নতুন পোস্ট

6/recent/ticker-posts

হযরত ওমর ফারুক (রা.) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী বাংলা



ওমর ফারুক ( রাঃ)  জীবনী

মহাপরাক্রমশালী রােমান সম্রাটের দূত সুসজ্জিত বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে মদীনায় আগমন করলেন। ইসলামের নগরীতে এসে রাজার দূত এক আরব পথিককে জিজ্ঞেস করলেন, হে পথিক! আমাকে দয়া করে বল, খলিফার প্রাসাদ কোথায়?"

পথিক আশে-পাশে তাকাল। এই অদ্ভুত প্রশ্ন তাকে বিস্মিত করেছে, "প্রাসাদ বলতে আপনি কি বুঝাতে চান?” রাজদূত বললেন, "ইসলামের খলিফা ওমরের প্রাসাদ বুঝাতে চাচ্ছি। পথিক বলল, ও, এই কথা আপনি খলিফা হযরত ওমর আদি আল্লাহু আনহুর সাথে সাক্ষাত করতে চান? আমার সাথে আসুন। আমি আপনাকে তার কাছে নিয়ে যাচ্ছি।”

দূতকে মসজিদে নববীতে নিয়ে যাওয়া হল এবং তিনি সবিস্ময়ে দেখলেন যে, মসজিদের মেঝের উপর শায়িত একজন লােককে খলিফা ওমর বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া হল, যিনি সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক, যার অজেয় বাহিনী তিনটি মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে রােমান রাজদুত হতবিহবল হয়ে পড়েন। রােমান সম্রাটকে যে সংবাদগুলাে বিচলিত করে তুলেছে, মদিনা সফরে এসে ইসলামের অজেয় শক্তি সম্পর্কে রােমান দূতের আর কোন সন্দেহ রইল না।

হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদি আল্লাহু আনহু হিজরী সন ঘননার ৪০ বছর পূর্বে মক্কায় জান্মগ্রহণ  করেন। তাঁর পরিবার মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বপুরুষের সাথে একই গ্রন্থিতে যুক্ত। তাঁর পূর্বপুরুষরা বিভিন্ন পর্যায়ে দূতের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং তাঁর পৈতৃক পেশা ছিল ব্যবসা। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ত প্রাপ্তির সময়ে মক্কার সতের জন শিক্ষিত লােকের মধ্যে ওমর রাদি আল্লাহু আনহু ছিলেন একজন। 

২৭ বছর বয়সে তিনি ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে একটি চমকপ্রদ কাহিনী রয়েছে। নতুন জীবনাদর্শ ইসলামের বিরুদ্ধে যারা উঠে পড়ে লেগেছিল ওমর রাদি আল্লাহু আনহু ছিলেন তাদের একজন। একদিন তিনি ইসলামের নবীকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। পথে সাক্ষাত হল নাঈম বিন আবদুল্লাহর সাথে। নাঈম তাকে জিজ্ঞেস করলে যে, তার গ্তব্য কোথায়? ওমর রাদি আল্লাহু আনহু বললেন যে, তিনি মুহাম্মদের সাথে বুঝাপড়া করতে যাচ্ছেন। 

নাঈম একটু  বিদ্রুপের সাথেই বলল, প্রথমে তার নিজের ঘর সামলানাের জন্য। ওমর রাদি আল্লাহু আনহু কালবিলম্ব না করে বাড়ি ফিরে তার বােন ও বােনের স্বামীকে পবিত্র কোরআন পাঠরত অবস্থায় দেখলেন। ক্রোধে উন্মত্ত ওমর রাদি আল্লাহু আনহু ভগ্নীপতিকে নিদারুণভাবে প্রহার করলেন। তবু সে ও তার স্ত্রী অর্থাৎ ওমরের বােন ইসলাম ত্যাগ করতে অস্বীকার করল। বােনের অবিচলতা ওমরকে শান্ত করল এবং তিনি তাকে কোরআনের আইনগুলাে আবার পাঠ করতে বললেন। 

বােন সাথে সাথে তা পাঠ করল। কোরআনের অমিয় বাণী ওমর রাদি আল্লাহু আনহুর চিত্তকে দারুণভাবে নাড়া দিল এবং দ্রুত তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহুর ইসলাম গ্রহণের ঘটনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারীরা আবেগে চীৎকার করে উঠলেন, "আল্লাহু আকবার।" চারদিকের পাহাড় পর্বতে সেই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল।

হযরত ওমর রাদি  আল্লাহু আনহুর ইসলাম গ্রহণ মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি করল। পরবর্তীতে হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহুর খেলাফতের আড়াই বছর মেয়াদে তিনি ছিলেন খলিফার প্রধান উপদেষ্টা। আবু বকরের ইন্তেকালের পর হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহু ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা নির্বাচিত হন এবং দীর্ঘ সাড়ে দশ বছর সফল খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ৬৪৪ সালে মসজিদে নববীতে নামাজের জামায়াতে ইমামতি করার সময় ফিরােজ ওরফে আবু লুলু নামে এক অগ্নি উপাসকের (মাজুসী) আঘাতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।

ইসলামের মহান নবীর শিক্ষা যুদ্ধবিগ্রহে জড়িত আরব উপজাতিকে ঐক্যবদ্ধ জনগােষ্ঠীতে রূপান্তরিত করে, যা ছিল ইতিহাসের এক মহান বিপ্লব। ত্রিশ বছরের কম সময়ের মধ্যে যাযাবর আরবরা সেই সময়ের সবচেয়ে বিশাল সাম্রাজ্যের উপর প্রভুত্ব কায়েম করে। তিনটি মহাদেশের উপর আরবদের হাত প্রসারিত হয়েছিল এবং রােমের সীজার ও পারস্যের খসরুর বিশাল সাম্রাজ্য এই অজেয় বাহিনীর সামনে ছিল প্রকল্পিত। 

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিঃস্বার্থ ও সুযােগ্য কিছু লােক রেখে গিয়েছিলেন যারা নতুন ধর্ম বিশ্বাসের অখণ্ড সেবায় নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছিল। এসব লােকের অন্যতম ছিলেন হযরত ওমর ফারুক রাদি আল্লাহু আনহ, যিনি যুদ্ধ ও শান্তিকালীন উভয় সময়ে ছিলেন মহান। মানব ইতিহাসে যে গুটিকয়েক মানুষ যুদ্ধক্ষেত্রে, সৈন্য পরিচালনায়, জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালনে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম যো গ্যতা ও গুণের পরিচয় রেখে গেছে হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহু তাদের অন্যতম। 

হাজার মাইল দূরে যুদ্ধরত সেনাবাহিনীর প্রতি তিনি বিস্তারিত নির্দেশনা প্রেরণ করতেন। বিশেষ করে যােগ্য সেনাপতি নির্বাচনে তার বিচক্ষণতা এবং যুদ্ধ কৌশল উদ্ভাবনের মাধ্যমে আরব বাহিন দু'টি মহা শক্তিশালী দুশমন বাহিনীর উপর দুঃসহ পরাজয়ের কালিমা লেপন করতে সক্ষম হয়েছিল। শুধুমাত্র তার পরিকল্পনার নিপুণতার কারণেই সহজে যুদ্ধজয় সম্ভব হয়েছিল। বিজয় লাভের পর বিজিত ভূখণ্ডগুলাের সুসংহত কারণে তার পরিকল্পনা কার্যকর প্রমাণিত হয়।

তরবারির সাহায্যে ইসলাম বিস্তার লাভ করেছিল বলে পাশ্চাতে ইতিহাসবিদরা যে অভিযােগ করে থাকেন সাম্প্রতিককালের ঐতিহাসিক গবেষণায় তা প্রমাণিত হয় না। বরং এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, খােলাফায়ে রাশেদিনের যুগে মুসলমানরা শুধুমাত্র প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধই করেছে, আক্রমণাত্মক নয়। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ স্যার উইলিয়াম মুর তার বিখ্যাত গ্রন্থে প্রমাণ করেছেন যে, মেসােপটেমিয়া জয়ের পর সেনাপতি যায়েদ খলিফা ওমরের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেন খােরাসানের দিকে পলায়নপর পারসিক বাহিনীর পিছু ধাওয়া করার জন্য। 

কিন্তু খলিফা তাকে এই বলে বিদায় দিলেন যে, “মেসােপটেমিয়া এবং আরাে দূরবর্তী দেশগুলাের মধ্যে পর্বতশ্রেণী বাধা হয়ে থাকুক, তাহলে পারসিকরা আর আমাদের সাথে লড়তে আসবে না, অথবা আমরাও যাব না। ইরাকের সমতলভূমি আমাদের চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট। হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি এবং আরাে বিজয় অর্জনের চাইতে আমি বরং লােকদের জীবনের নিরাপত্তার। দিকটিকেই অগ্রাধিকার দেব।" এর প্রেক্ষিতে উইলিয়াম মুরের বক্তব্য হচ্ছে, "বিশ্বব্যাপী অভিযান পরিচালনার চিন্তা এখনাে সুপ্ত। বিশ্বজুড়ে ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে ইসলামকে প্রতিষ্টার তাগিদ মুসলিম মানসে এখনাে জাগ্রত হয়নি।

রােমান ও পারসিকরা সবসময় আরবদের বিবেচনা করতে মূর্খ, সংস্কৃতি বর্জিত জাতি হিসেবে। কিন্তু ইসলামের বিকাশমান শক্তিতে তারা আতংকিত হয়ে এর ধ্বংস সাধনে মনােযােগী হয়ে উঠল। পারসিকরা ইসলামের বিরুদ্ধে বাহরাইনের বিদ্রোহীদের মুক্তির জন্য সৈন্য প্রেরণ করল। ভড মুসাইলামা যে ইরাকে নবী হওয়ার ভান ধরেছিল সে মদিনার দিকে অগ্রসর হল। 

বিখ্যাত পারসিক সেনাপতি রােস্তম শপথ গ্রহণ করেছিলেন যে, তিনি গােটা আরব জাতিকে ধংস করে দেবেন। পারসিকদের এ ধরনের পরিকল্পনা ও চক্রান্ত মুসলমানদেরকে ভবিষ্যত বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করল এবং তারাও এই চ্যালেঞ্জ মােকাবেলার প্রস্তুতি নিতে লাগল। অতঃপর মুসলমানদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং নিজেদের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না।

পারসিকরা তাদের প্রথম পরাজয়ে হতচকিত হয়ে পড়েছিল। কারণ তারা আরবদের নিকট হতে সামান্য প্রতিরােধ আশা করেছিল। হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহুর সময়ে অনাকা্ষিত পরাজয়ে তারা ইতিপূর্বেই আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিবারের বিপর্যয় পারসিকদের ক্রোধের আগুনকে আরাে উস্কে দেয়। তাদের সাম্রাজ্য ছিল বিশাল এবং সম্পদও পর্যাপ্ত। 

আরবদের অগ্রযাত্রা প্রতিরােধে তারা সৈন্য ও অস্ত্র মােতায়েন করে, যাতে তাদের শক্তিকে ধংস করা যায়। অনুন্নত অস্ত্রে সজ্জিত আবরা রোমান ও পারসিকদের বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলার সাথে নিজেদের বিন্যস্ত করে। ইতিহাসে এমন নজীর খুঁজে পাওয়া কঠিন যে, বিবদমান বাহিনীর মধ্যে যে ধরনের অসমতা সত্ত্বেও দুর্বলই তার মহাশক্তিধর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জয়ী হয়

হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহু খলিফা নির্বাচিত হবার পর যুদ্ধের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। মুসলমানরা তখন দুটি রণক্ষেত্রে লড়ছিল। সিরিয়ার হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহু খলিফা নির্বাচিত হবার পর যুদ্ধের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। মুসলিম বাহিনী লড়ছিল রােমান সাম্রাজ্যের শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে এবং ইরাকে তারা লড়ছিল বিশাল পারসিক বাহিনীর বিরুদ্ধে। পারস্যের সিংহাসনে আরােহনকারী সম্রাট দুরান দুখত পারসিক বাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত করেন রােস্তমকে। তাদের কোন পদক্ষেপই মুসলিম বাহিনীর অগ্রযাত্রা রুখতে পারেনি। 

ইরাকে নাসরিক নেতৃত্বে পারসিক বাহিনী কাসকারে পরাজিত হয়। রােস্তম আরবদের জাত শত্রু বাহমনের হাতে সেনাপতির দায়িত্ব ভার ন্যস্ত করেন। ৬৩৫ সালে বেরাইতে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং পারসিক বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যক মৃতদেহ ফেলে পিছু হটে যায়। মুসলিম সেনাপতি মুসান্না ঘােষণা করেন যে, তিনি ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে অনেকবার পারসিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। তখন একশ পারসিক এক হাজার আরবকে অবলীলায় পরাজিত করত। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে।

হযরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস রাদি আল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে ৬৩৫ সালে কাদিসিয়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধ ছিল চূড়ান্ত নিষ্পত্তিমূলক এবং এই যুদ্ধের ফলেই ইরাকে পারস্য সম্রাজ্যের সমাপ্তির সূচনা হয়। পারস্যের বিখ্যাত বীর রােস্তম মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক বিশাল বাহিনী পরিচালনা করে। মুসলিম সেনাপতি অসুস্থ থাকায় তার স্থলে সেনাপতি নিযুক্ত করা হয় খালিদ বিন আরাফাতকে। আবু মাহজান সাকফি নামে এক কবিকে মাতলামির কারণে শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়েছিল। 

তিনি সেনাপতির স্ত্রী সালমাকে অনুরােধ করেন তাকে কিছু সময়ের জন্য মুক্তি দিতে, যাতে তিনি যুদ্ধে অংশ নিতে পারেন। যুদ্ধ শেষে তিনি ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দেন। তার অনুরােধ রক্ষা করা হয়। আবু মাহজান একটি তরবারি হাতে যুদ্ধের ময়দানে ঝাপিয়ে পড়েন এবং নজীরবিহীন সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধ শেষে ফিরে এলে তাকে পুনরায় শৃঙ্খলিত করা হয়। কিন্তু সাদ বিন ওয়াক্কাস রাদি আল্লাহু আনহু তার বীরত্বের কাহিনী শুনে তাকে মুক্তি দেন।

মুসলিম বাহিনীর একটি অংশকে সংরক্ষিত রাখা হয়েছিল কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত করে। এই গ্রুপগুলাে একটির পর আরেকটি শত্রুর উপর আপতিত হত। এই কৌশল পারসিক বাহিনীকে সুন্ত্রস্ত করে তােলে এবং তারা পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়। রােস্তম পালাতে চেষ্টা করে নিহত হয়। হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহু যুদ্ধের ফলাফল জানার জন্য উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলেন। তিনি ইরাকে এই অভিযানের বিস্তারিত নির্দেশের প্রণেতা ছিলেন এবং যুদ্ধের ইতিবাচক খবরের আশায় প্রতিদিন মদিনার বাইরে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতেন। 

খলিফা একদিন যুদ্ধক্ষেত্র হতে বার্তা বয়ে আনা দূতের পিছু পিছু দৌড়ে নগরীতে প্রবেশ করেন। মদিনায় পৌছার পর লােকজন তাকে জিজ্ঞেস করতে থাকে আমিরুল মােমেনীন সংবাদ কি? বার্তাৰহক অবাক বিস্ময়ে জানতে পারল, যে লােকটি তার পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে যুদ্ধের খবর জানতে চাইছিল তিনি হচ্ছেন খলিফা হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহু। দূত খলিফার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করল তার ধৃষ্টতার জন্য। 

কিন্তু হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহু তাকে আশ্বস্ত করলেন যে, তিনিও চাননি যে, এই সুসংবাদটি মদিনাবাসীদের কাছে বিলম্বে পৌছুক। এরপর খলিফা মদিনাবাসীর উদ্দেশ্যে এক স্মরণীয় ভাষণ প্রদান করেন, "মুসলিম ভ্রাতৃবৃন্দ, আপনাদেরকে দাসে পরিণত করতে চাই আমি তেমন শাসক নই। আমি আল্লাহ ও তার জনগণের দাস। খেলাফত পরিচালনার মত গুরুদায়িত্ব আমার উপর ন্যস্ত হয়েছে। আপনাদেরকে সকল উপায়ে ভাল রাখা আমার কর্তব্য এবং আমি যদি কোন কাজে বিলম্ব করি তাহলে সেটি হবে আমার জন্যে মন্দ দিন। আমি আমার কথা দ্বারা নয়, কাজের মধ্য দিয়ে আপনাদের শিখাতে চাই।”

ইরাকের ময়দানে পারসিক বাহিনী মুসলমানদের বিরুদ্ধে শেষ আঘাত হানল। তারা দজলা নদীর উপর নির্মিত সেতু ধ্বংস করে ফেলল। কিন্তু সেনাপতি সাদ বিন ওয়াক্কাস রাদি আল্লাহু আনহু থমকে দাঁড়ালেন না। তিনি নদীতে ঘােড়া চালিয়ে দিলেন। পুরাে বাহিনী তাকে অনুসরণ করে নদী অতিক্রম করল তাদের বেষ্টনী না ভেঙ্গেই। এই অভাবিত দৃশ্যে পারসিকরা আতংকগ্রস্ত হয়ে চীৎকার শুরু করল, 'দানবরা এসে গেছে। তারা পলায়নের রাস্তা খুঁজল। 

পারস্যের মূল্যবান গালিচাসহ বিপুল সম্পদ মুসলিম বাহিনীর হস্তগত হল। যুদ্ধ শেষে মদীনায় ফিরে সমস্ত সম্পদ মসজিদে নববীর চত্তরে জড় করা হল। এসব দেখে খলিফার চোখ অশ্রুতে ভরে গেল। উপস্থিত জনতা খলিফার বেদনার কারণ জানতে চাইলে তিনি উত্তর দিলেন, "সম্পদের প্রাচুর্যই পারসিকদের পরাজয়ের কারণ। 

আর এখন সেই সম্পদই আমাদের কাছে এসেছে আমাদের পতন আনার জন্য।” তিনি জনগণের মাঝে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বন্টনের নির্দেশ দিলেন। মূল্যবান গালিচাগুলােও বাদ গেল না। হযরত আলী রাদি আল্লাহু আনহুর পরামর্শে গালিচাগুলাে টুকরাে টুকরাে করে কেটে বন্টন করা হল। ওমর রাদি আল্লাহু আনহু সৈন্যদের নৈতিক মানের প্রশংসা করলেন। কারণ তারা সম্পদের মালিক হয়েও তা নিজেদের জন্য স্পর্শ করেনি।

সিরিয়া ছিল যুদ্ধের আরেকটি ক্ষেত্র। মুসলমানরা সেখানে লড়ছিল রােমান বাহিনীর বিরুদ্ধে। আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু তাঁর জীবদ্দশায় খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদি আল্লাহু আনহুকে সিরিয়ায় মুসলিম বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য আবআন করেছিলেন। সিরীয় শহরগুলাে একটির পর একটি মুসলমানদের পদানত হয়। 

দামেশক নগরীতে অবস্থিত বাহিনী মুসলমানদের প্রতিরােধের চেষ্টা করে। এক রাতে খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদি আল্লাহু আনহু নগর প্রাচীর টপকে ভিতরে প্রবেশ করে ফটক খুলে দেন। মুসলিম বাহিনী নগরীতে প্রবেশ করে। রােমান বাহিনী শান্তির প্রস্তাব দেয়। নগরীর কেন্দ্রস্থলে উভয় পক্ষের সেনাপতিরা মিলিত হয়। মুসলিম সেনাপতি তার বাহিনীকে কোন কিছু লুণ্ঠন না করার জন্য কঠোর নির্দেশ দেন।

পূর্বাঞ্চলীয় রােমান রাজধানী এন্টিওক প্রচণ্ড যুদ্ধের পর মুসলমানদের দখলে আসে। সেখানকার রােমান গভর্নর আরবাতীন তার প্রদেশের প্রতিরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরােধ গড়ে তােলেন এবং বিরাট সৈন্য সমাবেশ ঘটান। এই বিপুল সমাবেশে মুসলিম বাহিনী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন শিবির থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে আরবাতীনকে মােকাবেলার জন্য অগ্রসর হয়। মুসলিম সেনাপতি আবু ওবায়দা রাদি আল্লাহু আনহু হেমস থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার সময় অমুসলিম নাগরিকদের নিকট হতে আদায়কৃত জিজিয়া কর ফেরত দেয়ার জন্য রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। 

কারণ তার পক্ষে তখন অমুসলিম নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান করা সম্ভব ছিল না। নির্দেশ পাওয়া মাত্র তা কার্যকর হয়। এই ঘটনায় স্থানীয় খ্রিষ্টান অধিবাসীরা কাঁদতে কাঁদতে বলে, "ঈশ্বর আপনাদেরকে আবার এখানে বিজয়ী হিসেবে নিয়ে আসুক।” ইহুদীরা তাদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত স্পর্শ করে শপথ নেয় যে, তাদের সর্বশেষ ব্যক্তি জীবিত থাকা অবস্থায় রােমানদের দ্বারা নগর পুনর্দখলের চেষ্টায় বাধা প্রদান করবে।

৬৩৪ সালে ইয়ারমুক প্রান্তরে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয় মুসলিম ও রােমান বাহিনীর মধ্যে। উন্নত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বিশাল রােমান বাহিনীতে সৈন্যসংখ্যা ছিল তিন লাখ। বিরীতে মুসলিম বাহিনীর সৈন্যবল মাত্র ৪৬ হাজার। মুসলিম সৈনিকদের অনেকের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ ছিল না এবং অস্ত্রশস্ত্রও রােমানদের তুলনায় অনুন্নত। 

তা সত্ত্বেও মুসলিম বীরেরা অদম্য সাহসে ভর করে রােমানদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ যুদ্ধ করলাে। যুদ্ধক্ষেত্রে লক্ষাধিক রােমান সৈন্য নিহত হয়। মুসলিম বাহিনীর তিন হাজার সৈন্য শাহাদাত বরণ করে। এই বিপর্যয়কর পরাজয়ের খবর পাওয়ার পর রােমান সম্রাট সীজার দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে উচ্চারণ করেছিলেন, "বিদায় সিরিয়া, বিদায়"

ইয়ারমুকের যুদ্ধক্ষেত্র হতে কিছুসংখ্যক রােমান সৈন্য পালিয়ে এসে জেরুসালেমে আশ্রয় নেয়। নগরীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল শক্তিশালী এবং পরাজিত সৈন্যরা এসে দুশমনের শক্তিকে আরাে বৃদ্ধি করে। তারা দীর্ঘ সময় ধরে তাদের প্রতিরােধ বজায় রাখে। অবশেষে নগরপাল শান্তির জন্য আবেদন করেন। কিন্তু স্বয়ং খলিফা ছাড়া অন্য আরাে কাছে আত্মসমর্পন করতে অস্বীকার করেন। হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহু তার অনুরােধে সাড়া দিয়ে একজন মাত্র দেহরক্ষী নিয়ে তথায় উপস্থিত হন। 

নগরপাল ও তার সঙ্গীরা যখন অপেক্ষা ছিলেন তখন খলিফার হাতে ছিল উটের রশি আর দেহরক্ষী উটের পিঠে আসীন। খ্রিষ্টান পাদ্রী ও তার সঙ্গীরা মানুষের মাঝে সাম্য প্রতিষ্ঠার এই অভিনব দৃশ্য দেখে গভীরভাবে আপুত হয়ে পড়েন। নগরপাল খলিফার হাতে পবিত্র জেরুসালেম নগরীর চাবি অর্পণ করেন। 

নগরপালের সাথেই তিনি নগরীতে প্রবেশ করেন। হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহু হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের পুনরুশ্বান গীর্জায় নামায আদায় করতে অস্বীকার করলেন এই যুক্তিতে যে, "আমি যদি এখানে নামায আদায় করি তাহলে মুসলমানরা ভবিষ্যতে আমার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে চুক্তিভঙ্গ করার সুযােগ নিতে পারে।” খ্রিস্টানদের উপর ন্যায়সঙ্গত শর্ত আরােপ হল। সামারীয় ইহুদী, যারা মুসলমানদের সহায়তা করেছিল তাদেরকে পরিত্যাক্ত সম্পত্তি ভােগদখলের অধিকার দেয়া হয়। 

এভাবে সিরিয়া অভিযানের পরিসমাপ্তি ঘটল। একজন ইতিহাসবিদ উল্লেখ করেছেন, “সিরিয়া খলিফাদের কাছে মাথা নত করল।” এর আগে সম্রাটরা সাত শত বছর এই ভূখণ্ও শাসন করে। শেষ পরাজয়ের পর রােমানরা স্বীকার করে যে, তারা নিদারুণভাবে পরাভূত। যদিও তারা মাঝে মধ্যে মুসলিম ভূখণ্ডের উপর হামলা অব্যাহত রেখেছিল। 

রােমান ও মুসলিম শক্তির মধ্যে অপ্রতিরােধ্য বাধা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে রােমানরা মরুভূমি অঞ্চলে তাদের এশীয় ভূখণ্ডকে সমতল করে ফেলল। নগর ও দুর্গগুলাে গাংস করে দিল। কিন্তু এর ফলেও মুসলমানদের অগ্রযাত্রা রােধ করা সম্ভব হয়নি। মুসলিম সেনাপতি 'আয়াজ’ তারাউস অতিক্রম করে সিলিসিয়া প্রদেশ দখল করে কৃষ্ণ সাগরের উপকূল পর্যন্ত পৌছে গেলেন। এশিয়া মাইনরে রােমানদের কাছে সেনাপতি আয়াজের নাম ছিল আতংকের মত।

সিরিয়া থেকে রােমানদের বিতাড়ন করে মুসলিম বাহিনীর পারস্য অভিযানে বের হল। ৬৩৪ সালে তারা আজারবাইজান, বােস্তান, ৬৪৪ সালে সিস্তান, আর্মেনিয়া ও মাকরান দখল করে। ইতিহাসবিদ বালাজুরীর মতে, "ইসলামী বাহিনী সিন্ধুর দেবল পর্যন্ত পৌছে যায়।" তারাবীর বর্ণনানুসারে খলিফা হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহু মাকরানের পূর্বদিকে অভিযান সম্প্রসারণ না করার নির্দেশ দেন। পরাজিত রােমান বাহিনী পিছু হটে আলেকজান্দ্রিয়ায় আশ্রয় নিয়েছিল এবং সেখান থেকে মুসলমানদের হস্তগত সিরিয়ার বিরুদ্ধে হুমকি দিয়ে যাচ্ছিল। 

অবস্থার প্রেক্ষিতে সেনাপতি হযরত আমর বিন আল আস রাদি আল্লাহু আনহু খলিফা হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহুকে অনুরােধ জানালেন মিশরে অভিযান পরিচালনার অনুমতি দিতে। খলিফার অনুমতি লাভ করে আমর বিন আল আস রাদি আল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী ৬৪১-৪২ সালে আলেকজান্দ্রিয়া অধিকার করলেন। মিশরীয় খ্রিস্টানদের সাথে অত্যন্ত সদয় আচরণ করে তাদেরকে জমির মালিকানা প্রদান করা হয়। 

কায়েমী স্বার্থবাদী গােষ্ঠী যড়যন্ত্রমূলকভাবে একটি বিভ্রান্তিকর কাহিনী ছাড়লাে যে, মুসলিম বাহিনী আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত লাইব্রেরী ধ্বংস করেছে। কিন্তু পাশ্চাত্যের ইতিহাসবিদদের অনেকে নিরপেক্ষ অনুসন্ধানে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, কথিত লাইব্রেরীর আংশিক ধ্বংস হয়েছিল জুলিয়াস সীজারের সময়ে এবং অবশিষ্ট অংশ ধ্বংস হয়েছে। আরেক রােমান সম্রাট থিওডোসিয়াসের দ্বারা।

তখনকার দিনে নৌ-যুদ্ধে রােমানরা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল। তাদের মােকাবেলায় আরবরা শক্তিশালী নৌ-বহর গড়ে তুলল। সমুদ্রে আরবরা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার পর রােমান নৌ-বহর হেলেসপেন্টের দিকে পালিয়ে গেল। গ্রীক অধিকৃত অনেকগুলাে দ্বীপ মুসলমানদের হাতে এল। সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে মুসলমানদের আড়ােলন সৃষ্টিকারী এবং ইতিহাসের গতি পরিবর্তনকারী সামরিক বিজয়ের কারণ উদ্ভাবনে অনেক গবেষণা হয়েছে। 

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফার আমলে মুসলমানরা সিরিয়া, মিশর, ইরাক, পারস্য, খুজিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, কিরমান, খােরাসান, মাকরান ও বেলুচিস্তানের অংশসহ বিস্তীর্ণ এলাকার উপর তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। সামান্য কিছুসংখ্যক আরব বিশ্বের দু'টি বৃহৎ ও শক্তিশালী সাম্রাজ্যকে উৎখাত করে। ইসলামের মহান নবীর শিক্ষায় নবদীক্ষিতদের মনে নতুন প্রেরণার সৃষ্টি হয়েছিল, যার ফলে তারা আল্লাহর পথে জীবন বিসর্জন দিতে কাপিয়ে পড়েছিল। 

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা তার সেনাপতি নির্বাচন ও দখলকৃত ভূ-খণ্ডের জনগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে উদার শর্তারােপ করার ক্ষেত্রে যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা মুসলমানদের বিজয়ের চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে। তারাবীর মতে, হযরত ওমর ফারুক রাদি আল্লাহু আনহু যুদ্ধক্ষেত্র হতে সহস্র মাইল দূরে বসেও যুদ্ধক্ষেত্রে সেনা পরিচালনা ও তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতেন। বিজিত এলাকার জনগণের সব ধরনের সুযােগ সুবিধা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন উদার, যা আধুনিক যুগের জেনেভা কনভেনশনে স্বীকৃত হলেও তা পালন করা হয় না। 

এই নাত অবলম্বনের ফলে জনগণের হৃদয় জয় করা সহজ হয়েছে। যার ফলে বিজিত দেশে সংহতি বিধান ও শাসন ব্যবস্থা গড়ে তােলা সম্ভব হয়েছে অল্পদিনের মধ্যেই। খলিফা তাদের সৈন্যদের কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছেন দুর্বলদের হত্যা না করতে, ধর্মীয় স্থানের প্রতি অবমাননাকর কিছু না করতে। কোন চুক্তি সম্পাদিত হলে তা প্রতিপালিত হয়েছে অক্ষরে অক্ষরে। আলেকজান্ডার, সীজার অ্যাটিলা, চেঙ্গিস খান ও হালাকু খানের মত বীরদের বর্বরতার ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও ওমর রাদি আল্লাহু আনহু ভূ-খণ্ডগত বিজয়ের সাথে আধ্যাত্মিক বিজয়ের প্রতিও মনােযােগী ছিলেন। 

আলেকজান্ডার সিরিয়ার সার নগরী দখল করে গণহত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং হাজার হাজার বিশিষ্ট নাগরিককে নগর প্রাচীরের সাথে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। অনুরূপ পারস্যের আস্তাখের নগর দখল করে সেখানকার সকল পুরুষ নাগরিকের মস্তক ছিন্ন করেছিলেন। চেঙ্গিস খান, অ্যাটিলা ও হালাকু খানের মত সেচ্ছাচারী শাসকরা ছিলাে আরাে বর্বর। ফলে তাদের মৃত্যুর সাথে সাথে তাদের সাম্রাজ্য টুকরা টুকরা হয়ে যায়। 

কিন্তু দ্বিতীয় খলিফার বিজয় ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। তার বিচক্ষণতা ও দক্ষ প্রশাসন মুসলিম সাম্রাজ্যকে এমন দৃঢ়ভাবে সংহত করতে সক্ষম হয়েছিল যে ১৪০০ বছর পরও তার বিজয়ে ঐতিহ্যমন্ডিত দেশগুলাে মুসলিম শাসনাধীনেই রয়েছে। খলিফা ওমর রাদি আল্লাহু আনহুকে অনেক ইতিহাসবিদ বলেছেন, তিনি এক অর্থে বিশ্বের সেরা বিজয়ীদের একজন।

সাধারণভাবে মুসলমানদের এবং বিশেষভাবে তাদের খলিফার সততা, ন্যায়নিষ্ঠা, সরলতার কারণে মুসলমানদের দেয়া প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে অমুসলিমদের মনে দৃঢ় আস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। পারস্যের সেনাপতি হুরমুজ ছিলেন মুসলমানদের ঘাের দুশমন। যুদ্ধক্ষেত্রে ধৃত হওয়ার পর তাকে মদিনায় খলিফার সামনে হাজির করা হয়। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, মুসলমানদের উপর হত্যালীলা চালানাের দায়ে তার মস্তক ছিন্ন করা হবে। 

মনে মনে একটি পরিকল্পনা এঁটে তিনি পানি পান করতে চাইলেন। পানি আনার পর তিনি তা পান করার আগ্রহ না দেখিয়ে বলরেন যে, পানি পান করার সময় তাকে হত্যা করা হতে পারে এ জন্যে তিনি পানি পান করছেন না। খলিফা কোনরূপ সহে না করেই তাকে আশ্বাস দিলেন যে, পানি পান না করা পর্যন্ত তাকে হত্যা করা হবে না। কূটচরিত্রের হুরমুজ পানি ছুড়ে ফেললেন সাথে সাথে এবং বললেন যে, যেহেতু তিনি খলিফার আশ্বাস পেয়েছেন, অতএব তিনি আর পানি পান করবেন না। খলিফা তার কথা রাখলেন এবং তাকে হত্যার নির্দেশ দিরেন না। হুরমুজ সততার এই বিরল দৃষ্টান্ত দেখে ইসলাম গ্রহণ করলেন।

একবার মুসলিম বাহিনী এক নগর অবরােধ করেছিল। একদিন নগরবাসীরা নগরদ্বার খুলে যার যার কাজে লেগে গেল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে, একজন মুসলিম ক্রীতদাস তাদের ক্ষমা করে দিয়েছে। বিষয়টি খলিফার গােচরে আনা হল। তিনি ক্রীতদাস কর্তৃক নগরবাসীদের ক্ষমা করার বিষয়টি অনুমােদন করলেন। তিনি বললেন, “একজন সাধারণ মুসলমানের প্রতিশ্রুতি তার সেনাপতি বা খলিফার প্রতিশ্রুতির মতই গুরুত্বপূর্ণ"

খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলেই সত্যিকার গণতন্ত্র চর্চা হয়েছে। মানব ইতিহাসে এর দ্বিতীয় কোন নজীর নেই । ইসলাম একটি গণতান্ত্রিক র্ধম। পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে মুসলিম জনগোষ্ঠীর রাষ্টীয় বিষয়াবলী নিষ্পওিতে আলোচনা ও পরামর্শের গুরুত্ব দেযা হয়েছে । মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং আলাপ আলোচনা ছাড়া তাৎক্ষণিক কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন না। 

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামে গণতন্ত্রের যে চারা রোপন করে গেছেন তাকে লালন করেছেন হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু এবং এর কাঠামাে পূর্ণতালাভ করেছে খলিফা ওমর রাদি আল্লাহু আনহুর সময়। তার আমলে দু'টি উপদেষ্টা পরিষদ কাজ করেছে। একটি ছিল সাধারণ পরিষদ, যা রাষ্ট্রের সংকট মুহূর্তে আহ্বান করা হত। দ্বিতীয়টি সকলের কাছে গ্রহণযােগা ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত পরিষদ, যাদের সাথে জরুরি বিষয়ে এবং নিয়মিত পরামর্শ করা হত। 

এমনকি সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও বরখাস্তের বিষয়ও পরিষদের সামনে আনা হত এবং তাদের সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে পালিত হত। অমুসলিমদেরকেও আলােচনায় অংশ নেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান হত। ইরাকের শাসনকার্য পরিচালনার ব্যাপারে দেশীয় পত্রীদের পরামর্শ নিয়মিত গ্রহণ করা হত। অনুরূপভাবে মিশরের বিষয়াবলী আলােচনার জন্য স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে আহবান করা হত। প্রাদেশিক গভর্নর নিয়ােজিত হতেন জনগণের পরামর্শে। 

কখনাে কখনাে প্রদেশের বিভিন্ন পদের জন্যও লােক নির্বাচন করা হতাে স্থানীয় লােকদের সাথে আলােচনা করে। কুফা, বসরা ও সিরিয়ার জন্য রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা নিয়ােগের ক্ষেত্রে হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহু স্থানীয় বাসিন্দাদের অনুমতি প্রদান করেন তাদের পছন্দ অনুযায়ী সৎ, যােগ্য খোদাভীরু লােক বাছাই করতে। জনগণের পছন্দকে খলিফা পরে অনুমােদন করেন। তিনি প্রায়ই বলতেন খেলাফত পরিচালনার ব্যাপারে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ অবশ্যই প্রয়ােজন। একজন দরিদ্র বৃদ্ধাও প্রকাশ্যে খলিফাকে তার বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারতাে এবং খলিফাকে সেখানেই তার ব্যাখ্যা দিতে হত।

খলিফা ওমর রাদি আল্লাহু আনহু জনগণ ও তার প্রশাসকদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটাতে চেষ্টা করেছেন। সরকারি কর্মকর্তারা খােলামেলা আলােচনা করতেন যে, তাদেরকে বেতন দেয়া হয় জনগণের সেবার জন্য এবং কোন অভিযােগ সত্য প্রমাণিত হলে কর্মকর্তার কঠোর শাস্তি অবধারিত ছিল। খলিফা নিজে যা বলতেন, বাস্তবে তা পালন করতেন। তিনি ছিলেন জনসেবার সত্যিকার প্রতিমূর্তি। ইতিহাসে খােলাফায়ে রাশেদার প্রথম যুগ ছাড়া জনগণের সেবা করার এমন নজীর আর দ্বিতীয়টি নেই।

হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহু সাধারণ মানুষের মত জীবন কাটাতেন এবং যে কোন লােক তার গৃহীত কর্মপন্থা সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারত। একদিন তিনি বললেন, “একজন এতিমের সম্পত্তির অভিভাবকের যতটা দায়িত্ব বায়তুল মালেক উপর আমার কর্তৃত্ব তার চেয়ে বেশি নয়। 

আমার যদি সামর্থ্য থাকে তাহলে বায়তুল মাল হতে আমি কোন ভাতা নেব না। আর যদি সামর্থ্য না থাকে তাহলে সাধারণভাবে জীবিকা নির্বাহের জন্য আমি সামান্য ভাতা নেব। ভ্রাতৃবৃন্দ আমি আপনাদের দাস আপনারা আমাকে পরিচালনা ও আমার কাজ সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন-জনগণের অর্থ যাতে অপ্রয়ােজনীয়ভাবে পুঞ্জীভূত ও অপচয় না হয়। জনগণের সমৃদ্ধি ও কল্যাণের জন্যই আমাকে কাজ করতে হবে।

একদিন এক ব্যক্তি প্রকাশ্যে চীৎকার করে উঠল, “হে ওমর, আল্লাহকে ভয় কর।” জনতার মধ্য থেকে তাকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হল। কিন্তু খলিফা তাদের বাধা দিয়ে বললেন, “জনগণ যদি এভাবে খােলামেলা বক্তব্য রাখতে না পারে, এবং আমরা যদি তাদের কথা শ্রবণ না করি তাহলে আমরাও তাদের মত হয়ে যাব।" জনগণের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা সম্পর্কে খলিফার এই দৃষ্টিভঙ্গি জনসেবা ও রাষ্ট্রের প্রশাসনের দক্ষতা ও সততাকে প্রমাণ করে। তার আমলে জনগণ তাদের মতের যথার্থতা উপলব্ধি করেছিল।

মহান খলিফা বিভিন্ন বিষয় তত্ত্বাবধানের জন্য পৃথক পৃথক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিভাগগুলাের দায়িত্বে ছিলেন দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তারা। হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহু নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করেছিলেন, যা ছিল উল্লেখযােগ্য এক অবদান। বর্তমান বিশ্বের অনেক আধুনিক রাষ্ট্রেও এই পৃথকীকরণ সম্ভব হয়নি। বিচার বিভাগ সরকারের নিয়ন্ত্রণ হতে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল বলে কোন রকম ভীতি বা আনুকূল্যের উর্ধে থেকে কাজীগণ ন্যায়বিচার সম্পন্ন করতেন।

প্রশাসনের সাফল্য ও দক্ষতা নির্ভরশীল ছিল কর্মচারীদের উপর খলিফার সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখার কারণে। যখন গভর্নরের নিয়ােগপত্র লেখা হত, সেই নিয়ােগপত্রে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বিস্তারিত লিপিবদ্ধ থাকত এবং প্রকাশ্যে এই নিয়ােগপত্র পাঠ করা হত। ফলে জনগণ নিয়ােগের শর্ত সম্পর্কে যেমন জানতে পারতাে, তেমনি ক্ষমতা অপব্যবহারের জন্য অভিযুক্ত করতে পারত। 

একবার খলিফা ওমর রাদি আল্লাহু আনহু গভর্ণরদের উদ্দেশ্যে তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন, "স্মরণ রাখবেন যে, জনগণকে শাসন করার জন্য নয়, বরং তাদের সেবা করার জন্যই আপনাদেরকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। আপনাদের সদাচরণ দ্বারা এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন যাতে জনগণ আপনাদের অনুসরণ করে।"

শাসক ও শাসিতের মধ্যে যাতে বেশি ব্যবধান না ঘটে তার উপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। জনগণ যাতে সহজে ও অবাধে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তির কাছে পৌছতে পারে সেদিকেও তার দৃষ্টি ছিল। প্রত্যেক গভর্নরকে নিয়ােগ প্রাপ্তির পর একটি মুচলেকা দিতে হত যে, তিনি মােটা বস্ত্র পরিধান করবেন, মােটা রুটি আহার করবেন এবং যে কোন সময়ে তার কাছে এসে যে কেউ অভিযােগ করতে পারবে।" "

ফুতুহ-উল-কুলদান নামক গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে ইতিহাসবিদরা বলেছেন, "নিয়ােগ প্রাপ্তির সময় পদস্থ কর্মকর্তাদের স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তির তালিকা প্রস্তুত ও সময়ে সময়ে তা পরীক্ষা করা হত। সম্পত্তির অযৌক্তিক বৃদ্ধির জন্য তাদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হত। প্রতিবছর হজ্বের সময় সকল পদস্থ কর্মকর্তাদেরকে খলিফার কাছে রিপাের্ট পেশ করতে হত। তার সময়ে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত অভিযােগ করার এখতিয়ার প্রদান করা হয়েছিল। 

অভিযােগ তদন্ত ও প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হত। অভিযােগ প্রমাণিত হলে পদস্থ ব্যক্তিদেরকেও রেহাই দেয়া হত না। একবার জনৈক ব্যক্তি অভিযােগ করল যে, একজন গভর্নর কোন অভিযােগ প্রমাণ করা ছাড়াই তাকে বেত্রাঘাত করেছেন। বিষয়টি তদন্ত করা হলাে এবং অন্যায়ভাবে বেত্রাঘাত করার দায়ে গভর্নরকেও প্রকাশ্যে সমসংখ্যক বেত্রাঘাত করা হল।

খলিফা ওমর রাদি আল্লাহু আনহু মুহাম্মদ বিন মুষলামাহ আনসারী নামে সর্বজনশ্রদ্ধেয় এবং প্রশ্নাতীত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এক ব্যক্তিকে ব্যাপক ক্ষমতা দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়ােগ করলেন। তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করে জনগণের নিকট রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে অভিযােগ তদন্ত করতেন। একবার খলিফার কাছে অভিযােগ এল যে, কুফার গভর্নর সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস সেখানে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছেন। 

অবিলম্বে তিনি মুহাম্মদ আনসারীকে কুফায় প্রেরণ করলেন। সেখানে গিয়ে তিনি প্রাসাদের একটি অংশ ভেঙ্গে ফেললেন, যাতে ভাঙ্গা অংশ দিয়ে জনগণ সহজে প্রাসাদে প্রবেশ করতে পারে। অপর এক অভিযােগে সাদকে তার পদ থেকে অপসারণ করা হল। আরেকবার খলিফা জানতে পারলেন যে, মিশরের গভর্নর আয়াজ বিন গানাম তার বাড়িতে একজন প্রহরী নিয়ােগ করেছেন। মুহাম্মদ আনসারী মিশরে গিয়ে দেখতে পেলেন যে অভিযােগ সত্য এবং তাকে মদিনায় নিয়ে এলেন। 

খলিফা নিজে তার শাস্তি বিধান করলেন। এক সময়ে খলিফা বিভিন্ন অভিযােগ তদন্তের জন্য একটি কমিটি নিয়ােগ করেন। বিস্তীর্ণ খেলাফতে দক্ষ ও আদর্শ প্রশাসন কায়েমের লক্ষ্যেই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। এর ফলে হাজার হাজার মাইল দূরে কর্মরত একজন সরকারি কর্মকর্তার পক্ষে জনগণ ও রাষ্ট্রের স্বার্থ পরিপন্থী কোন কাজ করার সাহস হত না। খলিফাকে অসন্তুষ্ট করার কথা কেউ ভাবতেও পারত না। স্বেচ্ছাচারী শাসক ও খলিফার কাজের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ছিল যে, স্বেচ্ছাচারী শাসক কঠোর ব্যবস্থা নেয় তার নিজ স্বার্থে, ওমর রাদি আল্লাহু আনহু কঠোর হয়েছেন রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণের লক্ষ্যে।

এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলাম' এ একজন ইউরােপীয় ইতিহাসবিদ উল্লেখ করেছেন, ওমরের শাসনকাল ছিল মহান।" অমুসলিম নাগরিকদের বিষয়ে দেখাশুনা করার জন্য দফতর, সামরিক বাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্তদের ভাতা প্রদানকারী অফিস ও সামরিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, যার মাধ্যমে ইসলামের মহান নগরীগুলাের ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে, কাজীর দফতর প্রতিষ্ঠা-এসবই ছিল খলিফা ওমরের অবদান। 

তার আমলে জনকল্যাণমূলক অনেক বিধান প্রণীত হয়েছে। পবিত্র রমযান মাসে ২০ রাকআত তারাবীহ নামায পড়ার বিধান তিনিই প্রবর্তন করেন হজ্ব পালনে বাধ্যবাধকতা, মদ্যপানের অভিযােগে দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলায় শাস্তি প্রদান ও ব্যভিচারের দয়ে পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ডের বিধানও খলিফা ওমর রাদি আল্লাহু আনহু প্রবর্তন করেন।

সরকারি রাজস্ব ব্যবস্থার উন্নয়নের তিনি যথেষ্ট মনােযােগী থাকায় দেশের অর্থনীতি দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি "দিওয়ান অথবা রাজস্ব বিভাগ স্থাপন করে সেই বিভাগের উপর রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ন্যস্ত করে ।। তার আমলে প্রধানতঃ তিনটি উৎস হতে রাজস্ব আদায় করা হত। যথাঃ ১। যাকাত অর্থাৎ সম্পদশালী মুসলিম নাগরিকদের নিকট হতে আদায়কৃত অর্থ। ২। খারাজ অর্থাৎ জিম্মিদের মালিকানাধীন জমির উপর আরােপিত কর এবং ৩। জিজিয়া বা অমুসলিমদের নিরাপত্তা ও নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করণের জন্য আরােপিত কর। 

শেষােক্ত দু'টি কর আরােপের কারণে পাশ্চাত্যের ইতিহাসবিদারা মুসলমানদের দোষারূপ করেছেন। কিন্তু রােমান ও পারসিক সাম্রাজ্যেও এ ধরনের কর আদায়ের দৃষ্টান্ত রয়েছে। মুসলমানরা এক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করেছে মাত্র। পূর্বে মুসলমানদের নিকট হতে যে পরিমাণ কর আদায় করা হয়েছে খােলাফায়ে রাশেদার যুগে অমুসলিমদের উপর আরােপিত করের পরিমাণ তা অপেক্ষা অনেক কম।

ইসলাম একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে; যাতে সম্পদের সুষম এবং ন্যায়সঙ্গত বণ্টনকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সম্পদের মজুদ গড়ে তােলা ইসলামী ব্যবস্থার পরিপন্থী। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহু ইসলামের সুবর্ণ নীতিমালা কঠোরভাবে অনুসরণ করতেন। তিনি বায়তুল মাল সংঘঠিত করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল সম্পদ বণ্টন করা, সম্পদ পুঞ্জীভূত করা নয়। 

খলিফা নিজে বায়তুল মাল হতে খুব সামান্য অর্থ গ্রহণ করতেন। তার পৈতৃক পেশা ছিল ব্যবসা। তবু খেলাফতের গুরুদায়িত্ব পালনের কারণে তাকে কিছু ভাতা প্রদান করা প্রয়ােজন। বিষয়টি একটি বিশেষ কমিটির প্রেরণ করা হলে হযরত আলী রাদি আল্লাহু আনহুর মহামত গ্রহণ করা হল যে, একজন সাধারণ নাগরিকের জীবিকার জন্যে যতটুকু প্রয়ােজন, খলিফার উচিত ঠিক সে পরিমাণ অর্থ ভাতা হিসেবে গ্রহণ করা।

জমির উৎপাদনশীলতা ও ফসলের উপর খলিফা ভূমি রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ করেন। জমি স্থানীয় পরিমাপ অনুযায়ী এক 'জারিব' গমের জমির খাজনা চার দিরহাম, একই মাপের যব জমির জন্য দুই দিরহাম খাজনা ধার্য করা হত। পশুচারণ ভূমি ও অনাবাদী জমির কোন খাজনা ছিল না। এভাবেই তিনি ভূমি রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থাকে একটি সুষ্ঠু কাঠামাের উপর দাঁড় করান। তার পূর্বে এ ব্যবস্থা ছিল অসংগঠিত। 

মিশরে ভূমি রাজস্ব নির্ধারণের পৃথক ব্যবস্থা ছিল। কারণ সেখানে কৃষি নির্ভরশীল ছিল নীল নদের বন্যার উপর। নির্ভরযােগ্য ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে ইরাকে বার্ষিক রাজস্বের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৬ কোটি দিরহাম। খলিফা ওমর রাদি আল্লাহু আনহুর ইন্তেকালের পর এই পরিমাণ রাজস্ব আর আদায় হয়নি, যদিও কর আদায়ের সঙ্গেজ খলিফার প্রত্যক্ষ কোন যােগসূত্র ছিল না। সহজে বিপুল রাজস্ব আদায়ের পিছনে কারণ হিসেবে দেখা যায় যে, তখন জনগণের অবস্থা অত্যন্ত স্বচ্ছল হয়ে উঠেছিল।


খলিফা ওমর রাদি আল্লাহু আনহু কৃষি ব্যবস্থায় সুদূরপ্রসারী সংস্কার সাধন করেছিলেন, যা আধুনিক যুগের উন্নত দেশগুলােতেও বিরল সংস্কারের একটি উল্লেখযােগ্য দিক ছিল জমিদারী ব্যবস্থার উচ্ছেদ। এর সুফল হিসেবে যুগ যুগ ধরে দরিদ্র কৃষিজীবিদের উপর চালিত কায়েমী স্বার্থবাদী গােষ্ঠীর অন্যায় অত্যাচারের অবসান ঘটে

রােমানরা যখন সিরিয়া ও মিশর জয় করেছিল তখন সেখানকার ভূমি মালিক ও কৃষকের জমি বাজেয়াপ্ত করে সৈনিক, অভিজাত, গীর্জা ও রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে বরাদ্দ দেয়া হয়। হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহু এসব দেশ জয় করে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে জমিগুলাে ফিরিয়ে দেন, যারা ছিল জমির প্রকৃত মালিক। 

ন্যায়ানুগ ও দয়া খলিফা স্থানীয় কৃষকদের প্রতি ছিলেন উদার এবং কঠোর নির্দেশ জারি করেছিলেন যে, মুসলিম সেন্যসহ যারা এসব দেশে ছড়িয়ে পড়েছে তাদের কাউকে চাষাবাদের জন্য এক খন্ড জমিও বরাদ্দ দেয়া হবে না। খলিফার গৃহীত এ পদক্ষেপে স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে আস্থা ফিরে আসে এবং কৃষিতে আসে গতিশীলতা। কৃষি উৎপাদনও আশাতীত রুপে বৃদ্ধি পায়। জনগণ সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। 

ভূমি রাজস্ব আদায়ও সহজতর হয়। একজন ফরাসী ইতিহাসবিদের মতে, "রাজস্ব আদায়ে আরবদের সহজ পদ্ধতি অনুসরণ এবং তাদের ভূমি সংস্কার সামরিক বিজয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তার উদার নীতির কারণে বিজিত দেশের খ্রিষ্টান নাগরিকরা রােমানদের চাইতে বরং আরবদের পক্ষপাতিত্ব করেছে বেশী। কিন্তু খলিফা এই সংস্কারেও সন্তুষ্ট ছিলেন না। কৃষির আরাে উন্নয়নে তিনি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং সেচের জন্য খাল, কৃপ ও পুকুর খনন করেন। 

এসব নির্মাণ কাজ তত্ত্বাবধানের জন্য এবং ভবিষ্যতে অব্যাহত রাখার জন্য পূর্ত বিভাগের প্রতিষ্ঠা করা হয়। একজন ইতিহাসবিদের মতে শুধুমাত্র মিশরে সেচকার্য সম্প্রসারণের জন্য সারা বছর জুড়ে এক লাখ বিশ হাজার নিয়মিত শ্রমিক নিয়ােজিত ছিল। এ সময়ে খুজিস্তান ও আহওয়াজে বহু খাল খনন করা হয়েছিল। মিশরে থেকে পবিত্র ভূমিতে খাদ্যশস্যের দ্রুত সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নীল নদ থেকে লােহিত সাগর পর্যন্ত একটি খাল খনন করা হয়েছিল, যার নাম দেয়া হয় 'নহরে আমীরুল মােমেনীন।

নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার কারণে হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহু সমধিক খ্যাত তার সময়ে বিচারের দায়িত্বে ছিলেন কাজী, যাদের নিয়ােগ করতনে খলিফা। তারা গভর্নরদের নিয়ন্ত্রণ থেকে পুরােপুরি মুক্ত ছিলেন। খলিফা ওমর রাদি আল্লাহু আনহুই প্রতশ ব্যক্তি যিনি বিচার বিভাগকে প্রশাসন থেকে পৃথক করেন। 

এভাবেই তিনি অবাধ ও নিরপেক্ষ বিচার নিশ্চিত করেন। জার্মান ইতিহাসবিদ হ্যামারের মতে, "ইসলামী শাসনের প্রাথমিক যুগেও বিচার বিভাগকে বাস্তবে প্রশাসনিক ক্ষমতা থেকে পৃথক করা হয়েছিল।" এ ধরনের পৃথকীকরণ এখন পর্যন্ত অনেক উন্নত দেশেও সম্ভব হয়নি। ওমর রাদি আল্লাহু আনহুর সময়ের বিচার বিভাগ ছিল সম্পূর্ণ পক্ষপাতহীন এবং কাজীর নির্দেশ কঠোরভাবে পালনের মধ্য দিয়ে তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।

খলিফা ওমর রাদি আল্লাহু আনহু আবু মুসা আশআরীর কাছে ন্যায়বিচারের মৌলিক নীতিমালার বিস্তারিত উল্লেখ করে যে পত্র দিয়েছিলেন সেটিকে আইন শাস্ত্রের মূল্যবান দলিল হিসেবে রােমান আইনের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। বিচারের সমতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে খলিফা ছিলেন যত্নশীল। আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের উদ্দেশ্যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আদালতে উপস্থিত হতেন। 

একবার খলিফাকে ফরিয়াদী হিসেবে কাজী জায়েদ বিন সাবিতের আদালতে উপস্থিত হতে হল। কাজী খলিফার প্রতি পৃথক সম্মান প্রদর্শন করলে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে বলেছিলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি একজন সাধারণ নাগরিক ও ওমরকে সমানভাবে বিবেচনা করতে সক্ষম না হবেন ততদিন পর্যন্ত আপনি কাজী পদের উপযুক্ত নন।

সিরিয়ার একটি ছােট প্রদেশের গভর্নর জাবালা বিন আল আইহাম গাসানী ইসলাম গ্রহণ করার পর হজ পালনকালে তার কাপড়ের একটি অংশের উপর এক দরিদ্র আরবের পা পড়েছিল নিতান্তই অনিচ্ছাকৃতভাবে। জাবালা তার গালে একটি চড় কষালেন। আরব একটিও একইভাবে তার প্রত্যুত্তর দিল। ক্রোধে উন্মত্ত জাবালা কালবিলম্ব না করে খলিফার কাছে উপস্থিত হয়ে উক্ত আরবকে কঠোর শাস্তি দেয়ার দাবি জানালেন। 

খলিফা সব শুনে বললেন যে, তিনি ইতিমধ্যে ন্যায়বিচার লাভ করেছেন। জাবালা ত্রুুদ্ধ হয়ে বললেন যে, "লােকটি যদি আমার এলাকায় আমাকে এভাবে অপমান করত তাহলে তাকে ফাঁসিতে জুলাতাম।" খলিফা শান্তভাবে জবাব দিলেন, “এ ধরনের আচরণ ছিল ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে। কিন্তু এখন ইসলামের দৃষ্টিতে ভিক্ষুক ও রাজপুত্রের মর্যাদা সমান।”

হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহুর নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা এত কঠোরভাবে কার্যকর হয়েছিল যে, কোন অন্যায়ের দায় থেকে তার নিকটজনও রেহাই পেত না। একদিন তার পুত্র আনু শাহমার বিরুদ্ধে মদ্যপানের অভিযােগ এল। খলিফা তাকে নিজ হাতে বেত্রাঘাত করতে করতে মেরেই ফেললেন। কিন্তু তখনাে বেত্রাঘাত পূর্ণ হয়নি। পুত্রের কবরের উপর তিনি অবশিষ্ট বেত্রাঘাত কররেন। ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের প্রতি নিষ্ঠার এমন দৃষ্টান্ত বিশ্ব ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি নেই।

সেনাবাহিনীর প্রশাসনকে সুষ্ঠ ও সুসংগঠিত করার ব্যাপারে খলিফা ওমর (রাঃ) অত্যন্ত মনােযােগী ছিলেন। তিনি মদিনা, কুফা, বসরা, ফুস্তাত, দামেশক, হেমসু, ফিলিস্তিনসহ বহু স্থানে সৈন্য শিবির স্থাপন করেন। একটি সুদক্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তােলার প্রয়ােজন সম্পর্কে তার আগ্রহ ছিল সীমাহীন। সেনাবাহিনীকে তিনি নিয়মিত ও স্বেচ্ছাসেবী বা সংরক্ষিত বাহিনীতে বিভক্ত করেন। আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ায় ছিল বিরাট সেনানিবাস। 

বিজ্ঞ খলিফা সেনাবাহিনীর বিভিন্ন বিভাগ গঠন করেন এত নিপুণতার সাথে যে এক্ষেত্রে তার অভিজ্ঞতা দেখে কেউ বিস্মিত না হয়ে পারে না। তিনি সেনাবাহিনীর নামাযের জামায়াতে ইমামতি করতেন। উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সৈয়দ আমীর আলীর মতে, "মুসলিম সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব ছিল চূড়ান্ত গতিশীলতা, অধ্যাবসায় ও সহনশীলতার সমন্বয়। তার সাথে যােগ্যতা এবং উৎসাহ যুক্ত হওয়ায় তারা অজেয় বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল।” 

খলিফা ওমর রাদি আল্লাহু আনহুর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়েছে অমুসলিমদের প্রতি তাঁর সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে রােমান ও পারস্য সাম্রাজ্যে অন্য জাতির অধিকার ক্রীতদাসদের চাইতেও খারাপ অবস্থায় ছিল। এমনকি সিরিয়ার খ্রিস্টানদের তাদের জমির উপর অধিকার পর্যন্ত ছিল না। জমির মালিকানা হস্তান্তরের সাথে সাথে তারাও হস্তান্তরিত হত। 

হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহু যখন এ দেশগুলাে জয় করেন তখন তিনি স্থানীয় কৃষকদের কাছে জমি ফিরিয়ে দেন, যাদের অধিকাংশই ছিল অমুসলিম। এলিয়ার আত্মসমর্পণকৃত খ্রিষ্টানদের সাথে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। শান্তিচুক্তির শর্ত ছিল নিম্নরূপঃ

“এলিয়াবাসীদের জন্য আল্লাহর দাস হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহুর অনুমােদিত চুক্তি অনুযায়ী অমুসলিমদেরকে তাদের গীর্জায় অবস্থানের অনুমতি দেয়া হবে এবং গীর্জাগুলাে ধংস করা হবে না। তারা স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করতে পারবে এবং অন্য কোনভাবে তাদের কোন ক্ষতি করা হবে না।"

ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহির মতে, একেবার এক মুসলিম জনৈক খ্রিস্টানকে হত্যা করে। বিষয়টি খলিফার গােচরে আনা হলে তিনি নিহত খ্রিষ্টানের উত্তরাধিকারীকে হত্যার বদলা নেয়ার অনুমতি প্রদান করেন এবং হত্যাকারী মুসলমানের শিরচ্ছেদ করা হয়। 

রাষ্ট্রীয় বিষয়ে প্রয়ােজনে তিনি অমুসলিমদের সাথে পরামর্শ করতেন। "কিতাব আল খারাজ' গ্রন্থের রচয়িতা উল্লেখ করেন, ওমর রাদি আল্লাহু আনহুর অন্তিম ইচ্ছায় অমুসলিমদের প্রতি প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল হওয়ার জন্য মুসলমানদের প্রতি তাগিদ ছিল। নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও অমুসলিমদের জানমাল রক্ষার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। খলিফা তাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু ছিলেন। এমনকি কখনও তাদের কোন চক্রান্তও তিনি ক্ষমা করে দিতেন।

মুসলমানদের এহেন সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহারের অমুসলিমরা এত মুগ্ধ হয়েছিল যে কোন কোন ক্ষেত্রে তারা স্ব-ধর্মাবলম্বীদের চেয়েও মুসলমানদের প্রাধান্য দিয়েছে। হেমসের খ্রিষ্টান ও ইহুদীরা মুসলমানদের ফিরে আসার জন্য প্রার্থনা করেছে। সন্দেহ নেই যে, খলিফা অমুসলিমদের নিরাপত্তার জন্য 'জিজিয়া' ধার্য করেছিলেন। কিন্তু যেসব অমুসলিম মুসলিম বাহিনীতে যােগ দিয়েছিল তাদের নিকট হতে এই কর আদায় করা হয়নি।

অমুসলিমদের প্রতি এ ধরনের উদার ব্যবহারের মাধ্যমে খলিফা সকল প্রজার প্রিয়পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। এর ফলে তার পক্ষে একটি স্থিতিশীল সরকার ও দক্ষ প্রশাসন গড়ে তােলা সম্ভব হয়েছিল। নজীরবিহীন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন খলিফা ওমর রাদি আল্লাহ আনহু। তিনি যা বলতেন তা পালন করতেন। জনগণের কল্যাণ সাধন তার জীবনের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল। তিনি তার ধার্মিক ও শিক্ষিত পুত্র আবদুল্লাহর প্রতিও কখনাে আনুকূল্যে প্রদর্শন করেননি। 

মাসিক ভাতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবাদের অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এর বাইরে তিনি কুরাইশ বংশােদ্ভুত ও দাসদের মধ্যে সমতার নীতি অনুসরণ করেছেন। তিনি যখন পুত্র আবদুল্লাহর চাইতে উসামা বিন জায়েদের বেতন অধিক ধার্য করেন তখন তার পুত্র অভিযােগ করল যে "ইসলামের সেবায় উসামা আমাকে কখনাে অতিক্রম করতে পারেনি।" খলিফা সাথে সাথে উত্তর দিলেন, "কিন্তু সে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘনিষ্ট ও প্রিয়ভাজন ছিল।”

মানবতার সেবায় খলিফার অপরিসীম মনােযোগ ছিল। জনগণের অবস্থা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের জন্য তিনি সকলের অজান্তে রাতের অন্ধকারে জনপদে ঘুরে বেড়াতেন। এক রাতে তিনি মদিনার উপকণ্ঠে ঘুরছিলেন। সহসা লক্ষ্য করলেন, একজন মহিলা কিছু রান্না করছে এবং তার পাশে দুটি বালিকা খাবারের জন্য কাঁদছে। কিছু সময় অপেক্ষা করে তিনি মহিলার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস কররেন যে ব্যাপার কি? মহিলাটি তাকে জানাল যে, ক্রন্দনরতা মেয়ে দুটি খুবই ক্ষুধার্ত। 

হাড়িতে কিছু পাথরের টুকরাে পানিতে ছেড়ে দিয়ে মেয়ে দু'টিকে আশ্বাস দিচ্ছেন যে, তাদের জন্য খাবার পাকানাে হচ্ছে। খলিফা কালবিলম্ব না করে মদিনায় ফিরে এলেন এবং মদিনা থেকে তিন মাইল দূরে সেই মহিলার বাড়িতে নিজের কাঁধে বয়ে নিয়ে গেলেন এক বস্তা আটা। নিজ হাতে তিনি রুটি তৈরি করে মেয়ে দুটিকে পরিতৃপ্তি সহকারে খাইয়ে নিজে পরিতৃপ্ত হলেন। পরদিন তিনি মহিলার কাছে পরিচয় দিয়ে নিজের কর্তব্যে অবহেলার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং তার জন্য একটি ভাতা নির্ধারণ করে দিলেন।

মহান খলিফা অত্যন্ত সহজ সরল জীবন যাপন করতেন। একজন সাধারণ নাগরিকের চেয়ে তার জীবনযাত্রার মান কোনভাবেই উন্নত ছিল না। এক বার কুফার গভর্নর তার সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখতে পেলেন যে, খলিফা যব দিয়ে তৈরি রুটি খাচ্ছেন জলপাই এর তেল মেখে। গভর্নর তাকে বললেন, “আমীরুল মােমেনীন, আপনার সাম্রাজ্যে পর্যাপ্ত গম উৎপাদিত হয়েছে। 

তা সত্ত্বেও আপনি গমের আটার রুটি খাচ্ছেন না কেন?" খলিফা কিছুটা বিরক্ত হয়েই জবাব দিলেন, আপনার কি ধারণা যে, আমার খেলাফতের প্রতিটি লােকের কাছে গমের প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়েছে গভর্নর উত্তর দিলেন, "না, তা হয়নি। খলিফা তখন বললেন, “প্রতিটি নাগরিকের গমের রুটি না জুটলে আমি কি করে খাব?"

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রাঃ)-এর চরিত্রের শ্রেষ্ঠ গুণ ছিল সততা। একবার তার অসুস্থতার সময় চিকিৎসক মধু সেবনের ব্যবস্থাপত্র দিলেন। বায়তুল মালে তখন প্রচুর মধু জমা ছিল। কিন্তু জনগণের পরিষদ কর্তৃক অনুমােদনের পূর্বে তিনি এক ফোটা মধুও গ্রহণ করলেন না। রােমের সম্রা্জ্ঞীর কাছে খলিফার স্ত্রী উম্মে কুলসুম কয়েক বােতল সুগন্ধি প্রেরণ করেছিলেন। সম্রাজ্ঞী বােতলগুলাে মূল্যবান প্রস্তরখণ্ডে বর্তি করে ফেরত পাঠালেন। খলিফা বিষয়টি জানতে পেরে মূল্রবান পাথরগুলাে বায়তুল মালে জমা দিয়ে দিলেন।

মানুষের সামাজিক সাম্যের প্রতি খলিফা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। খলিফা কর্তৃক দেহরক্ষীকে উটের পিঠে বসিয়ে নিজে উটের লাগাম ধরে জেরুসালেমে উপনীত হওয়ার ঘটনায় জেরুসালেমের নগরপাল অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। আবদুর রহমান বি আউফের বক্তব্য অনুসারে একদিন খলিফা তার কাছে আসেন এবং তিনি তার সাথে এক স্থানে যাওয়ার জন্য বললেন। 

জিজেস করে আবদুর রহমান জানতে পারলেন যে, একটি কাফেলা মদিনায় এসেছে। কাফেলার সদস্যরা পথশ্রমে ক্লান্ত। সেজন্যে খলিফা সারারাত ধরে তাদের পাহারা দেয়া আবশ্যিক কর্তব্য মনে করছেন যাতে তারা নিরাপদে নিদ্রা যেতে পারে।

একবার এক জনসমাবেশে বক্তৃতা দানকালে খলিফা ওমর রাদি আল্লাহু আনহু বললেন, আমি যদি সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হই তাহলে আপনারা কি করবেন?" এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, আপনার মাথা কেটে ফেলব।" ওমর রাদি আল্লাহু আনহু তাকে পরখ করার জন্য চীকার করে বললেন, তুমি আমাকে এভাবে বলার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছ।" লােকটি উত্তর দিল, “হ্যা, দেখাচ্ছি।” লােকটির সাহসিকতায় ওমর রাদি আল্লাহু আনহু সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া, আমার জাতির মধ্যে এমন সাহসী মানুষ রয়েছে যে, আমি ভুল পথে গেলে তারা আমাকে সঠিক পথ দেখাবে।

ইসলামের মহান নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহুর মধ্যে বহুমুখী প্রতিভা ও যােগ্যতার প্রমাণ পেয়ে বলেছেন, "আল্লাহ যদি আমার পর আর কাউকে নবী হিসেবে প্রেরণ করতে চাইতেন তাহলে তিনি ওমর ছাড়া আর কেউ হতেন না।”

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহু বিশ্ব ইতিহাসে অত্যন্ত মর্যাদার আসনে সমাসীন। একজন মানুষের মধ্যে এমন গুণের সমাহার দেখা অসম্ভব ব্যাপার যে, তিনি শাসক হয়েও সাধারণ জীবনযাপন করেন এবং জনগণের সেবায় নিবেদিত প্রাণ এবং শত্রুদের কাছে আতংক। মিশরীয় ইতিহাসবিদ জুরজী জাইদানের ভাষায়, “তিনি অনেক দেশ জয় করেন। পারস্য ও রােমান সম্রাটদেন সম্পদের ভাঙ্গার স্রোতের মত তার সৈন্যদের হাতে পড়ে। 

তবুও ভােগবিলাসের প্রতি যে অনীহা তিনি প্রদর্শন করেছেন তা নজীরবিহীন। তিনি জনগণের সামনে বক্ততা দিতেন তালি দেয়া জামা পরিধান করে। জনগণের উদ্দেশ্যে যা বলতেন সে বিষয়ে নিজে প্রথমে অভ্যস্ত হতেন। গভর্ণ র ও সেনাপতিদের উপর তিনি কড়া দৃষ্টি রাখতেন এবং তাদের আচরণের জন্য প্রশ্ন করতেন। এমনকি খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদি আল্লাহু আনহুকেও তিনি ছেড়ে কথা বলেননি। সকল মানুষের প্রতি তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ এবং অমুসলিমদের প্রতি অত্যন্ত সদয়।

আরও পড়ুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ