নতুন পোস্ট

6/recent/ticker-posts

হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (রঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী বাংলা

 

হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (রঃ)

আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (রঃ) জীবনী

এক কামার। দারুণ আসক্ত এক রূপসী যুবতীর প্রেমে। তাকে না পেলে কামার বুঝি প্রাণে মারা যান। ছুটলেন নিশাপুরের এক ইহুদী যাদুকরের কাছে। প্রেমিকাকে পেতেই হবে। যাদুকর বললাে, ঠিক আছে। তাকে পাওয়া যাবে তবে একটা শর্ত আছে। তাহলাে এ যে, চল্লিশ দিন ধরে কোন উপাসনা ইবাদত বা কোন রকমের কাজ করতে পারবেন না। এ আর এমন কথা কী! কামার রাজি হয়ে গেলেন। প্রেমিকার জন্য তিনি সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত। বন্ধ হয়ে গেল তাঁর উপাসনা। 

কোন ভালাে কাজ করার ইচ্ছাও মুলতবি রইল। এভাবে চল্লিশ দিন কাটানাের পর তিনি যাদুকরের শরণাপন্ন হলেন আবার। কিন্তু যাদুকর তাঁর ওপর যাদুবিদ্যা প্রয়ােগ করে বিন্দুমাত্র ফল পেল না। কারণ কি? যাদুকর সন্দেহ করল, ঐ চল্লিশ দিনের মধ্যে নিশ্চয়ই কামার এমন কিছু করেছেন, যা সৎকাজ বলে গণ্য হতে পারে। কিন্তু কামারও খুব ভালাে করে ভেবে দেখলেন, না, তেমন কিছুই তিনি করেননি। 

তবে হ্যাঁ- হঠাৎ মনে হলাে, একদিন পথ চলতে চলতে পথের ওপর পড়ে থাকা কিছু পাথর পা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন এ ভেবে যে, হয়তাে বা কোন পথচারীর গায়ে আঘাত লাগতে পারে। তাহলে এ! যাদুকর ধরে ফেলল ব্যাপারটা। দীর্ঘ চল্লিশ দিন ধরে কামার মানুষের জন্য করণীয় আল্লাহর নির্দেশ অগ্রাহ্য করেছেন। তবুও দয়াময় আল্লাহ সামান্য একটা সৎকাজের বিনিময়ে তাকে পাপাচারে লিপ্ত হতে দেননি। যাদুকর বলেন, এরপরও কি মহান আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে তাঁর নিষিদ্ধ কাজগুলিই তিনি করে যাবেন?

চেতনার ওপর যেন চাবুক পড়ে। ছি! ছি! সত্যিই তাে! এ তিনি কী করেছেন। একটি নারীর লােভে ডুবে গেছেন পাপের গভীর? যাদুকরের হাতে হাত রেখে কর্মকর বললেন, আপনি সাক্ষী থাকুন আমি প্রতিজ্ঞা করছি, জীবনে আর কোনদিন কোন রকমের কু-কাজে লিপ্ত হবাে না।

অতঃপর শুরু হলাে তাঁর পরিশ্রুতি জীবন। কর্মকারের কাজে প্রতিদিন এক দীনার রােজগার করে তিনি তা দান করে দেন। আর দান করেন গােপনে। যেন দানের খবর প্রকাশ না হয়। এশার নামাজের পর মানুষের ফেলে দেয়া শাকপাতা সংগ্রহ করে রান্না করেন। আর তাই দিয়ে রুটি খান। আর এভাবে দেখতে দেখতে এক বছর কেটে যায়।

একদিন এক অন্ধ তাঁর কামারশালার পাশ দিয়ে যেতে যেতে কুরআন পাকের একটি আয়াত পাঠ করছিল-রােজ কিয়ামতে তারা যা ধারণাও করত না, আল্লাহ পাকের তরফ থেকে তা বের হয়ে পড়বে।

আয়াতটি শুনে কর্মকার বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লেন। ডুবে গেলেন গভীর ভাব-তন্ময়তায়। আর ঐ অবস্থায় একখণ্ড তপ্ত লােহা হাতে তুলে নিয়ে তাঁর সহকারীদের সেটি হাতুড়ি দিয়ে পেটাতে বললেন। অবস্থা দেখে তারাও হতভম্ব। এ তিনি কী করছেন। গনগনে লাল লােহা তুলে নিয়েছেন হাতের তালুতে। হাতুড়ির ঘা পড়বে কোথায়? কিছুক্ষণ পরে তার অবস্থা যখন স্বাভাবিক হলাে, বন্ধ হয়ে গেল তাঁ । মালপত্র যা ছিল, সবই বিলিয়ে দিলেন। বললেন, চেয়েছিলাম গােপন রহস্য গােপন থাকবে। কিন্তু থাকল না। আল্লাহ পাকের কী ইচ্ছা, তিনিই জানেন।

এ কর্মকার তথা গােপন সিদ্ধপুরুসের নাম হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র)। প্রখ্যাত দরবেশ হযরত আবু ওসমান জারীর (র)-এর মুরশিদ। তাপস প্রবর শাহ শুজা কেরমানীও তার সংস্পর্শে আসেন। তারা দুজনেই খােরাসান থেকে বাগদাদে গিয়ে বিশিষ্ট সাধক-দরবেশের কাছে আধ্যাত্মিক জীবনের পাঠ গ্রহণ করেন।


এক প্রতিবেশীর বাড়িতে হাদীস পাঠ হচ্ছে। পাঠ করছেন এক মুহাদ্দিস। হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র)-কে হাদীস শােনার জন্য বলা হলাে। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না বললেন, ত্রিশ বছর আগে তিনি একটি হাদীস শুনেছেন। কিন্তু এখনও তা পুরােপুরি চর্চা করতে পারেননি। আর হাদীস শুনে কী হবে? তারা বললাে, ত্রিশ বছর আগে শােনা সে হাদীসটি কি? তিনি বললেন, এও এক সৌন্দর্য যে, কোন ব্যক্তি যে বিষয় তার কোন কাজে না আসে তা পরিত্যাগ করা। 

একবার এক অরণ্যে শিষ্যসহ তিনি ধ্যানমগ্ন। একটা হরিণ এসে তাঁর কোলে মাথা গুজে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আর এ ঘঘনা হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র) কাঁদতে শুরু করলেন। কাঁদছেন তাে কাঁদছেনই। সে কান্না চলল দীর্ঘক্ষণ। আর ঐ অবুঝ প্রাণীটি কী বুঝল কে জানে, তাঁর কান্না দেখে যেমন এসেছিল, তেমনি চলে গেল। তাঁর শিষ্যরা এবার তাঁকে ধরে বসলেন, এর রহস্য কী হুজুর!

তিনি বললেন, আল্লাহর ধ্যান শুরু করার সময় তার মনে একটা ইচ্ছা জাগে, যদি আল্লাহ একটি ছাগল জুটিয়ে দেন তাে, সেটিকে জবাই করে মাংস রান্না করে শিষ্যদের বেশ তৃপ্তি সহকারে খাওয়ান যাবে। আর এ ইচ্ছার স্ফরণ ঘটার সঙ্গে সঙ্গে হরিণ এসে যা করল, তা তাে সবাই দেখলেন। এটা তাে বেশ আনন্দের কথা, শিষ্যরা বললেন, । কিন্তু খুশি না হয়ে আপনি ওভাবে কাঁদতে লাগলেন কেন?

তিনি বললেন, হরিণের আগমনে তার মনে হলাে, এ নিরীহ প্রাণীটি বুঝি তাকে আল্লাহর ধ্যান থেকে সরিয়ে এসেছে। কেননা, আল্লাহ যদি মিশর অধিপতি ফেরাউনের হিত কামনা করতেন, তাহলে ফেরাউনের ইচ্ছা ও আদেশক্রমে নীলনদীর পানির প্রবাহ বন্ধ এবং প্রবাহিত হতাে না। একবার হযরত আবু ওসমান (র) বলেন, মানুষের মঙ্গলের জন্য তিনি কিছু উপদেশে দিতে চান। হযরত আবু ওসমান (র) তাঁকে এও বলেন যে, মানুষের প্রতি তার অসীম মমতা। এমনকি, জাহান্নাম থেকে মানুষকে বাঁচাতে তিনি নিজে শাস্তি গ্রহণ করতে রাজি।

হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র) তাঁকে বলেন, অন্যকে উপদেশ দেয়ার আগে উপদেশ নিতে হবে। এ-ব্যাপারে খুব সতর্ক হওয়ার জরুরী। যেমন, বক্ততার সময় শ্রোতার সংখ্যা যদি খুব বেশি হয়, তাহলে মনে যেন এতটুকু অহমিকা না জন্মে। সব সময় মনে রাখা দরকার যে, আল্লাহ সর্বদর্শী। এরপর একদিন সত্যিই এক বিশাল সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়র জন্য গেলেন আবু ওসমান (র)। আর ঐ সমাবেশে হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র)-ও গােপনে বসে রইলেন। বক্তৃতা শেষ হলাে। 

মিম্বর থেকে হযরত ওসমান (র) নেমে আসবেন, এমন সময় একটি লােক দাড়িয়ে সভায় একখানি কাপড় চাইল। আবু ওসমান (র) তৎক্ষণাৎ তার গায়ের চাদরখানি তাকে দান করলেন। আর যায় কোথা! হঠাৎ হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র) তাঁর কাছে এসে ধমক দিলেন, নেমে এস মিম্বর থেকে। তুমি এখনও মানুষকে নসীহত করার যােগ্যতা অর্জন করনি। 

আবার তুমি দাবী কর, মানুষের প্রতি তােমার প্রচুর যােগ্যতা অর্জন করনি। আবার তুমি দাবী কর, মানুষের প্রতি তােমার প্রচুর ভালােবাস। তােমার দাবী যদি সত্য হতাে, তাহলে চাওয়ামাত্র অত তাড়াতাড়ি লােকটিকে তুমি চাদরখানা দান করতে না। তার মানে, অন্য পুণ্যের অধিকারী হতে চাইলে। প্রকৃতই তুমি যদি মানবদরদী হতে তাহলে এ-ব্যাপারে একটু সবুর করে অন্য কাউকে অগ্রবর্তী দাতা হওয়ার সুযােগ দিতে।

আরও একবার। হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (র) ও হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র) -এর মধ্যে কথাবার্তা চলছে। সেখানে উপস্থিত আছেন বিশিষ্ট কিছু লােক। কথা বলা ফাকে তাঁরা হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র) -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন গুণের মধ্য দিয়ে মানুষের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়? তিনি তখন হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (র)-কে লক্ষ্য করে বললেন, আপনিই এদের ইচ্ছাটা না হয় পূরণ করুন। 

হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (র) বললেন, কোন লােক কোন বীরত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করে যেন ধারণা করে যে, কাজটি তার দ্বারা সাধিত হয়েছে। আর সে মুখে প্রকাশ না করে। অর্থাৎ বীরত্বপূর্ণ কাজটির সঙ্গে সে যে সংশ্লিষ্ট, তা কোন লক্ষণাদির দ্বারাই যেন প্রকাশ না পায়। এটাই মানুষের প্রকৃত বীরত্ব।

এবার মুখ খুললেন হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র)। হযরত জুনায়েদ (র)-এর বিশ্লেষণ যে যথার্থ, তা স্বীকার হয়ে তিনি বললেন, তার মতে আসলে বীরত্ব হলাে এ যে, কোন লােক অন্যের প্রতি সুবিচার করে, কিন্তু বিনিময়ে অন্যের কাছে তা প্রার্থনা করে না। হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র) -এর এ অপূর্ব ব্যাখ্যায় হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (র) খুব বেশি খুশি হয়ে উপস্থিত লােকদের বললেন, তােমরা এটি মনে রেখে আমল করাে। আর জেনে রেখাে, হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র) বান আদমকুলের মধ্যে বীরত্বে সেরা। তিনি বীরত্ব প্রসঙ্গে যা বললেন, তা যদি প্রকৃত হয় তাহলে আমি এখনও বীরত্বের সন্ধান পাইনি। 

হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র) -এর শিষ্যগণ তাঁকে যেমন ভক্তি করতেন, তেমনি ভয়ও করতেন। চোখ তুলে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতেন হাত জোড় করে, মাথা নিচু অবস্থায়। বসার ইশারা পেলে তবেই বসতেন। যেন এক সম্রাট বসে আছেন দরবারে এ রকম ছিল তার দরবারী ব্যক্তিত্ব। এ দৃশ্য দেখে হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (র) একদিন বলেন, আপনি কি আপনার শিষ্যদের রাজসভায় বসিয়ে রাজনীতি শিক্ষা দিচ্ছেন?

তিনি বলেন, এ প্রশ্নের কোনও প্রয়ােজন নেই। বইয়ের মধ্যে বিষয়ের শিরােনাম দেখেই সে বিষয়ের পরিচয় পাওয়া যায়।

একবার হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র) হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (র)-কে এক ডেকচি শাহী পায়েস ও হালুয়া তৈরি করতে বললেন । পায়েস ও হালুয়া তৈরি হলে তিনি বললেন, একটি লােকের মাথায় তুলে দিয়ে তাকে যথাসাধ্য দ্রুত হাঁটতে বলুন। তারপর ডেকচি বয়ে নিয়ে যেতে সে যেখানে ক্লান্ত হয়ে পড়বে, তার সবচেয়ে কাছের বাড়ির লােককে ডেকে তা দিয়ে দিতে হবে। তাই করা হলাে। পায়েস ও হালুয়ার ডেকচি মাথায় নিয়ে একটি লােক যত দ্রুত সম্ভব চলতে লাগল। তার সঙ্গে গেল আরও একটি লােক। তার কাজ হলাে হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র) নির্দেশমতাে তাদের যথাযথ উপদেশ দেয়া।


ডেকচি-বাহক সত্যিই একখানি বাড়ির কাছে ডেকচি নামিয়ে বিশ্রাম নিতে বসল। আর তার সাথের লােকটি গেল সবচেয়ে নিকবর্তী বাড়ির লােকজনকে ডাকতে। বাড়ির ভেতর থেকে বেড়িয়ে এলেন এক বৃদ্ধ। বললেন, তুমি যদি পায়েস আর হালুয়া দুটোই এনে থাক, তাহলে বল, ঘর থেকে বের হয়ে আসি। তা না হলে এসে কোন লাভ নেই। সাথী লােকটি তাে রীতিমত অবাক! পায়েস ও হালুয়ার খবর ইনি জানালেন কী করে? তার কৌতুহলের উত্তরে বৃদ্ধ বললেন, আমার ছেলেটি অনেকদিন থেকে পায়েস আর হালুয়া খেতে চাইছে। 

গতকাল মােনাজাতের সময় কথাটা আমার মনে পড়ে। তখন নিজের মনে মনে বলি, এর জন্য দোয়া করার প্রয়ােজন কি? আল্লাহর ইচ্ছা হলে তা আপনিই চলে আসবে। এখন তােমার ডাক শুনেই মনে হলাে, আল্লাহ নিশ্চয় আমার জন্য তা পাঠিয়ে দিয়েছেন। বৃদ্ধের বিবরণ শুনে আর দ্বিরুক্তি না করে তখই পায়েস ও হালুয়া বৃদ্ধের বাড়িতে পৌছে দেয়া হলাে।

হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র)-এর একজন মুরীদ ছিলেন-যেমন চরিত্রবান, তেমনি বিনয়ী। তার সম্পর্কে হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (র) একদিন জিজ্ঞেস করলেন, এ লােকটি কতদিন ধরে এখানে আছে? হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র) বললেন, প্রায় দশ বছর।

হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র) বললেন, ভারি সৎ ও চরিত্রবান লােক। হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র) বললেন, হ্যাঁ শুধু তাই নয়, আমার কাজে সে সওর হাজার দীনার ব্যয় করেছে, আর সেজন্য তার আরও সত্তর হাজার দেনা রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার তার সাহস হচ্ছে না।

একবার মক্কা শরীফে পৌছে তিনি মানুষের সৈন্য-দারিদ্র্য ও দুঃখ-কষ্ট প্রত্যাক্ষ করেন। তখন দুংখার্ত মানুষের জন্য কিছু সাহায্য দেয়ার ইচ্ছা তাঁর মনে জাগে। সে সঙ্গে সৃষ্টি হয় এক অপূর্ব ভবানুভূতির। একখণ্ড পাথর তুলে নিয়ে তিনি আল্লাহর দরবারে হাত ওঠালেন। হে দয়াময়! আপনার সম্মানের শপথ, এ সময়ে আপনি যদি আমাকে কিছু সাহায্য না করেন, তবে এইপাথর

ছুঁড়ে আমি এ মসজিদের সব লণ্ঠন টুকরাে করে ভেঙে ফেলব। এ কথা বলে তিনি কাবা শরীফ তাওয়াফ করতে শুরু করলেন। আর ঠিক এ সময়ে কোন এক অচেনা লােক এসে তাঁর হাতে একটি টাকার থলে তুলে দিয়ে চলে গেলেন। হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র) সে টাকা বিলিয়ে দিলেন অভাবস্ত মানুষদের। তারপর হজ্জ সম্পন্ন করে ফিরে এলেন বাগদাদে। 

হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (র) তাকে বললেন, আমার জন্য কী উপহার এনেছেন? হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র) উত্তর দিলেন, আপনার জন্য এবারের উপহার হলাে এ যে, যদি কেউ আপনার সঙ্গে কোন অপরাধমূলক আচরণ করে, তাহলে সে অপরাধকে আপনি নিজের বলে মনে করবেন।  তবে আপনার প্রবৃত্তি যদি এতে শান্ত না হয়, তাহলে তাকে ধমকে দিন। বলুন, অপরাধী ব্যক্তিকে সে যদি ক্ষমা করতে না পারে, তার সঙ্গে আপনার বিচ্ছেদ ঘটবে। অথার্ৎ এভাবে তাকে সন্ত্রাস্ত করে তুলে তার দ্বারা নিজের ইচ্ছা পালন করান।

হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র)-এর উপদেশ শুনে হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (র) বললেন, এ ধরনের হিম্মত ও মরতবা আল্লাহ কেবল আপনাকেই দান করেছেন। 

একবার হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র)-কে একাদিক্রমে চার মাস আল্লামা শিবলী আতিথেয়তা দেখান। প্রতিদিন নতুন নতুন উপাদেয় খাদ্য পরিবেশন করা ছাড়াও নানাভাবে তাঁর পরিচর্যা করেন। বিদায়কালে হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র) বললেন, আপনি যদি কখনও নিশাপুরে যান, তাহলে আমি আশা করি, আপনাকে আতিথেয়তায় বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শন করতে পারব। আল্লামা শিবলী (র) বললেন, কেন হুজুর, আমার কি কিছু ত্রুটি হয়েছে? হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র) বললেন, আতিথেয়তার ব্যাপারে আপনি খুব বাড়াবাড়ি করেছেন। 

এতটা উচিত নয়। আতিথেয়তা এমন হওয়া উচিত, যাতে অতিথির আপ্যায়ণে এমন হওয়া উচিত, যাতে অতিথি আপ্যায়ণে অতিথিসেবক অসন্তুষ্ট এবং বিদায়কালে খুশি না হন। অতিথির আগমণে অতিথিসেবক যদি কথাবার্তায়, হাবভাবে, চাল-চলনে, আপ্যায়ণের উপকরণ সংগ্রহে স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখতে পারেন, তাহলে বােঝা যাবে, তিনি ভীরু। এবং তার আপ্যায়ণ-প্রচেষ্টা কৃত্রিম, আন্তরিকতাহীন।

অবশ্য কিছুদিন পর হযরত আল্লামা শিবলী (র) নিশাপুরে এসে হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র) -এর অতিথি হলেন। সেদিন আবার তার বাড়িতে আরও চল্লিশজন মেহমান ছিলেন। রাতের খাবারের জন্য একচল্লিশ জনের জন্য একচল্লিশটি বাতি জ্বালানাে হলাে। 

আল্লামা শিবলী (র) বললেন, আপনিই তাে বলেছিলেন, আতিথেয়তার বাড়াবাড়ি করতে নেই। অথচ আপনি আজ,অতিথিদের সম্মানে একচল্লিশটি বাতি জ্বালালেন। আপনার কথামতাে এটাকে বাড়াবাড়িই বলা চলে। তখনই হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র) বললেন, যদি বাড়াবাড়ি মনে হয়, তাহলে বাতিগুলি নিভিয়ে দিন।

হযরত শিবলী (র) বাতি নেভাতে গিয়ে একটি ছাড়া অন্যগুলি নেভাতে পারলেন না। অবাক হয়ে তিনি বলেন, বাতিগুলি নেভানাে গেল না। এর কারণ কী হুজুর? হযরত আবু হাফস হা্দ্দাদ খােরাসানী (র) বললেন, আজকের মেহমানের জন্য বাতি জ্বেলেছিলাম। যেটি নিভে গেল, সেটি জ্বালিয়েছিলাম আমার নিজের জন্যই। অর্থাৎ সেটি আল্লাহর জন্য জ্বালানাে হয়নি। 

তাই আপনি নিভিয়ে দিতে পেরেছেন। আসলে আমি যতটুকু যা করেছি, সবই আল্লাহর জন্য। আর বাগদাদে আপনি যা করেছেন, তা শুধু আমাকে খুশি করার উদ্দেশ্যে। অতএব আমার আপ্যায়ণে কোন বাড়াবাড়ি নেই। সে ছিল আপনার আতিথেয়তায়।

আপনি কী উদ্দেশ্যে আল্লাহর দিকে এভাবে ফিরলেন? এ প্রশ্নের উত্তরে হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র) জানান, একজন গরিব একজন ধনীর নিকট কী উদ্দেশ্যে গমন করে? আবদুল্লাহ মুসলামী ছিলেন, হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র)-এর এক পরম ভক্ত। তিনি মৃত্যুর পূর্বে বলে যান, আমার মৃত্যুর পর হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র) পায়ের ওপর আমার মাথাটি যেন রেখে নেয়া হয় ।

অধিপতি ফেরাউনের হিত কামনা করতেন, তাহলে ফেরাউনের ইচ্ছা ও আদেশক্রমে নীলনদীর পানির প্রবাহ বন্ধ এবং প্রবাহিত হতাে না। একবার হযরত আবু ওসমান (র) বলেন, মানুষের মঙ্গলের জন্য তিনি কিছু উপদেশ দিতে চান। আবু ওসমান (র) তাকে এও বলেন যে, মানুষের প্রতি তাঁর অসীম মমতা। এমনকি, জাহান্নাম থেকে মানুষকে বাঁচতে তিনি নিজে শাস্তি গ্রহণ করতে রাজি।

হযরত আবু হাফস হা্দাদ খােরাসানী (র) আরবী জানতেন না। কেননা, তিনি ছিলেন খোরাসানের লােক। একবার কিছু শিয়্য-সহ হজ্জ করে তিনি বাগদাদে যান। তার সঙ্গীরা বলেন, সঙ্গে একজন দোভাষী থাকলে কথাবার্তা বলার বেশ সুবিধা হতাে। ওদিকে তাঁকে নিজের দরবারে স্বাগত জানাবার জন্য কয়েকজন শিষ্যকে পাঠিয়ে দিয়েছেন হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (র)। 

হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খােরাসানী (র) তাদের সঙ্গে হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (র)-এর দরবারে গেলেন। আর সেখানে পৌছে অনায়াস ভঙ্গিতে হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (র)-এর সঙ্গে আরবী ভাষায় অনর্গল কথা বলে গেলেন। যেন আরবী তার মাতৃভাষা। আর এই অলৌকিক কাণ্ড দেখে সবাই তাজ্জব হয়ে গেলেন।

আরও পড়ুনঃ  

* হযরত আবু হাসান নূরী বাগদাদী (রাঃ) জীবনী

* হযরত আবু সাইদ খাযযার (রাঃ) জীবনী

* হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রাঃ) জীবনী

* হযরত আবু সুলায়মান দারায়ী (রাঃ) জীবনী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ