নতুন পোস্ট

6/recent/ticker-posts

বিখ্যাত মনীষী হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) এর জীবনী বাংলা

 

বিখ্যাত মনীষী হযরত হাতেম আসাম (রাঃ)

বিখ্যাত মনীষী হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) জীবন কাহিনী

বিখ্যাত মনীষী হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) ছিলেন খােরাসানের অধিবাসী। ত্যাগ-তিতিক্ষা, তার উপাসনা মানুষের মর্যাদাকে বহু উচ্চে স্থাপন করে। তার সততা, তাঁর ধর্মভীরুতা এক কথায় নজিরবিহীন। বয়ােপ্রাপ্ত হয়ার পর জীবনের একটি মুহুর্তও তিনি আল্লাহর জিকির ছাড়া অতিবাহিত করেননি। তাঁর সমগ্র জীবন বস্তুত এক অন্তহীন উপাসনা। তাঁর মুর্শীদ ছিলেন, তাপসপ্রবর হযরত শাকীক বলখী (র)। আর অন্যতম প্রিয় মুরীদ ছিলেন হযরত আহমদ হাবর (রাঃ)।

হযরত হাতেম আসাম (র) সম্বন্ধে হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (র) বলেন, তিনি একালের সিদ্দিক। তাঁর অমূল্য বাণী প্রবৃত্তি দমনে, তার প্ররােচনা থেকে আত্নরক্ষায় খুব বেশি কার্যকর। তার তত্ত্ব ও তথ্যমূলক রচনাবলী আল্লাহর পথের পথিকগণের জন্য খুবই মূল্যবান।

একবার মরীদগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, যদি পৃথিবীর লােক তােমাদের জিজ্ঞেস করে হাতেম আসামের কাছে তােমরা কী শিখেছ, বলবে আমরা তার কাছে বিদ্যা শিখেছি। যদি তারা বলে, হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) তাে সে ধরনের আলেম ছিলেন না, তিনি তাে তত্ত্বজ্ঞানী ও নন। তখন তােমরা বলবে, আমরা তার কাছে দুটি বস্তু শিখেছি। এক নিজের কাছে যা রয়েছে তাতে খুশি থাকা। দুই, অন্যের কাছে যা আছে, তার আশা না করা।

একটি ঘটনা সুত্রে তাঁর আসাম পদবি মূল নামের সঙ্গে যুক্ত হয়। একদিন এক মহিলা তার কাছে এলেন একটি মাসায়ালা জিজ্ঞেস করতে। হঠাৎ সশব্দে তাঁর বায়ু নিঃসরণ হয়। মহিলা খুব লজ্জা পেলেন। যাই হােক, তিনি মাসায়ালা জিজ্ঞেস করলেন, তখন হাতেম আসাম (রাঃ) বললেন, আমি আসাদ বাক্তি (অর্থাৎ কানে কম শুনি)। সুতরাং যা বলবে, একটু জোরেই বলবে। 

মহিলা একটু স্বস্তি পেলেন। লজ্জার ভাব কেটে গেল। এরপর বেশ জোরেই তিনি তাঁর বক্তব্য বিষয় পেশ করলেন । আর হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) তার যথাযথ উত্তরও দিলেন। আসলে তিনি কানে কম শুনতেন না। শুধু মহিলার লজ্জা দূর করে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতেই কানে কম শােনার কথাটা বলেছিলেন। শােনা যায়, ঐ মহিলা যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন তিনি ঐ রকমেই ভান করতেন। সেদিন থেকে তার নামের সঙ্গে আসাম যুক্ত হয়।

একবার বলখের এক জনসমাবেশে মােনাজাত করার সময় তিনি বললেন, হে দয়াময়, আপনি এ জলসার সবচেয়ে পাপীকে মার্জনা করুন। ঘটনাক্রমে সে সভায় এক কাফন-চোরও উপস্থিত ছিল। ঐ রাতেই কাফন চুরি করার জন্য সে একটি কবর খুঁড়ল। 

আর তখন শােনা গেল আশমানী আওয়াজ, হতভাগা আজই তাে তুমি হযরত হাতেম আসাম (রাঃ)-এর উসিলায় মার্জনা পেয়েছ, আর আজই আবার এ ঘৃণ্য কাজে লেগে গেলে? এ অদৃশ্য শব্দ শুনে সেদিন থেকে সে কাফন চুরি কাজ বরাবরের মতাে ছেড়ে দিল

হযরত রাজী (রাঃ) বলেন, দীর্ঘদিন হাতেম আসাম (রাঃ)-এর সাহচর্য থেকে মাত্র একদিন ছাড়া আর কোনদিন তাকে রাগতে দেখিনি। সেদিন তিনি বাজারের পথে দেখেন এক বাবসায়ী তার খাতকের ওপর পাওনা শােধ করার জন্য প্রবল চাপ দিচ্ছে। তাঁর কথা হলাে, আজই তাঁর দেনা শােধ করতে হবে। না হলে তাকে কিছুতেই ছেড়ে দেয়া হবে না। এমনকি তাকে মারধােরেরও শাসানি দেয়া হচ্ছে।

পাওনাদারদের এ জুলুম দেখে তিনি আর স্থির থাকতে না পেরে বলেন, দেনাদারের সঙ্গে এমন রুক্ষ ব্যবহার না করে একটু ভদ্র ও নরম ব্যবহার করলেও তাে চলে। অযথা মানুষকে এত অপমান করা ভালাে নয়।

তাঁর এ কথা শুনে মহাজন আরও ক্রুদ্ধ হয়ে বলে যে, আমার পাওনা শােধ করে না, তার সঙ্গে আবার নরম ব্যবহার কিসের? আজ আমি ছাড়ছি না। তাকে টাকা দিতেই হবে, না হলে উচিত শিক্ষা দেব। তখন হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) কাঁধ থেকে চাদরখানি তুলে নিয়ে খুব জোরে মাটির ওপর ছুঁড়ে দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল প্রচুর স্বর্ণখণ্ড ছড়িয়ে আছে মাটির ওপর। 

হাতেম আসাম (রাঃ)-এর রাগ তখনও কমেনি। তিনি রেগেই বললেন, খবরদার, তােমার যে পরিমাণ পাওনা আছে তাই নেবে, তার বেশি এক কণাও নেবার চেষ্টা করাে না। তা যদি কর, তাহলে কিন্তু তােমার হাত অবশ হয়ে যাবে। কিন্তু তা বললে কী হবে। লালসা দমন করা কঠিন। মহাজন তার প্রাপ্যের চেয়ে বেশি সােনা কুড়িয়ে নিল। আর সাথে সাথে তার দুটি হাতই অবশ হয়ে গেল ।

একবার এক ব্যক্তি তাকে নিমন্ত্রণ দিলেন এবং সেই বাড়িতে পৌছালেন। আর জুতাে না খুলেই ফরাশে বসে। গেলেন। আর নিজের থলে হতে দুখানি রুটি বের করে খেতে লাগলেন। তারপর ঐ ব্যক্তিকে বললেন, এখানে একটি তপ্ত তাওয়া আনা হােক। সে আর কী করবে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী একটি গরম তাওয়া এনে হাজির করল। 

আর হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) ঐ তাওয়ার ওপর দাঁড়িয়ে বললেন, আমি দুখানি রুটি খেয়েছি। তারপর তাওয়ার ওপর থেকে নেমে এসে তিনি সমবেত লােকদের বললেন, তােমরা যদি বিশ্বাস কর, রােজ কিয়ামতে সবকিছুর হিসেব নেয়া হবে। তবে এ গরম তাওয়ার ওপর দাঁড়িয়ে আজ এখানে কে কী খেয়ে, তার হিসেব দাও। তারা বললেন, হুজুর, ঐ গরম তাওয়ার ওপর দাঁড়াবার সাধ্য আমাদের নেই।

তখন তিনি বললেন, যদি তােমরা এখানে বসেই তােমাদের সামান্য কাজের হিসেব না দিতে পার তাহলে তােমরা আগুনে তৈরি হাশরের মাঠে দাঁড়িয়ে কী করে সারা জীবনের হিসেব দেবে? তােমাদেরকে প্রদত্ত যাবতীয় নিয়ামতেরই হিসেব-নিকেশ হবে। এ আয়াতটির মর্ম শুনিয়ে দিলেন। তাঁর বর্ণনাভঙ্গি এমন অপূর্ব ছিল যে তা শুনে প্রতিটি লােক কান্নায় ভেঙে পড়ল।

একদিন এক বিত্তশালী ব্যক্তি তাকে কিছু অর্থ গ্রহণ করতে বলেন, যাতে তার গ্রাসাচ্চাদনের ব্যবস্থা হয়, আর তিনিও পুণ্যবান ব্যক্তিকে কিছু সাহায্য করার বদৌলতে কিছু পুণ্যের অধিকারী হন। তাছাড়া, আশা পূর্ণ হওয়ার কারণে তিনি মানসিক প্রশান্তি লাভ করবেন।

হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) তাকে জানালেন একটি ভয়ের কারণে তিনি তাঁর প্রস্তাবে রাজি হতে পারছেন না। সে ভয় হলাে, যতিদিন ঐ ধনী দাতা জীবিত থাকবেন, ততদিন না হয় তাঁর জীবিকা- নির্বাহের ব্যবস্থা বহাল রাখবেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) যদি আল্লাহর কাছে এই বলে মােনাজাত করেন যে, তার রুজিদাতার মৃত্যু হয়েছে। 

হে প্রভু, এবার আপনি আমার রুজি দিন তেমন যদি আল্লাহ বলেন রুযি গ্রহণ করার কালেই তােমার একথা চিত্তা করার প্রয়ােজন ছিল। তখন তিনি কি করবেন? তার ভয়টা সেখানেই। আপনার রুজি আসে কোাথেকে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আল্লাহর তরফ থেকে, ভাণ্ডারে কোন রকমের হ্রাস-বৃদ্ধি নেই।

প্রশ্নকর্তা আবার বলেন, আপনি তাে মানুষের ধন বঞ্চনার আশ্রয় নিয়ে ভোগ করেন। অথচ বলছেন, রুজি আসে আল্লাহর তরফ থেকে

তিনি বললেন, তােমাকে বঞ্চনা করে কখনও কিছু নিয়েছি কি? তিনি উক্তর দিলেন, তা করেননি তখন হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) বললেন, তুমি যদি মুসলমান হতে, কত ভালােই না হতাে।

প্রশ্নকর্তা বলেন, আপনি কেবল কথার মধ্যে যুক্তির মারপ্যাঁচ প্রয়ােগ করেন। 

হযরত হাতেম আসাম (রাঃ): রােজকিয়ামতে আল্লাহ তার কাছ থেকে বিভিন্ন ব্যাপারে যুক্তিই চাইবেন। লোকটি: যা বলেন সব গতানুগতিক কথা। 

হযরত হাতেম আসাম: না এগুলি সব আল্লাহর কথা। প্রত্যেকের জননী তার পিতার জন্য বৈধ হয়েছে কেবল এ বাণীরই মাধ্যমে।

লােকটি: হুজুর, আপনার রুজি কি সত্যিই আশমান থেকে আসে?

হযরত হাতেম আসাম: শুধু আমার কেন, সব রুজিই আশমান থেকে আসে। আল্লাহ বলেন, আশমানেই রুজি সংরক্ষিত রয়েছে।

লােকটি : তাহলে আপনি ঘরে শুয়ে থাকুন। দেখি কী করে আপনার মুখে রুজি এসে পড়ে। 

হযরত হাতেম আসাম; শিশুকালে দু'বছর তাে শায়িত ছিলাম। তখন আমার রিজিক আপনা থেকে মুখে আসত কি। 

লােকটি: দুনিয়াতে বীজ বপন না করে কাউকে শস্য কাটতে দেখেছেন কি? 

হযরত হাতেম আসাম: হ্যা, দেখেছি। তুমি তোমার মাথার চুল কি কখনও বপন করেছ? অথচ তা কিছুদিন পরপর কাটছ কি না। 

লােকটি: আপনি ভূতল থেকে শূন্যে গমন করুন। দেখি সেখানে কে আপনাকে রুজি দেয়।

হযরত হাতেম আসাম: হ্যা। পার্থিব হলে সেখানেও রুজি পাওয়া যেত। 

লােকটি: তবে তাে মাটির নিচে রুজি পাওয়া যাবে।

হযরত হাতেম আসাম: পিপড়ে হলে তাে মাঠির নিচেই যেতাম।

হযরত হাতেম আসাম (রাঃ)-এর এমন সূক্ষ যুক্তিসম্মত উত্তর শুনে লােকটি এবার নিরুত্তর হয়ে গেলেন। পরে অনুতপ্ত হয়ে, তওবা করে তিনি বিণীতভাবে বললেন, আমাকে কিছু শিক্ষা দিন হুজুর। হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) বললেন, কোন লােনের নিকট কিছু আশা করাে না। তাহালে তােমার নিকটও কেউ কিছু আশা করবে না। পুন্যকর্ম এমন গােপনে সম্পন্ন করাে, যেন তুমি ও আল্লাহ ছাড়া কেউই জানতে না পায়। আর সব সময় মখলুকের সেবা কর, তাহলে তুমি যেখানেই থাক না কেন, মখলুক তােমার সেবা করবে।

হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) একবার আহম্মদ ইবনে হাম্বল (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কিরুজির সন্ধান করেন?

তিনি জবাব দেন, করি বৈকি।

হযরত হাতেম আসাম (রাঃ)-এর প্রশ্ন: তা কখন করেন? খাওয়ার আগে, না পরে, না খাওয়ার সময়েই।

এ প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন ভাবতে থাকেন হযরত আহমদ ইবনে হাম্বল (রাঃ)। যদি বলেন, খাওয়ার আগে, তাহলে হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) হয়তো বলবেন তাতে সময়ের অপচয় হয়। যদি বলেন খাওয়ার পরে, তাহলে তিনি বলতে পারেন, যা গত হয়েছে, তার সন্ধান করা বৃথা। আর যদি বলেন খাওয়ার সময়েই, তাহলে তিনি হয়তাে বলে বসবেন, উপস্থিত বস্তর সন্ধান করার কোন হেতু নেই। এরূপ চিন্তা করে তিনি কোন সদুত্তর খুঁজে না পেয়ে নিরুত্তর রইলেন।

প্রশ্নগুলি এক দরবেশের কানে এল। তিনি বললেন, এর জবাব এরূপ হওয়া উচিত ছিল যে, রুজি অনুসন্ধান করা ফরজ। ওয়াজিব বা সুন্নাত নয়। কাজেই এ তিনটির সঙ্গে সময়ের কোন সম্পর্কে নেই। বিশেষ করে যে বস্তু নিজেই আমাদের খুঁজে বেড়ায় তাকে খোজার দরকার কি? হযরত মুহাম্মদ (রাঃ) বলেছেন, যা তােমার রিজিক, তা তােমার নিকট এমনিই আসবে।

তিনি আরও বলেছেন, আমাদের প্রতি নির্দেশ আল্লাহর ইবাদত করা যেমন, আমরা তার আদেশ পেয়েছি আর তার কর্তব্য হলাে আমাদের রুজি দান করা, যেমন তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) যুদ্ধে যাবেন। যুদ্ধযাত্রার প্রাক্কালে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, চার মাসের খরচ বাবদ তােমার কত টাকা দরকার?

স্ত্রী বললেন, আমি যতদিন বেঁচে থাকব, আমাকে ততদিনের টাকা দিয়ে যান। তিনি বলেন, তােমার বাঁচা-মরা তাে আমার হাতে নেই। স্ত্রী বললেন, তাহলে আমার রুজির ব্যাপারেই বা আপনার হাত থাকবে কেন?

তিনি যুদ্ধে গেলেন। তারপর একদিন যখন যুদ্ধ চলছে, তখন এক কাফের তাঁকে বধ করার জন্য তরবারি তুলছেন, হঠাৎ কোনদিক থেকে একখানি তীর এসে কাফেরকে এমনভাবে বিদ্ধ করল যে, তার কাজ শেষ হয়ে গেল। তখন হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) বললেন, তুমি কি আমাকে হত্যা করলে, না আমিই তােমাকে করলাম।

এক ব্যক্তি বিদেশ যাত্রার প্রাক্কালে তাঁর কাছে কিছু উপদেশ চাইলেন। তিনি বললেন, যদি প্রিয় বন্ধুর আশা রাখ, তাহলে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। আর যদি সঙ্গী চাও, তাহলে তার জন্য কিরামুন কাতেবীনই ভালাে। যদি উপদেশ বা শিক্ষা পেতে চাও, তাহলে দুনিয়ার দিকে দৃষ্টি দাও। সান্তানা চাইলে কুরআন পাক সেরা। কাজেই ইচ্ছা থাকলে উপাসনাই উত্তম। 

যার উপদেশ চাইলে সে জন্য মৃত্যুই (মৃত্যর শরণ) যথেষ্ট। আর আমি যা বললাম, তা যদি তােমার মনােমতাে না হয়, তাহলে তােমার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট। হামেদ লাফলাফ বলেন, হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) বলেছেন, প্রতদিন ভােরবেলা ইবলীস তাঁকে ভয় দেখাত, আজ তুমি কী খাবে? তিনি জবাব দিতেন, মৃত্যু।

কী পাবে?

কাফন।

কোথায় থাকবে?

কবরে।

কথা না বাড়িয়ে শয়তান চম্পট দিত।

এক ব্যক্তি বললেন, হুজুর ঐ লােকটি বহু ধনরত্ম সন্ধ্যা করেছে।

হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) বলেন, মৃত ধন কি কাজে আসবে?

এক ব্যক্তি তাকে বললেন, আপনার কিছু চাওয়ার থাকলে আমার নিকট প্রকাশ করুন। হযরত হাতেম আসাম (রাঃ)-এর স্পষ্ট জবাব, আমি যা চাই তা হলাে এ যে, তুমি আমার কাছে এসাে না। আমি ও তােমার নিকট কিছু প্রকাশ করব না।

আপনি নামায কিভাবে আদায় করেন? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নামাযের সময় হলে প্রকাশ্য অজু করি পানি দিয়ে। আর গুপ্ত অযু বানাই তওবা দারা। তারপর মসজিদে যাই, তখন মনের মধ্যে কাবার দৃশ্য জাগিয়ে তুলি আর ভাবি, মাকামে ইব্রাহিম আমার দু ভুরুর মাঝখানে আর ডানদিকে রয়েছে জান্নাত। বামে রয়েছে জাহান্নাম। আর দু'পায়ের নিচে রয়েছে পুলসিরাত। 

মালাকুল মওত আজরাইলকে আমি আমার পেছনে হাজির বলে ধারণা করি। তখন মন-প্রাণ আল্লাহর কাছে সপে দিই। পরে পরম ভক্তিভরে তাকবীর পানি উচ্চারণ করি। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে ভয়ার্ত হৃদয়ে কিরাত পাঠ করি। অতঃপর সবিনয়ে রুকুতে যাই। আবার সবিনয়ে সিজদায় যাই। তারপর ধ্যান-তনয় চিত্তে বসি। তারপর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে দু'দিকে সালাম করি। এভাবে আমি আমার নামায আদায় করি ।

একবার তিনি কয়েকজন আলেমের কাছে গিয়ে বললেন, আপনাদের মধ্যে যদি তিনটি বস্তু থাকে তাে ভালােই। যদি না থাকে তাে আপনাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত। জিনিস তিনটি কি? তারা জিজ্ঞেস করেন।

হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) বলেন, (১) অতীত দিনের জন্য এভাবে আক্ষেপ করা যে, আমি ঐ দিনগুলিতে উপাসনা করিনি এবং কৃপা পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনাও করা হয়নি। (২) উপস্থিত সময়কে কাজের জন্য উপযুক্ত মনে করে কাজগুলাে সম্পন্ন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা। (৩) আগামীকাল আপনাদের জন্য উত্তম কী অধম তা অনিশ্চিত জেনে সদা সন্ত্রস্ত থাকা। অহঙ্কার, লােভ ও আত্মগরিমা-এ তিন অবস্থায় মৃত্যুকে ভয় করাে। কেননা, 

(১) আল্লাহ অহঙ্কারীকে তার চেয়েও বেশি ঘৃণিত, অপদস্থ ও অসম্মানিত না করে দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নেবেন না।

(২) লােভী লােকের গুনাহ যে পর্যন্ত না ক্ষুৎপিপসায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে, সে পর্যন্ত দুনিয়া থেকে তাকে তুল নেবে না। 

(৩) অহঙ্কারে স্ফীত মানুষকে মলমূত্র দ্বারা অবলেপিত না করে দুনিয়া থেকে তুলে আনবেন না।

হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) -এর মুরশিদ হযরত শাকীক বলখী (রাঃ) একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমার সাহচর্যে কত বছর কাটালে? তিনি বলেন, প্রায় ত্রিশ বছরেরও ওপর। এতদিন ধরে তুমি আমার নিকট কী কী শিখলে?

মাত্র আটটি মাসায়ালা শিখেছি। মাত্র। মাত্র আটটি মাসায়ালা শিখেছ?

জ্বী! ঐ আটটি ছাড়া আমি আর কিছুই শিখিনি। তবে আমার মনে হয়, সেগুলিই আমার ইহকাল-পরকালে মুক্তির জন্য যথেষ্ট বলে বিষয় গুলি তিনি বর্ণনা করলেন।

(১) আমি সমগ্র মানবসমাজের দিকে লক্ষ্য করে দেখলাম, প্রত্যেকেরই কোন না কোন প্রেমিক রয়েছে। তাদের জন্য তারা প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। অথচ, প্রেমিকের মৃত্যু হলে কেহই তার সঙ্গে কবরে যায় না। 

এ থেকে আমার মনে হল, হৃদয়হীন বিনাশশীল প্রেমিকের জন্য সময় নষ্ট করা নিবুর্পিতার নামান্তর। তাই কারাের সঙ্গে যদি প্রেম-প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন করতেই হয়, তাহলে পুণ্যকর্মের সঙ্গে তা করা উচিত। কেননা, তা মৃত্যুর পরে সঙ্গে কবরে যায়।

(২) বিশ্ব সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, প্রত্যেকেই প্রবৃত্তির দাস। সে সঙ্গে আল্লাহর বাণীর প্রতিও আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়, যে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে ভয় পায়, আর প্রবৃত্তিকে কুকাজ থেকে বিরত রাখে, তার জায়গাই হলাে জান্নাত। অতঃপর আমি কুরআন পাকের ঐ বাণীর ওপর আস্থা স্থাপন করে প্রবৃত্তিকে শাসন করেছি। আর সফলও হয়েছি।

(৩) পৃথিবীর সব মানুষকে দেখলাম, দুনিয়া লাভের জন্য তারা নিয়ত তৎপর। অর্থ, যশ, খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা অর্জন করলেই তার জীবনকে সার্থক মনে করে। অথচ আল্লাহর বাণী হলাে, তােমাদের যা রয়েছে, একদিন তা বিলীন হয়ে যাবে। অথচ আল্লাহর নিকট যা রয়েছে, তা হলাে স্থায়ী। এই পবিত্র বাণীর দিকে লক্ষ্য রেখে আমি আমার যাবতীয় অস্থায়ী বস্তু বিলিয়ে দিয়ে স্থায়ী সম্পদ লাভে সচেষ্ট হয়েছি।

(৪) দেখলাম, অর্থ, যশ, খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠাকে মানুষ বড় মূল্য দেয় বলে সেগুলি নিয়ে অহস্কার করে। অথচ আল্লাহ বলেন, তােমাদের মধ্যে অধিক সম্মানী সে-ই, যে তােমাদের মধ্যে অধিক আল্লাহভীরু। আল্লাহর এ ঘােষণা অনুযায়ী আমি আমার আল্লাহভীরুতা তথা ধর্মনিষ্ঠাকে শক্ত করে ধরলাম।

(৫) দেখলাম, পৃথিবীর একদল মানুষ অন্য দলের অনিষ্ট সাধনে রত। তারা পরস্পর হিংসা ও বিদ্বেষ পােষণ করে। অথচ আল্লাহ বলেন, আমিই তাদের মধ্যে এই দুনিয়ার রুজি বণ্টন করে দিয়েছি। এর দ্বারা আমি বুঝতে পারলাম, পারস্পরিক হিংসা, দ্বেষ, হানাহানি, মারামারি বুথা, অর্থহীন। 

যে যা পেয়েছে বা লাভ করেছে, তা আল্লাহরই ইচ্ছায়। একজন আরেকজনের সম্পদ, সম্মান, মর্যাদা বা অন্য কিছু প্রাণপণ চেষ্টা করেও কেড়ে নিতে পারে না। আমি তাই অবিচল ধারণায় মন থেকে হিংসা ও বিদ্বেষ মুছে দিয়েছি।

(৬) দেখলাম বিকৃত সমাজও পারস্পারিক দ্বন্দু, মতানৈক্য, সমালােচনা ও পরশ্রীকাতরতায় আক্রান্ত। অথচ আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় শয়তান তােমার শত্রু। সুতরাং কেবলমাত্র তারই সঙ্গে শক্ত রাখ। অর্থাৎ এ আয়াতের মর্মকথা হলাে, শয়তান ছাড়া আর কারও সঙ্গে আমাদের শত্রুতা রাখা বা কারও সমালােচনা করা উচিত নয়।

(৭) দেখলাম নিজ নিজ জীবিকা অর্জনের জন্য সবাই সদা-ব্যস্ত। এমনকি এপথে গিয়ে অনেকেই বৈধ-অবৈধ রুজির কথা ভুলে গেছে। অথচ আল্লাহ বলেছেন, দুনিয়াতে সবই রিজিকই আল্লাহর হাতে। 

এ আয়াতের মর্মানুসারে আমার মনে হয়েছে, আমি ও তাে একটা জীব। অতএব আমার রুজির জিম্মাদার ও তাে সেই আল্লাহ। অতএব রিজিকের চিন্তা পরিত্যাগ করে আল্লাহর উপাসনায় লিপ্ত হয়েছি।

(৮) আরও লক্ষ্য করলাম, পৃথিবীতে জীবিকার ব্যাপারে কেউ ব্যবসার, কেউ চাকুরির, কেউ শিল্পের, কেউ সুলতান-বাদশাহর, কেউ মনিবের আবার কেউ পুত্র-কন্যার ওপর নির্ভরশীল। অথচ পাক কুরআনে আল্লাহ ঘােষণা করেছেন, যারা আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। আল্লাহ পাকের এ বাণীর ওপর অটল থেকে আমি আমার সকল ব্যাপারে তাঁর ওপরেই নির্ভর করেছি।

মুরশিদ হযরত শাকীক বলখী (রাঃ) তার সুযােগ্য মুরীদের কথা শুনে খুব খুশি হলেন বললেন, আমি দোয়া করি, আল্লাহ তােমাকে এ শিক্ষার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার তওফিক দান করুন।

হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) কারও দেওয়া কোনও দ্রব্য গ্রহণ করতেন না। এর কারণ হিসেবে তিনি বললেন, কারও কোন বস্তু গ্রহণ করা অবশ্য দাতার পক্ষে সম্মানজনক, কিন্তু গ্রহীতার পক্ষে হেয় বলে আমার ধারণা। একবার তিনি কোন বস্তু গ্রহণ করেন। তাতে সবাই অবাক হয়ে তাঁকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন। তিনি জবাব দেন, দাতা লােকটির সম্মান আমার চেয়ে ঢের বেশি, তাই।

হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) একবার বাগদাদ পরিভ্রমণ করেন। সে খবর খলিফার কানে পৌছায়। তিনি খােরাসানের এ জ্ঞান-তাপসকে তাঁর সভায় ডাকেন। আর সে ডাকে সাড়া দিয়ে তিনিও দরবারে হাজির হন। 

সেখানে তিনি খলিফাকে সালাম জানান এভাবে: আসসালামু আলাইকা ইয়া যাহিদু-হে যাহেদ, আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হােক। খলিফা বললেন, আমি তাে যাহিদ নই। আমি বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি। যাহিদ বরং আপনি। হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) বললেন, না না, বরং যাহিদ আপনিই। আমি যাহিদ হলাম কিভাবে? খলিফা জিজ্ঞেস করেন।

হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) বললেন, আল্লাহ বলেছেন, বলুন, দুনিয়ার সম্পদই হলাে যৎ কিঞ্চিৎ। আপনি খলিফা, সামান্য সম্পদ নিয়েই খুশি আছেন, অন্যদিকে পরকালের জান্নাতের সুখশান্তি ও অতুলবিভব সবকিছুর আশা পরিত্যাগ করেছেন। 

এজন্য আপনাকে আমি যাহিদ বলেছি। আমি এ দুনিয়ার সামান্য সম্পদলাভে খুশি নই। বরং পরকালের অপরিমেয় সম্পদ লাভের বাসনা আমার মনে। অতএব আমি নিজেকে যাহিদ বলি কী করে?

আরও পড়ুন

* হযরত আবু সুলায়মান দারায়ী (রাঃ) জীবনী

* হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রাঃ) জীবনী

* বলখের বাদশাহ হযরত ইব্রাহীম ইবনে আদহাম (রাঃ) জীবনী

* হযরত ফোজায়েল ইবনে আয়াজ (রাঃ) জীবনী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ