বিখ্যাত মনীষীহযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (র)
প্রচণ্ড শীত। চারপাশে জমে উঠেছে বরফের পাহাড়। এক তরুণ প্রেমিক দাঁড়িয়ে আছেন ঘরের এক দেয়ালের পাশে। এক সুন্দর যুবতীকে এক নজর দেখবেন তিনি। তাঁর রূপের ফাঁদে তিনি আটকে পড়েছেন। দাঁড়িয়ে আছেন সন্ধ্যা থেকে ভাের পর্যন্ত। ঠাণ্ডায়, বরফে তাঁর শরীর জমে গিয়েছে। তিনি অবশ। আর হুঁশও নেই। ফজরের আযান শুনে তার মনে হলাে, বুঝি এশার আযান হচ্ছে।
ক্রমশ রাতের আঁধার সরে যায়। পূর্বালী সূর্যের আলাে এসে পড়ে তাঁর চোখে-মুখে। এ আলাে যেন পৌছে যায় তাঁর চেতনার ভেতরে। চমকে ওঠেন তিনি। এক যুবতীর আশায় তিনি ঠাঁয় দাড়িয়ে আছেন বরফের রাজত্বে, অবিবাহিত হয়েছে একটি সুদীর্ঘ শীতার্ত রাত!
আত্মধিক্কারে তিনি ক্লিষ্ট হলেন। ছিঃ ছিঃ! প্রবৃত্তির তাড়নায় একটি পুণ্যময় রজনী এভাবে কেটে গেল? এর বদলে যদি উপাসনায় নিমগ্ন হতাম!
তীব্র অনুশােচনায় তরুণ যেন নতুন হয়ে গেলেন। তাঁর নারী প্রেমে রূপান্তরিত হলাে আল্লাহপ্রেমে। গভীর সাধনায় তিনি মগ্ন হলেন। আর আল্লাহর অশেষ করুণায় তিনি সিদ্ধিলাভও করলেন।
এ রূপান্তরিত আলােকিত মানুষটি হলেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (র)। সাধনাবলে তিনি জাহেরী ও বাতেনী, শরীয়ত ও তরীকতের গবীর প্রজ্ঞা ও জ্ঞানলাভ করেন। ধর্মমূলক বহু অমূল্য গ্রন্থের রচয়িতাও তিনি। তাঁর সাধনা মাহাত্ম সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে গেছেন হযরত সুফিয়ান সাওরী (র) ও হযরত ফোজায়েল। ইবনে আইয়াজ (র) প্রমুখ বিদগ্ধজন। তাঁর জীবনেও প্রচুর অলৌকিক ঘটনার সমাবেশ ঘটেছে।
সাধনায় তিনি যে সিদ্ধিলাভ করেন, তা একটি ঘটনায় প্রমাণিত হয়ে যায়। একদিন তাকে খুঁজতে গিয়ে তাঁর মা দেখেন, তিনি একটি গােলাপ গাছের তলায় ঘুমােচ্ছেন। আর একটি সাপ নার্গিস গাছের ডাল দিয়ে মশা, মাছি তাড়াচ্ছে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মােবারক (র)-এর জন্ম বাঘদাদের কাছাকাছি মেরু নামক স্থানে। বাগদাদে বেশ কিছুদিন জ্ঞানীগুণীর সান্নিধ্যে থেকে তিনি মক্কায় যান। মক্কা থেকে ফিরে আসেন মেরুতে। ওখানে তখন ধর্মবেত্তাদের দুটি দল ছিল। তাদের সঙ্গে আবদুল্লাহ ইবনে মােবারক (র) এর সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়। তাঁরা তাঁকে ভালােও বাসতেন। কোন মত-দ্বন্দ্ব ঘটলে তিনি তার মীমাংসাও করে দিতেন।
পরে তিনি আবার মক্কায় যান ও সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাঁর জীবন পঞ্জী বড় বিচিত্র। তিনি এক বছর হজ্জ আদায় করতেন, পরের বছর যােগ দিতেন ধর্মযুদ্ধে। এবং তারও পরবর্তী বছরে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। আর তাতে যে লাভ হতাে, তা দান করতেন শিষ্যদের। কিছু অংশ দিয়ে গরীব-দুঃখীকে খেজুর কিনে দিতেন। খেজুর খেতে হতাে তার সামনেই। কেননা, পরে তিনি আঁটিগুলি গুণে দেখে সংখ্যানুসারে তাদের অর্থ দান করতেন। অর্থাৎ যে যত বেশি খেজুর খেত, সে তত বেশি টাকা পেত।
কিছুদিন তাঁর সঙ্গে ছিল একটা বাজে লােক। প্রচুর বদ অভ্যাস ছিল তার। সে যখন সঙ্গ ছাড়ল, তখন তিনি এই বনে কাঁদতে থাকেন যে, লােকটি তাে বিদায় হয়ে গেল, কিন্তু তার বদ অভ্যাস তার থেকে বিদায় হলাে না। আল্লাহ তাকে অলৌকিক শক্তিও দান করেন। তাঁর প্রার্থনায় একটি অন্ধ লােক দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়।
একবার তিনি হজ্জ যাত্রায় বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু ঘটনাচক্রে তার বেশ কিছু সময় নষ্ট হয়ে যায় । হজ্জের আর মাত্র চারদিন বাকি। তিনি ধরে নিলেন, এবার তার আর হজ্জ করা হবে না। হঠাৎ এক বৃদ্ধা এসে তাকে বলেন, আপনি আমার সঙ্গে আসুন। আপনাকে আরাফাত পর্যন্ত পৌছে দেব। তিনি তার সহযাত্রী হলেন। পথে কোন নদী পড়লে বৃদ্ধ তাকে চোখ বন্ধ করতে বলতেন। তিনি তা করতেনও। তখন মনে হতাে, এক হাঁটু বা এক কোমর পানির মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছেন।
বৃদ্ধা তাকে সত্যিই আরাফাতে পৌছে দেন। যথারীতি হজ্জও আদায় হয়। হজ্জ সম্পন্ন করে বৃদ্ধা তাকে নিয়ে যান তার এক পুত্রের কাচে। অতি ক্ষীণ, দুর্বল এই যুবকটি বসেছিলেন এক পর্বত গুহায় । অবশ্য তাঁর দেহে ছিল এক উজ্জ্বল কান্তি। জননীকে দেখামাত্র তিনি উঠে এসে পরম ভক্তিভরে তার পদধূলি গ্রহণ করলেন। আর বললেন, আমি জেনেছি, আল্লাহ আপনাদের এখানে পাঠিয়েছেন আমার কাফন-দাফনের জন্য। কেননা আমার মৃত্যু আসন্ন।
এ কথা বলেই যুবক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মােবারক (র) স্বহেস্ত তার শেষকৃত্য করলেন। আর বৃদ্ধা তাকে ওখানেই বিদায় দিলেন। বললেন, বাকি জীবন তিনি তাঁর পুত্রের কবরের কাছেই কাটিয়ে দেবেন। আরও বললেন, আগামীবার হজ্জ মরসুমে তাঁর সঙ্গে আর দেখা হবে না। তিনি তাঁর জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে অনুরােধ জানালেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মােবারক (র)-কে।
হযরত আবদুল্লাহ স্বপ্নের মধ্যে একথা শুনে হতবাক। বললেন, কত মরুপ্রান্তর পার হয়ে কত কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করে লােকে হজ্জ করতে এল, আর তা সবই ব্যর্থ হলাে? প্রশ্নকারী ফেরেশতা বললেন, না, তা নয়। তবে ঘটনাটি শুনে নিন। দামেস্ক শহরের এক মুচি, আলী ইবনে মুয়াফিক এবার হজে আসেননি বটে, কিন্তু তাঁর হজ কবুল হয়েছে। আর তার উসিলায় আল্লাহ প্রত্যেকের হজ কবুল করেছেন।
এ আশ্চর্য স্বপ্নে দেখে, উক্ত মুচিকে দেখার জন্য হযরত আবদুল্লাহ দামেস্কে গেলেন। আর তাঁর বাড়িও খোঁজ পেলেন। দরজায় ডাকাডাকি করতেই একটি লােক বেরিয়ে এলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মােবারক (র) তার নাম জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী করেন? তিনি বললেন, আমি জুতাে সেলাই করি। অতএব আর কোন সন্দেহ রইল না। তাঁর কাছে স্বপ্নের বিবরণ প্রকাশ করলেন। মুচি এবার তার নাম জিজ্ঞেস করলেন। আর নাম শুনামাত্র অজ্ঞান হয়ে পড়লেন।
কিছুক্ষণ পরে তাঁর জ্ঞান ফিরে এলে তিনি তার অবস্থা জানতে চাইলেন। আলী ইবনে মুয়াফিক বললেন, ত্রিশ বছর ধরে আমার মনে হজ্জ করার প্রবল ইচ্ছা। কিন্তু আর্থিক অনটনের জন্যই তা আর হয়ে ওঠেনি। বহু কষ্ট করে এবার তিন হাজার টাকা যােগাড় হলাে। হজ্জের জন্য প্রস্তুতি চলছে। হঠাৎ এক রাতে আমার গর্ভবতী স্ত্রী পাশের বাড়ি থেকে রান্না করা মাংস আনার জন্য আমাকে সে অনুরােধ করল। স্ত্রীর অনুরােধে লজ্জা ত্যাগ করে আমি পাশের বাড়িতে গিয়ে একটু গােশত চাইলাম। কিন্তু গৃহকত্রী বিনীত ভাবে বললেন, এ গােশত আপনাদের দেয়া যাচ্ছে না।
কেননা, আপনাদের পক্ষে তা নাজায়েজ। অবশ্য আমাদের কাছে বৈধ। কারণ শনলেই বুঝতে পারবেন। গত সাতদিন ধরে আমি ছেলে-মেয়েদের জন্য কোনও খাবার যােগাড় করতে পানিনি। ক্ষিদের জ্বালায় তারা মরে আর কি। শেষ পর্যন্ত একটা মৃত গাধার খোঁজ পেয়ে কিছুটা এনে তা রান্না করেছি। ছেলে-মেয়েদের বাঁচাতে তাই খেতে দেব।
আলী ইবনে মুয়াফিক বলতে থাকেন, এ কথা শুনে আমি ভীষণ ব্যথিত হলাম। পরিবারটির প্রতি সহানুভূতিতে আমার হৃদয় ভরে গেল আমি তখনই সন্তানদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করতে বললাম। আর আমার মনে হলাে, পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এ হলাে আমার আসল হজ্জ।
স্বপ্নে ফেরেশতাগণ যা বলাবলি করছিলেন, তার মর্ম হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মােবারক (র)- এর কাছে এখন স্পষ্ট হয়ে গেল।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মােবারক (র)-এর এক ক্রীতদাস ছিল। তাঁর সঙ্গে চুক্তি ছিল, কাজকর্ম করার পর সে যদি তাকে কিছু কিছু অর্থ দিতে পারে, তাহলে তাকে মুক্তি দেয়া হবে। বেচারা চুক্তি পালনের চেষ্ট করত। কিন্তু একদিন তার বিরুদ্ধে অভিযােগ এল, সে নাকি মৃতের কাফন চুরি করে। আর তা বিক্রি করে যে পয়সা পায়, তা মনিবকে দেয়। এ অভিযােগে হযরত খুবই ক্ষুব্ধ হলেন। আর এক রাতে, ক্রতদাস যখন বাড়ি থেকে বের হচ্ছে, তখন তিনিও খুব গােপনে তাকে অনুসরণ করলেন।
সত্যিই কবর স্থানে গিয়ে সে একটা কবর খুঁড়ে তার মধ্যে ঢুকে পড়ল। কিন্তু কোথায় কাফন চুরি! একখানি চটের কম্বল পরে ও গলায় একটি লােহার শেকল ঝুলিয়ে সে নামায পড়তে শুরু করে। এ দৃশ্য দেখে আবদুল্লাহ অশ্রুসিক্ত হলেন। আর বাড়ি না ফিরে তিনিও কবরের অদূরে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হলেন। প্রভু রইলেন বাইরে আর ভৃত্য কবরের ভেতরে-দুটি মগ্ন হৃদয়ের উপাসনায় কেটে গেল একটি রাত।
ভােরের দিকে কবর থেকে বেরিয়ে এসে সেটিকে ঢেকে রেখে ক্রীতদাস চলে গেলে মসজিদে-ফজরের নামায আদায় করতে। নামাজ শেষে নিবেদিত হলাে তাঁর আকুল প্রার্থনা। প্রভু গাে, মনিবের সঙ্গে আমি যে চুক্তিবদ্ধ, তা আপনার অবগত। অতএব, হে করুণাময়, আপনি আমাকে সাহায্য করুন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সামনে আবির্ভূত হলাে এক অত্যুজ্জ্বল অপার্থিব আলাে। আর সে আলাে মুহুর্তের মধ্যে মুদ্রায় রূপান্তরিত হলাে। ক্রীতদাস হাত পেতে তা গ্রহণ করল।
আড়াল থেকে সবই দেখছিলেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মােবারক (র)। কিন্তু শেষ দৃশ্যটি দেখে সম্বিৎ হারালেন। পরে, অবস্থা যখন স্বাভাবিক হয়ে এল, তখন দৌড়ে গিয়ে বুকে চেপে পরলেন ক্রীতদাসকে। তার গালে-কপালে অজস্র চুম্বন একেঁ দিয়ে তিনি বলে উঠলেন, আমার মতাে ইবনে মুবারকের সহস্র প্রাণ তােমার মতো ভূতের সেবায় উৎসগিত হােক। আহ! তুমি যদি আমার মনিব হতে, আর আমি হতাম তোমার ভূত্য, তাহলে তাই হতে উত্তম।
গুপ্ত রহস্য প্রকাশ হয়ে গেল দেখে ভূত্য বড় সংকুচিত হয়ে পড়ল। আল্লাহর দরবারে সে মােনাজাত করল, আমার যা গােপন, আপনি তাে প্রকাশ করে দিলেন প্রভু। এখন আর এ পার্থিব জগতে থাকার আমার কোন ইচ্ছা নেই। আপনি তাড়াতাড়ি আপনার এ অধম বান্দাকে এখান থেকে তুলে নিন। আশ্চর্য, প্রভুর বুকে আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় ভূত্যের শেষ নিঃশ্বাসটি শেষবারের মতাে বেরিয়ে গেল। আর আবদুল্লাহ ইবনে মােবারক (র) এ ঘটণায় হতভম্ব হয়ে পড়লেন।
পরে অবশ্য ভুত্যের পরনে যে চটের কম্বল ছিল, তাকেই কাফন করে, জানাজা আদায় করে তাকে কবর দিলেন। আর ঐ রাতেই তিনি স্বপ্ন দেখলেন, রাসূলে করীম (স) হযরত ইব্রাহীম (আ)-কে সঙ্গে করে তার কাছে এসে বললেন, আমার একান্ত বন্ধু ও আল্লাহর প্রিয় ব্যক্তিকে চটের কাফন পরিয়ে দাফন করলেন কেন?
একবার হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মােবারবক (র) সাড়ম্বরে চলেছেন।যেন এক আমীর বাদশাহ। এই দৃশ্য দেখে মহানবীর এক বংশধর ঈর্ষান্বিত হয়ে বললেন, হে কাফেরের সন্তান। রাসুলুল্লাহর বংশধর হওয়া সত্ত্বেও আমার কোন প্রভাব প্রতিপত্তি নেই। আমার কাছে কারাের যাতায়াত নেই।
আপনি কী করে মানুষের এত ভক্তি শ্রদ্ধার পাত্র হলেন? উত্তরে আবদুল্লাহ ইবনে মােবারক (র) বললেন, আপনার পিতা ছিলেন মহানবীর বংশধর। আর আমার পিতা ছিলেন পথভ্রষ্ট। আপনার পিতার পরিত্যক্ত বিদ্যা গ্রহণ করে আমি এই সাফল্য অর্জন করেছি। আর আমার পিতার পরিত্যক্ত বস্তুও অবলম্বন করে আপনি হয়েছেন অবজ্ঞেয় ও ঘৃণায় পাত্র।
আর ঐ রাতেই তিনি স্বপ্ন দেখলেন, মহানবী অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, আপনি আমার বংশধরের প্রতি অমন মন্তব্য করলেন, কেন?
আবার উক্ত বংশধর ও স্বপ্ন দেখলেন, তাঁর দাদাজী মহানবী (স) বলেছেন তুমি আমার বংশধল হয়েও যথােচিত কাজ করনি। আমার রীতিনীত যথাযথভাবে পালন করে আমার সঙ্গে যে সুসম্পর্ক স্থাপন করেছে, তার প্রতি তােমার হিংসা কেন?
দুজনেই স্বপ্ন দেখে পরস্পরের কাছে ছুটলেন ক্ষমা চেয়ে নিতে। আর রাস্তায় তাঁদের দেখা হয়ে গেল। বলাবাহুল্য পরস্পর পরস্পরের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে ভারমুক্ত হলেন।
যখন তিনি তার আরাধ্য দেবতার উদ্দেশে সাষ্টাঙ্গে প্রণামে রত হলেন, তখন সে সুযােগ গ্রহণ করে তার অবনমিত মস্তক দ্বিখণ্ডিত করার জন্য আবদুল্লাহ ইবনে মােবারক (র) তরবারি উত্তোলন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে শােনা গেল দৈববাণী-সাবধান। এ তুমি কী করতে চলেছ? হােক সে মুশরিক। কিন্তু তুমি তার সঙ্গে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দণ্ড কি ভয়ঙ্কর তুমি জান?
আকাশ বাণী শুনে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল আবদুল্লাহর। তরবারি নামিয়ে তিনি আল্লাহর ভয়ে আকুলভাবে কেঁদে উঠলেন। এদিকে, প্রতি যােদ্ধার উপাসনা শেখ। তিনি কান্নার কারণ জিজ্ঞেস
করলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মােবারক (র) ঘটণাটি তাঁকে খুলে বললেন। আর ঘটণার বিবরণ শুণে তিনিও ভীষণ জোরে চিৎকার করে উঠলেন। কেঁপে উঠলেন থর থর করে। বললেন, যে আল্লাহ শত্রুর পক্ষ অবলম্বন করে যারা অন্য উপাস্যের উপাসনা ধমক দেন। সে আল্লাহর আনুগত্য না করে যারা অন্য উপাস্যের উপাসনা করে, তাদের মতাে হতভাগ্য আর কেউ নেই। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে এখনই ইসলাম ধর্মে দীক্ষা দিন।
মুহুর্তের মধ্যে রক্তপিপাসু শত্রু পরম মিত্রে পরিণত হলাে। হযরত সােলায়েল (র) নামে এক সাধক প্রায়ই হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মােবারক (র)-এর দরবারে আসেন। নানা বিষয়ে আলাপ-আলােচনা হয়। একদিন আসর শেষে ফিরছেন, হঠাৎ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মােবারক (র) কে বললেন, আর আমি কোনদিনই এখানে আসছি না। কারণ, আজ আমি আপনার বাড়ির নিকটবর্তী হলে ছাদের ওপর থেকে আপনার দাসীরা সােহায়েল উপরে আসুন’ বলে আমাকে ডাকাডাকি করছিল। আমার খুব খারাপ লেগেছে।
একথা শােনা মাত্র হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মােবারক (র) উপস্থিত লােকজনকে বললেন, তােমরা এসাে। সােহােয়েলের জানাজা আদায় করতে হবে। হলও ঠিক তাই। কিছুক্ষণ পরেই সােহায়েল (র) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। কাফন-দাফন-জানাজা যথারীতি সম্পন্ন করে কৌতুহলী লােকজন তাকে জিজ্ঞেস করল, সােহায়েল (র) জীবিত থাকতেই আপনি আগাম তার জানাজার কথা কিভাবে ঘােষণা করলেন? তিনি বললেন, যখন তিনি ছাদের দাসীদের আহবানের কথা বললেন, তখনই আমি বুঝে নিয়েছিলাম, সে ডাক দাসীদের নয়, জান্নাতের হুরগণ তাকে ডাক দিয়েছে। কেননা আমার এখানে কোন দাসী-বাঁদী নেই।
একজন পাদ্রী আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে প্রচুর ইবাদত উপাসনা করে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। হযরত ইবনে মােবারক (র) তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, আল্লাহর পথ কেমন?
পাত্রী বললেন, আপনি যখন বিজ্ঞ ব্যক্তি, তখন আল্লাহ ও তাঁর পথের পরিচয় নিশ্চয় আপনার অজ্ঞাত নয়। সত্যি বলতে কী, আমি আজ অবধি আল্লাহকে চিনতে পারিনি। আর তাঁর পরিচয় না জেনেই তাঁর উপাসনা করতে করতে দুর্বল হয়ে পড়েছি। আমি জানি, আপনি কেমন আরিফ যে, আপনার অন্তুরে এখনও আল্লাহভীতি সৃষ্টি হয়নি। পাদ্রীর কথা শুনে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মােবারক (র) -এর মনে সেদিন থেকে আল্লাহর ভয় ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে লাগল।
এক অগ্নিপূজক কাবাঘরে ঢুকতে গিয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হঠাৎ বেঁহুশ হয়ে পড়ে গেল। জানা গেল, সে ছদ্মবেশে কাবাশরীফে আসে। কিন্তু সেখানে ঢুকতে গিয়েই সে অদৃশ্য শব্দ শুনেই সে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। কাবা শরীফে ঘটনাটি যখন ঘটে তখন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মােবারক (র) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আর তিনিই পরে পুরাে ব্যাপারটি খুলে বলেন।
নিশাপুর শহর। শীতের মওসুম। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মােবারক (র) দেখলেন, একটি ভূত্য শীতে বড় কষ্ট পাচ্ছে। তিনি তাকে বললেন, তুমি তােমার মনিবের কাছে একখানি কম্বলের কথা বল না কেন? সে অভিযােগের ভঙ্গিতে বললাে, আমাকে বলতে হবে কেন? তিনি আমার অবস্থা দেখতে পান না? তার এ কথাটি গভীরভাবে আলােড়িত হয় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মােবারক (র) মনে। তিনি বলতেন, কেউ তরীকত হাসিল করতে চাইলে সে যেন এই ভুত্যের কাছে তা শিখে নেয়।
অপর দিকে এক ধর্মানুষ্ঠানে তাঁর বক্ততা শুনে এক ধনী কন্যা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন। পিতা- মাতার কাছে বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশ করলে, তারা খুশি হয়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মােবারক (র) এর হাতে তাকে সােপর্দ করেন। আর কন্যাকে পঞ্চাশ হাজার মুদ্রাও দিয়ে দেন।
শাদী মােবারক সম্পন্ন হলে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মােবারক স্বপ্ন দেখলেন, আল্লাহ বলছেন, আমার খুশির জন্য তুমি তােমার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছিলে। বিনিময়ে আমি তদপেক্ষা উত্তম স্ত্রীর ব্যবস্থা করে দিলাম। কারণ, তুমি যেন দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে পার-যারা আল্লাহর খুশির জন্য ত্যাগ স্বীকার করে, আল্লাহ তার বদলা অবশ্যই দেন।
জীবনের অন্তি লগ্ন ঘনিয়ে এলে তিনি তা বুঝতে পারেন। আর যাবতীয় বিষয় সম্পত্তি গরিব দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। তার এক ভক্ত তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, তাঁর তিনটি কন্যা আছে। তাদের জন্য তিনি কী রেখে গেলেন? তিনি বললেন, আল্লাহকে রেখে গেলাম। যাদের জিম্মাদার স্বয়ং আল্লাহ, তাঁদের জন্য আমার কিছু করার কী প্রয়ােজন।
শেষ মুহুর্তে চোখ খুলে ঠোঁটে হালকা হাসির আভাস এনে তিনি বললেন, পুণ্যবানদের কাজ এরূপই হওয়া চাই। কথাটি বলেই তিনি চোখ বুজলেন। আর খুললেন না।
তাঁর মৃত্যুর পর এক ব্যক্তি স্বপ্নযােগে হযরত সুফিয়ান সাওরী (র)-কে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর নিকট কেমন আচরণ পেলেন? তিনি বললেন, আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তখন তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (র)-এর কথা জিজ্ঞেস করলেন। হযরত সুফিয়ান সাওরী (র) বললেন, সংক্ষেপে বলতে গেলে, তিনি সেই দলেরই একজন, যাঁরা প্রতিদিন দুবার আল্লাহর দরবারে হাজির হন।
আরও পড়ুন
0 মন্তব্যসমূহ