সাড়া দিয়ে তিনিও তার অগণিত শুভানুধ্যায়ীদের পেছনে ফেলে রেখে ১৩৪ হিজরী সনে মাটির পৃথিবী ছেড়ে লাব্বায়েক বলে তার কাছে চলে গেলেন।


শােনা যায়, মৃত্যু আসন্ন হলে আল্লাহু আল্লাহু বলে তিনি যিকিরে মগ্ন হন। একেবারে চরম মুহুর্তে উচ্চারিত হয় এ আন্তরবাণী:

হে প্রভু, আজীবন আমি আপনার স্মরণ করেছি উদাসীনভাবে। আর এখন, এ শেষ মুহুর্তেও এমি আপনার উপাসনা থেকে উদাসীন রয়েছি। আমি চরম অকৃতজ্ঞ। জানি না, আপনার সঙ্গে মিলিত হবার যােগ্য করে আমি বিবেচিত হব কিনা। তিনি যখন এই শেষ প্রার্থনা উচ্চারণ করছেন, তখন তার পবিত্র আত্মা ধীরে ধীরে তাঁর পার্থিব দেহ থেকে বিদায় নিচ্ছিল।

 হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র)-এর ইন্তেকাল 

রজনীতে তাঁর জিয় শিষ্য হযরত আবু মুসা (ক) অন্যত্র ছিলেন। তিনি স্বপ্নে দেখলেন, আল্লাহর আরশ মাথায় নিয়ে হযরত বায়েজীদ বােস্তামী ) আসমানে ঘুরছেন। পরদিন ভােরেই স্বপ্নের তাপর্য জানার জন্য তিনি মুরশিদের উদ্দেশে রওনা হন। গিয়ে দেখেন, তাঁর মরদেহ নিয়ে লােকজনেরা কবরস্থানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আর এই দৃশ্য দেখে তিনি ছুটে গেলেন লাশবাহী খাটে। কাঁধ লাগাতে। কিন্তু কাদ লাগাবার মতাে সামান্যতম জায়গা পেলেন না। তখন তিনি ঢুকে পড়লেন খাটের তলায়। আর খাটের সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে হাঁটতে লাগলেন।

এতক্ষণ ধরে স্বপ্নের কথা তার স্মরণে আসেনি। হঠাৎ তা মনে পড়ল। আর তখন মাথায় খাট নিয়ে চলতে চলতেই তিনি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। আর ঐ অবস্থায় দেখলেন, হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (র) বললেন, তুমি গতরাতে যে স্বপ্ন দেখেছিলে, এই ঘটনাই তার ব্যাখ্যা।

আবু মুসা (রাঃ) অবাক বিস্ময়ে সরবে বলে উঠলেন, সুবহানাল্লাহ! সবাই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালেন। তিনি তাদের মনােভাব বুঝতে পেরে বললেন, এইমাত্র হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (রাঃ) স্বয়ং হাজির হয়ে আমার সঙ্গে কথা বলে গেলেন। আর এক ব্যক্তি তাকে স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞেস করেন, তাসাউফের অর্থ কি? তিনি তৎক্ষণাৎ বলেন, আরাম-আয়েশ বর্জন করে দুঃখ-কষ্ট বরণ করাই তাসাউফ। 
তাঁর এক শিষ্য স্বপ্নের মধ্যে তাকে অনুরােধ করেন, দয়া করে আপনি আপনার কবরের ঘটনা বলুন হুজুর। তিনি বলেন, মুনকীর নকীর এসে জিজ্ঞেস করল, আল্লাহকে আপনি প্রভু বলে স্বীকার করেন কি না? আমি বললাম, আপনাদের এ প্রশ্নের জবাব দ্বারা আপনাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না। 

কেন না, আমি অসংখ্যবার তাকে আমার প্রভু বলে স্বীকার করলেও তিনি যদি আমাকে তাঁর দাস বলে গ্রহণ না করেন, তাহলে আমার স্বীকৃতিতে কী লাভ হবে? আপনারা বরং ফিরে গিয়ে তাঁকেই জিজ্ঞেস করুণ, আমাকে তিনি তাঁর বান্দা বলে স্বীকার করেন কি না। আর গ্রহণযােগ্য হলে তাে তাঁর কথাই আমার কথা।

একথা শুনে তারা তখনই চলে যান। তাঁদের তরফ থেকে আমার ওপর আর কোন বিষয় দেখা দিল না। বর্তমানে বাংলাদের চট্টগ্রামে তার প্রতীক মাজার অবস্থিত। আসলে তার দাফন কোথায় হয়েছে তা অজ্ঞাত রয়েছে।

আরও পড়ুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ