নতুন পোস্ট

6/recent/ticker-posts

হযরত বিশরে হাফী (রঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী বাংলা

 


হযরত বিশরে হাফী (র) জীবনী

হযরত বিশরে হাফী (র) পূর্বে ছিলেন একজন মদ্যপায়ী লােক। দিনরাত পড়ে থাকনে বেহুঁশ হয়ে। একদিন মত্ত অবস্থায় পথ চলতে চলতে রাস্তায় ওপর এক টুকরাে কাগজ পড়ে থাকতে দেখলেন। কাগজে লেখা ছিল বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। দেখামাত্র তিনি কাগজখানি খুব যত্ন করে তুলে নিলেন। নিয়ে গেলেন বাড়িতে। আর ধুলাে-ময়লা সাফ করে, আতর মাখিয়ে সেটি রেখে দিলেন বাড়ির কোন উঁচু জায়গায়। পবিত্র কালামকে রক্ষা করলেন পরম ভক্তি ভরে।

আর ঐ রাতেই এক দরবেশ স্বপ্ন দেখলেন। আল্লাহ তাকে বলছেন, তুমি বিশরে হাফীকে বলাে, সে যেমন আমার নামের সম্মান দিয়ে উঁচু জায়গায় রেখেছে, তেমনি আমিও তার মনকে পূণ্য সুবাসিত পবিত্র করব। আমার মধ্যে তাকে গ্রহণ করে তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেব।

দরবেশ বড় সংশয়ে পড়লেন। স্বপ্ন স্বপ্নই । নাকি সত্যিই এর কোন অর্থ গৃঢ় ইঈিত আছে। বিশরে হাফীর মতাে একটা মাতালের কি এমন সৌভাগ্য হবে যে, স্বয়ং আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেবেন। সন্দেহমুক্ত হওয়ার জন্য তিনি দুরাকায়াত নামায পড়ে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লেন। আর আবারও অনুরূপ স্বপ্ন দেখলেন। পর পর তিনবার-একই স্বপ্নাদেশ পেলেন তিনি। তখন আর কোন সন্দেহ রইল না। তিনি বেরিয়ে পড়লেন বিশরের সন্ধানে। ভােরবেলাতেও তাঁকে বাড়িতে পাওয়া গেল না। 

বাড়িতে লােক জানান, তিনি শরাবখানায় আছেন অগত্যা দরবেশকে যেতে হল শরাবের আডডায়। শুনলেন, সত্যিই তিনি বেহুশ হয়ে পড়ে আছেন। একটি লােককে ডেকে দরবেশ বললেন, বিশরে হাফী (র)-কে বল, আমি তাকে একটি সুখবর দিতে এসেছি। ততক্ষণ প্রকৃতিস্থ হয়েছেন। বিশরে হাফী (র)। সুখবরের কথা শুনে জিজ্ঞেস করলেন, কার কাছ থেকে সুখবর এনেছেন? দরবেশ বললেন, আল্লাহর কাছ থেকে। আল্লাহর কাছ থেকে? বুক কেঁপে উঠল বিশরে হাফী (র)-এর। কঁকিয়ে উঠলেন তিনি। সংবাদটি সত্যই শুভ না অশুভ? দরবেশ তাঁকে কাছে ডেকে স্বপ্নের বৃত্তান্ত খুলে বললেন।

যেন তাঁর বুকের তল থেকে বেরিয়ে এল অন্য এক বিশরে হাফী (র)। মাতাল বন্ধুদের সম্বোধন করে বলে উঠলেন-বন্ধগণ, চললাম। তােমরা আমাকে আর তােমাদের সঙ্গে পাবে না। সেদিনই তওবা করে, লােকালয় ছেড়ে চলে গেলেন নিবিড় নির্জনে। আর আল্লাহর উপাসনায় আত্মসমাহিত হলেন। পরবর্তীকালে শরীয়তে সুপণ্ডিত হিসেবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। আর মারেফাতে দীক্ষা গ্রহণ করে তার মামা আলী ইবনে হাশরাশের কাছে। তাঁর জন্ম মারভ নগরে। অবশ্য বসবাস করেছেন সুবিখ্যাত বাগদাদ শহরে। 

হাফী শব্দের অর্থ নগ্নপদ। আল্লাহর ভয়ে তিনি এতদূর ভীত হন যে, জুতাে পরা ছেড়ে দেন। আজীবন খালী পায়ে চলাফেরা করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রথম যেদিন আমার প্রভুর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপিত হয়, সেদিন আমি খালি পায়ে ছিলাম। তাই এখন জুতাে পরতে আমার লজ্জাবােধ হয়। তিনি আরও বলেন, আল্লাহ আমাদের জন্য মৃত্তিকাকে বিছানা বানিয়ে দিয়েছেন। অতএব আল্লাহ পেতে দেওয়া বিছানার ওপর জুতাে পায়ে চলা আমার কাছে বেআদবি মনে হয়। 

একশ্রেণীর তাপস মাটির টুকরাে দিয়ে ইস্তেজ্ঞা করতেন না। মাটির ওপর থুতুও ফেলতেন না। কেননা জমিনের ওপর সর্বত্রই তারা আল্লাহর নূর দেখতে পেতেন। হযরত বিশরে হাফী (র) ছিলেন এই শ্রেণীর সাধক। কেউ কেউ বলেন, সাধকের চোখও আল্লাহর নূর স্বরূপ। কেননা, সে চোখ দিয়ে তারা আল্লাহ ছাড়া আর কোন কিছুই দেখতে পান না। রাসূলুল্লাহ (স) তাঁর সাহাবাগণের জানাযার পেছনে যাওয়ার সময় দু'পায়ের বুড়াে আঙুলের ওপর ভর দিয়ে চলতেন। বলতেন, ফেরেশতাগণের পালকের ওপর পা ফেলতে ভয় হয়। যেহেতু তারা আল্লাহর নূর ছাড়া কিছু নয়। 

প্রখ্যাত হাদীস ও ফিকাহবেত্তা ইমাম আহমেদ ইবনে হাম্বল (র) প্রায় হযরত বিশরে হাফীর (র) দরবারে যেতেন। ইমাম আহমেদ হাম্বলের (র) অনুগামীরা অনুযােগ করতেন, আপনার মতাে একজন মহাপ্রাজ্ঞ ব্যক্তির পক্ষে বিশরে হাফীর (রাঃ) কাছে যাওয়া কি মর্যাদাহানিকর নয় ইমাম উত্তর দেন, হাদীস বা ফিকাহ শাস্ত্রে হয়তাে তার চেয়ে আমার জ্ঞান বেশী। কিন্তু তিনি আল্লাহকে আমার চেয়ে অনেক বেশী চেনেন। বস্তুত তিনি তাঁর কাছে আল্লাহর বিষয়েই জানতে চাইতেন। 

হযরত বিশরে হাফীর (র) চিন্তামগ্নতা বিস্ময়কর। রাতের বেলায় বাড়িতে ঢুকছেন। এক পা রেখেছেন ভেতরে, অন্য পা বাইরে। একটা কিছু ভাবতে গিয়ে ঐ অবস্থায় রয়ে গেলেন সারারাত। বােনের বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন। কী একটা কথা মনে এল। আর তা নিয়ে চিন্তা করতে করতে আর সিঁড়ি টপকানাে হল না। ওখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন। ভোর রাতে যখন ফজরের আজান হলাে, তখন চলে গেলেন মসজিদে নামায আদায় করতে। 

তার ভাবনার কথা জানতে চাইলে তিনি তার বােনকে বললেন, বাগদাদ শহরে বিশর নামে আরও কয়েকজন লােক আছে। একজন ইহুদি, একজন খ্রীস্টান ও একজন অগ্নিপূজক। এদিকে আবার তার নাম বিশর। আর তিনি মুসলমান। আল্লাহ তাকে ইসলাম ধর্মের মতাে মহাসম্পদ দান করেছেন। আর অন্য খ্রীস্টান ও একজন ইসলাম ধর্মের মতাে মহাসম্পদ দান করেছেন। আর অন্য বিশরগণ তা থেকে বঞ্চিত তিনি কত সৌভাগ্যবান। আর ওরা কত হতভাগ্য। এ কথা ভাবতে গিয়ে তার এ অবস্থা।

একবার হযরত বেলাল খাস (র) হযরত খিজির (আ)-কে স্বপ্নে দেখেন। তিনি তিনজন বিখ্যাত মানুষ সম্পর্কে হযরত খিজিরের (আ) অভিমত জানতে চান। এই তিনজনের একজন ছিলেন হযরত বিশরে হাফী (র)। অন্য দুজন হলেন দুই দিকপাল-ইমাম শাফী (র) ও ইমাম হাম্বল (র)। 

ইমাম শাফীকে শীর্ষস্থানীয় আওলিয়া বলে তিনি মনে করেন। ইবনে হাম্বল (র) সম্পর্কে বলেন, তিনি একজন সত্য-সন্ধিৎসু। আর বিশরে হাফী সম্বন্ধে তাঁর মন্তব্য, তিনি সমকালের অদ্বিতীয় ব্যক্তি। হযরত বিশর হাফী (র)-এর হাদীস বিষয়ে যথেষ্ট বুৎপত্তি ছিল। কিন্তু জীবনে কোনদিন হাদীস বর্ণনা করেননি। তার কারণ হিসেবে বলেন, আমার অন্তরে মর্যাদা ও খ্যাতি লাভের বাসনা না থাকলে আমি অবশ্যই হাদীস বর্ণনা করতাম ।


বাগদাদ শহরে বৈধ-অবৈধ খাদ্যের ভেদবিচার নেই। বরং অবৈধ খাদ্যের চলই বেশি। এরকম প্রশ্ন তুলে কিছু লােক হযরত বিশরে হাফী (র)-এর কাছে জানতে চান, তিনি কোথা থেকে খাদ্য সংগ্রহ করেন। তিনি জবাব দেন, আপনারা যেখান তেকে সগ্রহ করেন, সেখান থেকেই।

তাহলে আপনি এত উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হলেন কিরূপে? খুব অল্প আহার ও কম বন্ধুত্ব স্থাপনের মাধ্যমে। তিনি বলেন, যে বেশি খায়, বেশি হাসে, আর যে কম খায় আর বেশি কাদে-এরা উভয়ে কি সমান? তাঁর বক্তব্য, হালাল খাবারও খুব বেশি খাওয়া উচিত নয়। কেননা, তাতে বাজে খরচের দোষ ঘটে।

তাঁর সম্পর্কে বলা হয়, মাঝে মাঝে ইচ্ছে জাগলেও তিনি চল্লিশ বছর ধরে একটানা ছাগ-মাংসের কোল দিয়ে রুটি খাননি। কখনও কখনও থেতেন শুধু সবজি ও আনাজের ঝোল। আর সরকারি কুপের পানি পান করতেন না।

প্রচণ্ড শীতে খালী গায়ে তিনি ঠক ঠক করে কাঁপতেন। এত কষ্ট বরণ করছেন কেন, জিজ্ঞেস করলে বলতেন, গরিব-দুঃখীদের অর্থ সাহায্য করবেন, এমন সংগতি তাে তার নেই। তাই তাদের কষ্ট সরাসরি নিজের বরণ করে তিনি তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করার চেষ্টা করছেন মাত্র।

আহমদ ইবনে ইব্রাহিম (র) তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, একদিন তাঁকে তিনি হযরত মারুফ (র)- এর নিকট খবর পৌছে দিতে বললেন যে, ফজরের নামাযের পর তিনি তাঁর কাছে যাবে। আহম্মদ ইবনে ইব্রাহিম (র) হযরত মারুফ (র)-এর কাছে খবরটা পৌছে দিলেন। তার খানকাহ শরীফ ছিল মসজিদের কাছে তাইগ্রীস নদীর তীরে। তারা দুজনেই ফজর থেকে শুরু করে এশা পর্যন্ত সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করলেন। কিন্তু বিশরে হাফী (র) এলেন না। তাদের মনে খটকা লাগল। তাঁর মতাে লােকও কি কথার খেলাপ করে! হঠাৎ তাঁরা দেখেন, বিশরে হাফ (র)

মসজিদের মেঝে থেকে জায়নামায গুটিয়ে নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছেন। তারপর হযরত মারুফ (র) এর সঙ্গে একত্রে নদীর ওপর জায়নামাজ বিছিয়ে দুজনে সারারাত গােপন কথাবার্তায় কাটিয়ে দিলেন। ভােরবেলায় আহমদ ইবনে ইব্রাহিম (র) যখন চলে যাচ্ছেন, তখন হযরত বিশরে হাফী (র) খপ করে তার হাত চেপে বললেন, তিনি যেন তাঁর জীবিতকালে এই গােপন ব্যাপারটি কারােও কাছে প্রকাশ না করেন। হযরত বিশরে হাফী (র)-এর জীবিতবস্থায় তিনি সত্যিই এ কথা কাউকে বলেননি। 

এক আলােচনা সভায় নানা কথা ফাকে একজন হযরত বিশরে (র)-কে বললেন, খুব গােপনে কারাে কাছে কিছু নিয়ে তা যদি গরিব-দুঃখীদের দান করেন তাে ক্ষতি কী? কথাটি মােটেই ভালাে লাগল না হযরত বিশরে হাফী (র) -এর। কিন্তু তার ওপর বিরক্ত না হয়ে সামান্য হেসে বললেন, তিন ধরনের গরীব লােক আছে। যেমন, 

(১) যে কখনও কিছু চায় না। এবং কেউ কিছু দিলেও নেয় না। আসলে এ শ্রেণীর গরিব লােক আত্মিক শক্তিসম্পন্ন। আল্লাহর দরবারে কিছু প্রার্থনা করলে তারা তা পেয়ে যায়। 

(২) কিছু গরিব আছে, যারা কখনও কিছু চায় না বটে, কিন্তু কেউ যদি নিজে থেকে কিছু দেয়, তাে তারা নেয়। এরা মােটামুটি মাঝারি ধরনের নির্ভরশীল। এরা জান্নাতের যাবতীয় প্রাচুর্য উপভােগ করবে। 

(৩) আরও এক শ্রেণীর গরিব লােক আছে, যারা যথাসাধ্য চেষ্টা করে প্রবৃত্তিকে দমন রাখে। আর সদা-সর্বদা আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকে।

একটি নির্জন ঝরনার ধারে বসেছিলেন হযরত আলী জুরজানী (র)। ঘটনাচক্রে সেখানে এসে পড়েন হযরত বিশরে হাফী (র) । আর তাকে মানুষের মুখ দেখতে হল-এজন্য তিনি আত্মগােপনের চেষ্টা করলেন। কিন্তু হযরত বিশরে হাফী (রঃ) ও তাঁর পেছনে পেছনে ছুটলেন। 

বারবার বলতে লাগলেন, দয়া করে আমাকে কিছু উপদেশ দিয়ে যান। তখন হযরত জুরজানী (র) তাকে বললেন, গরিব-দুঃখীকে ভালােবাসাে। ধৈর্য ধারণ কর। প্রবৃত্তিকে শত্রু মনে কর। প্রবৃত্তি যা চায়, তার বিপরীত কাজ কর। আর নিজের বাড়িখানাকে কবরের চেয়েও মালপত্র মুক্ত রাখাে। তাহলে দুনিয়া ছেড়ে যাবার সময় কোনরকম কষ্ট পেতে হবে না।


একবার তার হজ্জযাত্রার সঙ্গী হবার জন্য কিছু লােক আগ্রহ প্রকাশ করল। তিনি তাদের তিনটি শর্ত দিলেন। যথা, (১) কেউ পাথেয় নেবে না, (২) পথে কেউ কারাের কাছে কিছু চাইবে না। আর (৩) নিজে থেকে কেউ কিছু দিলেও তা নিতে পারবে না। তারা বললাে, প্রথম প্রস্তাব দুটি গ্রহণ করা যেতে পারে, কিন্তু তৃতীয়টি চলবে না। 

তখন হযরত বিশরে হাফী (র) বললেন, আল্লাহর প্রতি নিভরতাই হজযাত্রীদের পাথেয়। তোমরা যদি কারও কাছ থেকে কিছু নেবে না বলে প্রতিজ্ঞা কর, তাহলে তাতে আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা প্রমাণিত হয়। আর এর দ্বারা বেলায়াতের দরজাও অর্জিত হয়। হযরত খিজির (আ)-এর সঙ্গে হযরত বিশরে হাফী (র)-এর একবার দেখা হয়। বাইরে থেকে এসে নিজের বাড়িতেই তিনি তাকে দেখতে পান। তার কাছে প্রার্থনা করলে খিজির (র) বলেন, আল্লাহ তােমার উপাসনা সহজ করে দিন। আর তা গােপন রাখুন।

একদিন একটি লােক বললাে, আমার কাছে এক হাজার দিরহাম আছে। আমি হজ্জে যেতে চাই। হযরত বিশরে হাফী (র) বললেন, এ টাকা দিয়ে কোন দেনাদার লােকের দেনা শােধ করে দাও। আর কোন গরিব অভিভাবককে সংসার চালানাের খরচ বাদ দিয়ে দাও। তাহলে তুমি হজ্জের চেয়েও বেশি পুণ্য অর্জন করবে। কিন্তু হজ্জের যাওয়ার যে খুব আমার ইচ্ছে, লােকটি বলে। তখন হযরত বিশরে হাফী (র) বললেন, তুমি নিশ্চয় নিষিদ্ধ উপায়ে এ টাকা উপার্জন করেছ। এজন্য অধিক পূণ্যার্জনে তােমার তেমন আগ্রহ নেই। 


একবার তিনি এক কবরস্থানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। দেখলেন, মৃত ব্যক্তিরা কী একটা জিনিস নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। এর রহস্য জানার জন্য তিনি আল্লাহর দরবারে মােনাজাত করলেন। তখন অদৃশ্য আওয়াজ এল, মৃত ব্যক্তিদেরই জিজ্ঞেস কর। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, সাতদিন আগে কোন একটি লােক কবরখানার পাশ দিয়ে যাবার সময় সূরা ইখলাস পাঠ করে মৃতদের আত্মার উদ্দেশ্য উৎসর্গ করে। আর সে সওয়াব আজ সাতদিন ধরে তারা নিজেদের মধ্যে বন্টন করে নিয়ে এখনও শেষ করতে পারেনি।

হযরত বিশরে হাফী (র) এর স্বপ্নঃ হযরত বিশরে হাফী (র) রাসূলে করীমকে স্বপ্ন দেখেন। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি বলতে পারেন, আপনার কালের সাধক-জ্ঞানীদের মধ্যে আপনার মর্যাদা সবচেয়ে বেশি করা হল কেন? হযরত বিশরে হাফী (র) উত্তর দেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তা বলতে পারব না। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, আপনি জ্ঞানী ব্যক্তিদের সম্মান প্রদর্শন করার নীতি পালন করছেন। মুসলিমদের সৎ পথে পরিচালিত করছেন। 

আমার আসহাব ও আহলে বাইতকে ভালবাসেন। এই কারণে আল্লাহ আপনার এত মর্যাদা দিয়েছেন। পরে তিনি যখন আবার রাসূলুল্লাহ (স) কে স্বপ্নে দেখেন, তখন তাঁর কাছে কিছু উপদেশ প্রার্থনা করেন। রাসূলে করীম (স) বলেন, পুণ্যার্জনের জন্য ধনী ও আমীরগণের ফকীর-দরবেশদেরকে সেবাযত্ন করা প্রশংসনীয় সন্দেহ নেই। কিন্তু গরিবদেরকে ধনী ও আমীরদের কাছে হাত না পেতে কেবল আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা উত্তম।

হযরত বিশরে হাফী (র)-এর উপদেশঃ হযরত বিশরে হাফী (র) বেশ কিছু মূল্যবান কথা বলে গেছেন। যেমন,

 (১) তােমরা তােমাদের অর্থ ও জ্ঞান খরচ করবে। নিয়ম হলাে, পানি অচিরেই নষ্ট হয়ে যায়।

(২) যে ব্যক্তি এ জগতে সম্মানিত হতে চায়, তার তিনটি বস্তু থেকে দূরে থাকা প্রয়ােজন। তাহলে; (ক) কোন সৃষ্ট বস্তুর মুখাপেক্ষী হওয়া (খ) কারও দোষ খোঁজ (গ) নিমন্ত্রণ ছাড়া কারও অতিথি হওয়া।

(৩) পার্থিব যশ-খ্যাতি যার কাম্য সে পারলৌকিক স্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকে। লােকের কাছে সুবিদিত হওয়ার বাসনা পার্থিব আসক্তির মূল কারণ। 

(৪) যে পর্যন্ত তুমি ও তােমার রিপুর মধ্যে একটি পাঁচিল দাঁড় না করাবে, সে পর্যন্ত তুমি ইবাদতের স্বাবলাত থেকে বঞ্চিত হবে।

(৫) তিনটি কাজ খুব কঠিন। (ক) অভাবে দান করা। (খ) ভীত অবস্থায় সততা রক্ষা করা এবং (গ) নির্জনে ধর্মনিষ্ঠা বজায় রাখা। 

(৬) সন্দেহজনক বস্তু থেকে পরহেজ করা ও মনকে সদা নিয়ন্ত্রণে রাখাই পরহেজগারী।

(৭) আল্লাহ তাঁর দাসকে ধৈর্য ও মারেফাতের চেয়ে বড় কোন বস্তু দান করেননি। মারেফাতপন্থীরাই আল্লাহর প্রকৃত দাস। যিনি তাঁর প্রতিপালকের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্তরকে পরিচ্ছন্ন রাখেন, তিনিই সুফী-সাধক। আর মারেফাতপন্থী সেই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ জানে না, চেনে না এবং সম্মান দেয় না। যে সরল অন্তঃকরণে ও সততার সঙ্গে আল্লাহর ধ্যানে রত হয়; সে নিগ্রহ ভােগ করে।

হযরত বিশরে হাফী (র) বলেন, আমি কখনও দুনিয়াদারের কাছে বসা বা তাদের সঙ্গে সংসর্গ স্থাপন করা পছন্দ করি না। কোন লােক হযরত বিশরে হাফী (র)-এর সামনে বলেন, আমি আল্লাহর ওপর নির্ভর করলাম। লােকটির কথা শুনে তিনি বললেন, তুমি অসত্য কথা উচ্চারণ করলে। তােমার বাক্য যদি সত্য হতাে, তাহলে তিনি যা করতেন তাতেই তুমি খুশি থাকতে।

তিনি আরও বলেন, যদি কোন ব্যাপারে তােমার মনে অহঙ্কার আসে, তাহলে তুমি মৌন অবলম্বন কর। আর যদি ঐ অবস্থাতেও তােমার মনে গর্ব থেকে যায় তাহলে নীরবতা ভঙ্গ করে কথা বলতে থাক।

হযরত বিশরে হাফী (র)-এর পার্থিব জীবনের বিদায় মুহুর্তে আসন্ন হয়ে উঠলে তিনি ভয়ানক ভীত হয়ে পড়েন। লােকে তাকে জিজ্ঞেস করে আপনি কি পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কে ছিন্ন হচ্ছে বলে এত অস্থির হয়ে উঠেছেন? তিনি বললেন, না। আমার এ অস্থিরতার এবং ভীতির কারণ হচ্ছে এ যে, এবার আমাকে আল্লাহর দরবারে হাজির হতে হবে।

অন্তিম শয্যায় একটি লােক তার অভাবের কথা জানালে তিনি তাকে তাঁর গায়ের জামাটি দান করলেন। আর অন্য একটি জামা পরে নিলেন। এ জামাটি পরেই হযরত বিশরে হাফী (র) ইন্তেকাল করেন।

হযরত বিশরে হাফী (র)-এর ইন্তেকালঃ শােনা যায়, তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য কোন পশু প্রাণী বাগদাদের রাজপথে মলত্যাগ করত না। কারণ তিনি সবসময়ে খালি পায়ে চলাফেরা করতেন। কিন্তু একবার চতুষ্পদ কোন প্রণী রাস্তায় মলত্যাগ করে। তাতে পশুর মালিক হায় হায় করে ওঠেন। কেননা, তাঁর মনে হয়, হয়তাে বিশরে হাফী (র) আর ইহলােকে নেই। 

খৌজ নিয়ে দেখা গেল, সত্যিই তাই। তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে তার প্রতিপালকের কাছে ফিরে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর বহুলােক তাকে (স্বপ্নের মধ্যে) জিজ্ঞেস করে, মৃত্যুর পর আল্লাহর আপনার সঙ্গে কিরূপ আচরণ করলেন? তিনি জবাব দেন, আল্লাহ আমার ওপর রেগে বলেন, তুমি দুনিয়াতে আমাকে এত ভয় করে চলতে কেন? আমার করীম নামটির ওপর তােমার কি পরিপূর্ণ আস্থা ছিল না?

অন্য একজনের অনুরূপ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আল্লাহ আমাকে সম্পূর্ণরূপে ক্ষমা করে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন, পৃথিবীতে আমাকে খুশি করার জন্য তুমি যেসব বস্তু পানাহার করনি, এখন তা অনায়াসে উপভোগ কর। 

আরও একজন (স্বপ্নযােগে) তাকে প্রশ্ন করেন, ওফাতের পর আল্লাহ আপনার সাথে কেমন ব্যবহার করবেন? তার উত্তরে হযরত বিশরে (র) বলেন, আল্লাহ আমাকে বলেছেন, পৃথিবীতে আমি তােমাকে মানুষের মনে যে সম্মানে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম তার বিনিময়ে তুমি যদি আগুনের মধ্যে বসেও আমাকে সেজদা করতে তাহলেও আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ সম্পূর্ণ হতাে না। তার এসব উত্তর থেকে খুব সহজেই উপলব্ধি করা যায়, আল্লাহ পাকের কী অপরিসীম বন্ধুত্ব তিনি অর্জন করেছিলেন। 

হযরত বিশরে হাফী (রাঃ)-এর ধর্মনিষ্ঠাঃ   হযরত বিশরে হাফী (রাঃ)-এর ধর্মনিষ্ঠা তাঁর আত্মীয়জনের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। একবার এক মহিলা এসে প্রখ্যাত হাদীসবিদ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র)-কে জিজ্ঞেস করেন, গতরাতে আমি আমার বাড়িতে বসে সুতাে কাটছিলাম । হঠাৎ দেখি, এক বৃদ্ধা মশাল হাতে রাজপথ দিয়ে চলে যাচ্ছে। আর আমি সে মশালের আলােতেও কিছু সুতাে কেটেছি। 

এখন বলুন জনাব, ঐ বৃদ্ধার বিনা অনুমতিতে তার মশালের আলাতে আমার সুতাে কাটা হয়েছে কিনা? হযরত ইবনে হাম্বল (র) প্রশ্নকারিণী মহিলার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বললেন, আমি হযরত বিশরে হাফী (র)-এর বােন। ইবনে হাম্বল (র) কেঁদে ফেললেন। এ ধর্ম-চেতনা বিশরে হাফীর বােনের পক্ষেই সম্ভব। তারপর বললেন, মাননীয়া, আপনার পক্ষে এটি বৈধ হতে পারে না। আপনার উচিত, ভাইয়ের আদর্শ অনুসরণ করা। তাঁর কথা তাে আপনি জানেন । কোন খাদ্যবস্তু সন্দেহজনক হলে, তাঁর হাত তাতে সায় দিতাে না। আপনা থেকেই হাত উঠে আসতো।

আরও পড়ুন

* হযরত যুননুন মিশরী (রাঃ) জীবনী

* হযরত রাবেয়া বসরী (রাঃ) জীবনী

* হযরত সুফিয়ান সাওরী (রাঃ) জীবনী

* হযরত ইমাম আবু হানিফা (রাঃ) জীবনী

* ইমাম বোখারী (রাঃ) জীবনী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ