হযরত আলী রাদি আল্লাহু আনহুর জীবনী
ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী রাদি আল্লাহু আনহু ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তাঁর বীরত্ব, জ্ঞান, ধর্মানুরাগ, চিন্তার স্বচ্ছতা এবং কল্পনাশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। সাহসিকতার কারণে তার খ্যাতি অর্জিত হয়েছিল আল্লাহর সিংহ বলে। শিক্ষা তাঁকে খ্যাতি দিয়েছিল জ্ঞানের দরজা হিসেবে।
তিনি বীরত্ব, মানবিক গুণাবলী ও ক্ষমাশীলতার কারণে তাঁর সময়ের সেরা মানুষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহু তার খেলাফত পরিচালনাকালে জনকল্যাণের জন্য যেসব বড় বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন তার অধিকাংশই ছিল হযরত আলী রাদি আল্লাহু আনহুর পরামর্শক্রমে।
হাতীর বছরের তের বছর পর আলী ইবনে আবু তালিব জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভ্রাতুস্পুত্র এবং তার গােত্র বনি হাশিম পবিত্র কাবাঘরের রক্ষণাবেক্ষণের মত মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিল।
বিরাট এক পরিবারের কর্তা আবু তালিব তার পুত্র আলী রাদি আল্লাহু আনহুকে ইসলামের নবীর হেফাজতে ন্যস্ত করলেন। ফলে শৈশব থেকে তিনি তার দেখাশুনা ও লালন-পালন করেন।
আলী রাদি আল্লাহু আনহর মধ্য যে বিভিন্ন গুণের সমাবেশ ঘটেছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্যে সেসবের চমৎকার বিকাশ ঘটে।
মক্কা হতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মদীনায় হিজরতের সময় আলী রাদি আল্লাহু আনহু নজীরবিহীন সাহসিকতাপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
মক্কাবাসীদের অব্যাহত নিপীড়ন ও হুমকির মধ্যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহ আনহুকে সাথে নিয়ে গােপনে মদিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
হযরত আলী রাদি আল্লাহ আনহকে মক্কায় রেখে যাওয়া হয় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে যারা মূল্যবান জিনিস আমানত রেখেছিল সেগুলাে তাদেরকে ফেরত দেয়ার জন্যে।
দুশমন পরিবেষ্টিত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাড়িতে আলী রাদি আল্লাহু আনহু নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে রইলেন।
আলী রাদি আল্লাহু আনহু অত্যন্ত সহজ সরল জীবনযাপন করতেন। দৈহিক পরিশ্রমে অর্জিত অর্থে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। তিনি তার সম্পত্তিতে কোন কিছুই যােগ করতে পারেননি।
তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী নবী দুলালী হযরত ফাতেমা রাদি আল্লাহু আনহা নিজ হাতে গৃহস্থালীর যাবতীয় কাজ করতেন। মানব ইতিহাসে চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও মানবতা, দানশীলতা ও আত্মত্যাগের চেতনায় উজ্জীবিত এমন আদর্শ দম্পত্তির জুড়ি খুঁজে পাওয়া যায় না।
ইসলামের মহান বাণী ইয়েমেনে পৌছে দেয়ার জন্যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলী রাদি আল্লাহু আনহুকে নির্বাচন করেছিলেন। তার পূর্বে যারা সেখানে ইসলাম প্রচার করতে গিয়েছিল তারা ব্যর্থতা বরণ করে ফিরে এসেছিল।
আলী রাদি আল্লাহু আনহুর মিশন সফল হলাে এবং হামদান উপজাতির লােকেরা ইসলাম গ্রহণ করলাে। আলী রাদি আল্লাহু আনহু বিচক্ষণতা এবং জনগণকে উদ্বদ্ধ করার ক্ষমতা শত্রুভাবাপন্ন এলাকাসমূহে ইসলামকে জনপ্রিয় করে তােলার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে।
ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইতিহাসে আলীর অবদান স্মরণীয় হয়ে আছে। আলী রাদি আল্লাহু আনহু ছিলেন অসম সাহসী, যা তিনি নিবেদন করেছিলেন ইসলামের সেবায়। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় শুধুমাত্র তাবুকের যুদ্ধে তিনি অংশ নিতে পারেননি। এছাড়া সকল যুদ্ধে তিনি বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
বদরের যুদ্ধে হযরত আলী রাদি আল্লাহু আনহু প্রথমবারের মত অসীম সাহসিকতা প্রদর্শন করেন। আরবের দু’জন বিখ্যাত যােদ্ধা ওয়ালিদ ও শেবাকে তিনি যুদ্ধে পরাস্ত করেন।
ওহদের যুদ্ধে ইসলামের পতাকাবাহী বীর শাহাদাত বরণ করলে হযরত আলী রাদি আল্লাহু আনহু পতাকা তুলে নেন এবং শত্রুর পতাকাবাহীকে হত্যা করেন। (উইকিপিডিয়া)
দুই বছর পর আরবের বিখ্যাত যােদ্ধা আমর ইবনে আবর ওদের সাথে আলী রাদি আল্লাহু আনহু দ্বন্দ্বযুদ্ধ হয় এবং আমর নিহত হয়। সকল সামরিক অভিযানের মধ্যে তার সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য অভিযান ছিল খায়বার দুর্গ দখল।
খায়বার দুর্গকে বিবেচনা করা হতাে অজেয় ও দুর্ভেদ্য হিসেবে। ইহুদীরা শক্ত অবস্থান নিয়েছিল এইদুর্গে এবং হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু ও হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে মুসলমানদের বেশ কয়েকটি হামলার পরও দুর্গের পতন হয়নি।
এরপর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, আগামী দিন ইসলামের পতাকা এমন এক ব্যক্তির হাতে দেয়া হবে যে দুর্গ দখল করবে। সেই ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তাঁকে ভালবাসেন।
পরদিন সকালে তিনি আলী রাদি আল্লাহু আনহুকে তলব করলেন। ঘটনাচক্রে তখন হযরত আলী রাদি আল্লাহু আনহু দারুণ চক্ষু পীড়ায় ভুগছিলেন।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার থুথু আলী রাদি আল্লাহু আনহুর চোখে লাগিয়ে দিলেন এবং তার হাতে ইসলামের পতাকা অর্পন করলেন। আলী রাদি আল্লাহু আনহুর প্রচন্ড হামলায় খায়বার দুর্গের বিশাল দরজা ভেঙ্গে পড়লাে।
হযরত আলী রাদি আল্লাহু আনহু মানবিক দয়া ও বদান্যতার প্রচুর দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরাজিতদের ক্ষমা প্রদর্শন করেন।
একবার এক অভিযানে তার প্রতিপক্ষ যােদ্ধা ভূমিতে পতিত হয়ে উলঙ্গ হয়ে গেলে তিনি এক পাশে সরে দাঁড়ালেন। ইবনে সাদ রাদি আল্লাহু আনহুর মতে, যখন তার আক্রমণকারী ইবনে মুলজামকে তার সামনে আনা হলাে, তিনি তার সাথে সদয় আচরণ করার নির্দেশ দিলেন।
হযরত আলী রাদি আল্লাহু আনহু প্রথম দুই খলিফার আমলে তাদের মুখ্য উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সকল জটিল সমস্যার সমাধান করতেন এবং তার পরামর্শ ছাড়া দুই খলিফার কেউই গুরুত্বপূর্ণ কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন না।
সকল বিষয়ে তার পরামর্শ নেয়া হতাে। বিশেষ করে আইন ও ধর্মীয় বিষয়ে তাকে বিশেষজ্ঞ বিবেচনা করা হতাে। জাতি-ধর্ম, বন্ধু-শত্রু নির্বিশেষে সকলে তার বিচারবুদ্ধি ও সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতাে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকারের পর আলী রাদি আল্লাহু আনহু নতুন আদর্শে বিশ্বাসীদের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃক্তিক বিকাশের লক্ষ্যে আত্মনিয়ােগ করেন।
হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহুর আমলে অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদক্ষেপ বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল আলী রাদি আল্লাহু আনহুর উপর। আলী রাদি আল্লাহু আনহু ইসলামের চতুর্থ খলিফা নির্বাচিত হন হযরত ওসমান রাদি আল্লাহু আনহুর শাহাদাতের পর।
তকন গােটা মুসলিম জগত ছিল গােলযােগপূর্ণ এবং দুষ্কৃতিকারীরা মদিনা অবরােধ করে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। তার নিকট আনুগত্যের শপথ নেয়ার প্রশ্নে মদিনা ও পার্শ্ববর্তী প্রদেশগুলাের বাসিন্দারা একে অন্যের সাথে প্রতিযােগিতায় লিপ্ত হলাে।
কারণ, রাষ্ট্রের এই সর্বোচ্চ পদের জন্য তিনি ছিলেন সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি। কিন্তু হযরত মুয়াবিয়া রাদি আল্লাহু আনহু ইতিমধ্যে শক্তিবৃদ্ধি করেছিলেন। তিনি হযরত ওসমান রাদি আল্লাহু আনহুর হত্যাকান্ডের প্রতিশােধ গ্রহণের আওয়াজ তুললেন।
মুয়াবিয়া রাদি আল্লাহু আনহু যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন যে আলী রাদি আল্লাহু আনহুর বর্তমানে তার পক্ষে খলিফার পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। সে জন্যে তিনি জনসমর্থন আদায়ের উপায় অনুসন্ধান করছিলেন।
বিদ্রোহীরা ছিল শক্তিশালী এবং তড়িঘড়ি কোন পদক্ষেপ নিলে তা নতুন রাষ্ট্রের অখন্ডতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই প্রশ্নে আলী রাদি আল্লাহু আনহু বিরত ছিলেন। তা না হলে তিনি কঠোর হাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের দমন করতে চেয়েছিলেন।
হযরত তালহা এবং জুবায়ের রাদি আল্লাহু আনহুমা ওসমান রাদি আল্লাহু আনহুর ঘাতকদের অবিলম্বে শাস্তি প্রদানের দাবি জানাচ্ছিলেন। আলী রাদি আল্লাহ আনহু তাদের বলেন, এ ব্যাপারে আমিও কম উদ্বিগ্ন নই।
কিন্তু আমার করার কিছুই নেই। এখন খুব সংকটকাল । যদি কোন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় তাহলে বেদুঈন ও বিদেশীরা বিদ্রোহী ঘােষণা করবে এবং আরব আবার ফিরে যাবে আইয়ামে জাহেলিয়ায়। এই লোকগুলো এখনাে আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অপেক্ষা করাে এবং দেখাে আল্লাহ এই কঠিন অবস্থা থেকে বের হবার কোন পথ অবশ্যই দেখাবেন।
হযরত আলী রাদি আল্লাহু আনহু ওসমান রাদি আল্লাহু আনহুর হত্যাকান্ডের ঘটনার শাস্তিমূলক নিম্পত্তির সকল সম্ভাবনা নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করেন। এই হত্যাকান্ডে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী হযরত আয়েশা রাদি আল্লাহু আনহা গভীরভাবে আপ্লত হয়েছিলেন।
তিনি হযরত তালহা ও জুবায়ের রাদি আল্লাহু আনহুমার সাথে বসরায় পৌছেন। আলী রাদি আল্লাহু আনহু পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অবিলম্বে সেখানে গমন করেন।
হিজরী ৩৬ সনের ১২ই রজব কুফায় খলিফাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানানাে হয় এবং তার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য কুফার প্রাসাদে ব্যাপক আয়ােজন করা হয়। কিন্তু সরলতার প্রতিমূর্তি হযরত আলী রাদি আল্লাহু আনহু জাকজমকপূর্ণ আয়ােজন প্রত্যাখ্যান করে খােলা প্রান্তরে স্থাপিত শিবিরে অবস্থান করলেন।
দুই বাহিনী মুখােমুখি অবস্থান নিয়েছে। হযরত আলী রাদি আল্লাহু আনহু ও হযরত আয়েশা রাদি আল্লাহু আনহু উভয়েই সংঘাত এড়িয়ে আপােষ মীমাংসা করতে চাইছিলেন।
কিন্তু এ ধরনের উদ্যোগ ছিল সবার অনুসারীদের হীন স্বার্থের বিরুদ্ধে। অথচ তারাই হযরত আলী রাদি আল্লাহু আনহুর বাহিনীর একটি অংশ।
তাদের এক রাতে নিষ্পত্তি যখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে তখনই তারা প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাে এবং যুদ্ধ শুরু হলাে। উভয় পক্ষই যুদ্ধ শুরুর জন্য একে অপরকে সন্দেহ করল।
আলী রাদি আল্লাহু আনহু যােদ্ধাদের উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা হিসেবে হযরত জুবায়ের রাদি আল্লাহু আনহুকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি ভবিষ্যদ্বাণী শুনালেন। এর ফলে হযরত জুবাইর তৎক্ষনাৎ সৈন্য প্রত্যাহারে উদ্বুদ্ধ হলাে।
তিনি যখন মক্কায় ফিরে এসেছিলেন তখন সবার অনুসারী একজন তাকে হত্যা করে জুবায়েরের ছিন্ন মস্তক আলী রাদি আল্লাহু আনহুর সামনে উপস্থিত করলে তিনি অত্যন্ত ক্রদ্ধ হয়ে বলেন, জুবায়ের রাদি আল্লাহু আনহুর হত্যাকারীকে জাহান্নামের খবর দাও।
শেষ পর্যন্ত আয়েশা রাদি আল্লাহু আনহার নেতৃত্বাধীন সৈন্যেরা পরাজিত হয় এবং খলিফা স্বয়ং সর্বজনশ্রদ্ধেয়া এই নারীর কাছে হাজির হয়ে তার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নেন এবং তাকে সসম্মানে মদীনায় প্রেরণ করা হয়।
ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে ঝঞ্চাবিক্ষুব্ধ এক সময়ে আলী রাদি আল্লাহু আনহু খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হন। সাহসিকতা এবং বিচক্ষণতার গুণে গুণান্বিত আলী রাদি আল্লাহু আনহু ছাড়া ইসলামের ভিত্তিমূলে আঘাত হানার উদ্দেশ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দ্বিতীয় আর কেউ ছিল না।
আলী রাদি আল্লাহু আনহু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছায়ায় ও যত্নে লালিত এবং প্রায় তার ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে কাটানাের দুর্লভ সুযােগ লাভ করেছিলেন।
ফলে তিনি রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবাদের মধ্যে সেরা বুদ্ধিজীবী হিসেবে মর্যাদা লাভ করেন। ইমাম হাম্বল রাহমাতুল্লাহি আলাইহি সাহাবাদের মধ্যে আলী রাদি আল্লাহু আনহুকে সবচেয়ে বড় বুদ্ধিজীবী হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং বলেছেন, আমি জ্ঞান আহরণকারী গৃহ আর আলী হচ্ছে তার দরজা।
আলী রাদি আল্লাহু আনহু ছিলেন কোরআনে হাফেজ এবং তাঁর তাফসীর ছিল অত্যন্ত উঁচুমানের। ইবনে আব্বাস রাদি আল্লাহু আনহুর মত তাঁকেও কোরআনের বড় ব্যাখ্যাকার বিবেচনা করা হয়।
হযরত আলী রাদি আল্লাহু আনহু তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ মুজতাহিদ ও আইনজ্ঞ ছিলেন। সকল জটিল সমস্যার সমাধান করতেন তিনি। তার পূর্ববর্তী তিন খলিফার আমলে তিনি ধর্মীয় ও আইন বিষয়ে তাদের মুখ্য উপদেষ্টা ছিলেন।
কোন জটিল সমস্যা এলেই তার কাছে প্রেরিত হতাে এবং সে ব্যাপারে তার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হতাে। এমনকি হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহু ও হযরত আয়েশা রাদি আল্লাহু আনহার মতাে ব্যক্তিত্বও তাদের সমস্যা আলী রাদি আল্লাহু আনহুর কাছে পেশ করতেন।
একবার দুই মহিলা একটি শিশুকে নিজ নিজ সন্তান দাবি করে ঝগড়া করছিল। তাদেরকে আলী রাদি আল্লাহু আনহুর সামনে উপস্থিত করা হলাে। উভয় দাবিদারদের বক্তব্য শােনার পর আলী রাদি আল্লাহু আনহু শিশুটিকে দ্বিখন্ডিত করার নির্দেশ ধিলেন।
এই সিদ্ধান্তে শিশুর প্রকৃত মা আতংকগ্রস্ত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে খলিফার কাছে শিশুটির জীবনরক্ষার আবেদন জানালাে। এভাবে তিনি প্রকৃত মাকে সনাক্ত করে শিশুকে তার কোলে তুলে দিলেন এবং ভুয়া দাবিদার মহিলার শাস্তি বিধান করলেন।
আলী রাদি আল্লাহু আনহুর প্রশাসন অংশীদারিত্ব, পক্ষপাতিত্ব ও স্বজন-প্রীতি হতে মুক্ত ছিল। তার গভর্নরদের ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। তাদের কর্মকান্ডের উপর কড়া নজর রাখতেন।
একবার তার নিজ চাচাত ভাই ইবনে আব্বাস রাদি আল্লাহু আনহু যিনি বসরার গভর্নর ছিলেন, তিনি বায়তুল মাল হতে নিজের ব্যয়ের জন্য কিছু অর্থ নিলেন।
আলী রাদি আল্লাহু আনহ এ ব্যাপারে প্রশ্ন তুললে ইবনে আব্বাস রাদি আল্লাহু আনহু এতােই ভীত হয়ে পড়েছিলেন যে, মক্কার উদ্দেশ্যে তিনি বসরা ত্যাগ করেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রদর্শিত পথ থেকে সামান্য বিচ্যুতির কারণে হযরত আলী রাদি আল্লাহু আনহু প্রিয়জনকেও ছেড়ে দিতেন না।
সৈয়দ আমীর আলী বলেন, আলী রাদি আল্লাহু আনহুর প্রশাসন গৃহযুদ্ধের ফলে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় ছিল। কিন্তু তিনি দুর্নীতিপরায়ণ গভর্নরদের অপসারণ করে হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহুর গৃহীত নীতিমালা পুনরায় চালু করেন।
গৃহযুদ্ধের আগুন থেকে তিনি নবীন ইসলামী রাষ্ট্রকে রক্ষা করে প্রশাসনকে সুবিন্যস্ত করেন। অভ্যন্তরীন গােলযােগ সত্ত্বেও তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা বিস্তত করেন।
খলিফা আলী রাদি আল্লাহু আনহু খারেজীদের হত্যাকান্ডের শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। তিনজন খারেজী হযরত আলী, হযরত আমীর মুয়াবিয়া ও হযরত আমর ইবনে আল আস রাদি আল্লাহু আনহুমকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
ইবনে মাজম নামে এক খারেজীর উপর খলিফা হযরত আলী রাদি আল্লাহু আনহুকে হত্যার দায়িত্ব দেয়া হলে সে খলিফাকে নামাযরত অবস্থায় আঘাত করে। মৃত্যুর পূর্বেও খলিফা তার ঘাতকের সাথে সদাচরণের নির্দেশ দেন।
এভাবে ইসলামের এক মহানায়ক ৬৩ বছর বয়সে শাহাদাত বরণ করেন। খলিফা হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালনের মেয়াদ ছিল ৪ বছর ৯ মাস।
সবচেয়ে ঝড়ো অবস্থার মধ্যে তিনি ইসলামের তরীকে তার লক্ষ্যে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। খলিফা হযরত আলী রাদি আল্লাহু আনহুর শাহাদাতের মধ্য দিয়ে খােলাফায়ে রাশেদার স্বর্ণযুগের অবসান ঘটে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর চারজন উত্তরাধিকারী সহজ সরল জীবনযাপনের যে নজীর রেখে গেছেন তা রাষ্ট্র শাসনের ইতিহাসে নজীরবিহীন হয়ে আছে।
বিশাল ইসলামী সাম্রাজ্যের শাসক হয়েও তারা দরবেশের জীবনযাপন করেছেন এবং পার্থিব ধনবানদের দিকে কখনও ফিরে তাকাননি। সাধারণ মানুষের চাইতেও সাধারণ ছিল তাদের জীবন। তাদের জীবনাদর্শে রয়েছে সর্বকালের মানুষের অনুপ্রেরণার মূল উৎস।
আরও পড়ুন
* হযরত ওমর ফারুক (রা.) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
* হযরত ওসমান গণি (রাঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
* হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) জীবনী
0 মন্তব্যসমূহ