বিখ্যাত মনীষী হযরত ইমাম শাফেয়ী (রঃ) জীবনী
অল্পবয়সী একটি ছেলে-বয়সের তুলনায় রীতিমতাে গম্ভীর আর ভাবুক। কোথাও বড় একটা যায় না। কোন নিমন্ত্রণ কিংবা অনুষ্ঠানেও না। চুপচাপ বসে থাকে নির্জনে। আর কত কী ভাবে। সেই ছেলে একদিন এক অপূর্ব স্বপ্ন দেখল । স্বয়ং রাসূলুল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করছেন, হে বালাক! তুমি কে? বালক উত্তর দিলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ (স), আমি আপনার এক অধম উম্মত। তিনি তখন তাঁকে কাছে ডাকলেন। আর তাঁর পবিত্র মুখের লালা বালকের মুখে ঢুকিয়ে দিলেন। তরপর বললেন, যাও, তুমি আল্লাহর বরকত লাভ করবে। ঐ রাতে সে আরও একটি স্বপ্ন দেখল হযরত আলী (র) তাঁর হাতের আংটি খুলে তার আঙুলে পড়িয়ে দিল।
এমন পরম সৌভাগ্যবান বালক পরবর্তীকালে বিশ্বজোড়া খ্যাতির অধিকারী হন। পৃথিবী তাঁকে জানে হযরত ইমাম শাফেয়ী (র) নামে। মাত্র তেরাে বছর বয়সেই তিনি ঘােষণা করেন, কারাের কিছু জানার থাকলে তার কাছে জেনে নিতে পারে। আর পনেরাে বছর বয়সেই তিনি ফতােয়া দিতে শুরু করেন। শরীয়ত ও মারেফাত সমুদ্রের তিনি এক সফল ডুবুরী। হাকীকত ও তরীকতের ক্ষেত্রেও মণিপূর্ণ খনি। হযরত আহমদ ইবনে হাম্বল (র)-এর মতাে অভিজ্ঞ ও বিজ্ঞ ব্যক্তিও তাঁকে প্রচুর সম্মান দিতেন।
অনেক সময় তা দৃষ্টিটুকু দেখাতাে বলে কেউ কেউ বলতেন, একজন বয়ঃকনিষ্ঠ ব্যক্তিকে এমন সম্মান প্রদর্শন শােভনীয় নয়। হযরত আহমদ ইবনে হাখাল (র) বলতেন, তিনি আমার চেয়ে অনেক বেশি জানেন। আর তাঁর সাহচর্যে থেকেই আমি হাদীস শাস্ত্রের বিশ্লেষণ-ব্যাখ্যা শিখেছি। তিনি না থাকলে, আমি জ্ঞানের দরজায় শুধু দাঁড়িয়ে থাকতােম। ভেতরে যাওয়া সম্ভব হত না। আর ফেকাহ বিদ্যার দরজা চিরতরে বন্ধ থাকত।
আমহদ ইবনে হাম্বল (র) এর মতে, ইসলামে ইমাম শাফেয়ী (র)-এর অবদানই সর্বাপেক্ষা বেশি। হযরত সুফিয়ান সাওরী (র)-এর মতে, যদি ইমাম শাফেয়ী (র)-এর জ্ঞান এক পাল্লায় আর পৃথিবীর অর্ধেক লােকের জ্ঞান অন্য পাল্লায় চড়ানাে হয়, তবেহযরত শাফেয়ী (র)-এর পাল্লাই ভারী হবে। হযরত বেলাল খাস (র) বলেন, আমি হযরত খিজির (আ) কে জিজ্ঞেস করলাম, হযরত শাফেয়ী (র) সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? তিনি বলেন, শাফেয়ী (র) এক বিশেষ শ্রেণীর আউলিয়াদের অন্তর্ভুক্ত।
উপযুক্ত মায়ের উপযুক্ত সন্তান তিনি। তাঁর বিদুষী জননীকে দেশে লােকে যেমন শ্ৰদ্ধা করত, তেমনি বিশ্বাসও করত। অনেকে তাঁর কাছে অনেক কিছু আমানত রাখত। একবার দু'জন লােক কাপড় ভর্তি একটা বাক্স রাখলেন। কিছুদিন পর একজন এসে তা নিয়েও গেলেন। কিন্তু, কিছুদিন। পর অন্যজন এসে আবার বাক্স দাবী করল। তাকে বলা হল, তাঁর সাথী বাক্সটি নিয়ে গেছে। তখন তিনি বললেন, আমরা দু'জনে যে জিনিসটা রাখলাম, আপনি তা একজনকে দিলেন কিভাবে?
বলাবাহুল্য ইমাম-জননী খুব অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। আর লজ্জার সীমা রইল না তাঁর, শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন, তখন তাঁর বয়স প্রায় সত্তর। ইমাম শাফেয়ী (র) তাঁর মুর্শিদের বাসভবনের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতেন, দারােয়ানের মতাে। কেউ কোন ফতােয়া লিখে নিয়ে যখন বেড়িয়ে যেতেন, তখন তিনি দরজায় বসে তা গভীর মনােযােগ দিয়ে পড়ে দেকতেন। কোন অসঙ্গতি চোখে পড়লে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আবার ভেতরে ইমাম মালেক (র)-এর কাছে পাঠিয়ে দিতেন, যেন তিনি সেটি আবারও পরীক্ষা করে দেখেন। আর ইমাম মালেক (র) বুঝতে পারতেন তাঁর শিষ্যই ঠিক। বলাবাহুল্য শিষ্যের যােগ্যতায় তিনি যেমন আনন্দ, তেমনি গর্ব বােধ করতেন।
বাদশাহ হারুন অর রশিদের বিচার করলেন ইমাম শাফেয়ী (র)ঃ বাগদাদে সিংহাসনে তখন খলিফা হারুন অর রশীদ। এক রাতে বেগম যুবায়দার সঙ্গে তাঁর তুমুল ঝগড়া। বেগম জোবায়দা তাে খলিফাকে বলেই বসলেন জাহান্নামী। বাদশাহও কম যান না। পত্নীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে তিনিও বললেন, যদি আমি জাহান্নামী হই, তবে তুমি তালাক। আর, এরপরেই তারা পরস্পর পৃথক হয়ে গেলেন। কিন্তু খলিফা হারুন রশীদ প্রিয়তমা পত্নীর এ বিচ্ছিন্নতায় বড় চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
ডাক পড়ল বাগদাদের বিজ্ঞজনের। সমস্যাটা তাদের সমীপে পেশ করা হল। সবাই বলতে লাগলেন, বাদশাহ জাহান্নামী না জান্নাতী, তা আমরা জানব কী করে? অর্থাৎ সমস্যার সমাধান-সূত্র পাওয়া গেল না। এমন সময় এক বালক সভাস্থলে দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে এ মাসয়ালার সমাধান দিতে আজ্ঞা হােক। বলে কী ছেলেটা? পাগল নাকি? বিদগ্ধজনরা যা পারলেন না, সে তা পারবে বলে স্পর্ধা দেখায়! কিন্তু খলিফা তাকে অনুমতি দিলেন।
বালক বললাে, জাহাপনা, আপনার নিকট আমার প্রয়ােজন, না আমার নিকট আপনার প্রয়োজন? খলিফা বললেন, তােমার নিকট আমার প্রয়ােজন। তাহলে আসন থেকে নেমে আসুন। ছেলেটি তার কারণটাও সে বলে দিল। অর্থাৎ আলেমগণের স্থান উচ্চে। আল্লাহ্ তাঁদের বেশি সম্মান দিয়েছেন। খলিফা হারুন-অর রশীদ সঙ্গে সঙ্গে নিচে নেমে এসে তাঁর আসনে বালককে বসিয়ে দিলেন। এবার সে বাদাশাকে প্রশ্ন করে।
আপনি কখনও শক্তি ও সুযােগ থাকা সত্ত্বে ও পাপের কাজ না করে কেবল আল্লাহর ভয়ে তা থেকে বিরত থেকেছেন? খলিফা বললেন, আল্লাহর কসম, বহুক্ষেত্রেই এমনটি হয়েছে . তাহলে-ছেলেটি বলল, আমি ঘােষণা করছি, নিঃসন্দেহে আপনি জান্নাতি। সঙ্গে সঙ্গে শোরগােল পড়ে গেল। বিদ্ধ জনেরা সমস্বরে বলে উঠলেন, তুমি কোন যুক্তি ও প্রমাণ বলে এ কথা বলছ? সে বল । কেন, পাক কুরআনেই তাে এর স্পষ্ট প্রমাণ আছে। আল্লাহ ঘােষণা করেছেন, আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে যে ব্যক্তি প্রবৃত্তিকে পাপকর্ম থেকে বিরত রাখে, নিশ্চয় জান্নাত তার জন্য অবধারিত।
সভা স্তম্ভিত হয়ে গেল। এত অল্প বয়সে যার এমন বিরল প্রতিভা, পরিণত বয়সে না জানি আল্লাহ তাকে আরও কত আলােকিত করবেন। আমরা জেনেছি, স্বপ্ন যােগে যে বালক রাসূলুল্লাহ (স)-এর পবিত্র মুখ-বিবরের লালা লাভ করেছিল, আংটি পেয়েছিল বীরকেশরী হযরত আলী (রা) এর, এ সেই বালক। আর সেদিনের সে বালকই পরিণত বয়সের হযরত ইমাম শাফেয়ী (র)।
ইমাম শাফেয়ী (র) জীবনে কখন হারাম রুজি খাননি। একবার এক সৈনিকের আতিথ্য গ্রহণ করে তিনি তার বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করেন। পরে এর প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ একটানা চল্লিশ রাত ভাের পর্যন্ত নামাজ আদায় করেন। অতবড় জ্ঞানী ও সাধক হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজেকে অতি ক্ষুদ্র মনে করতেন। একবার এক ধনী ব্যক্তি মক্কার সাধক-দরবেশগণের উদ্দেশে বেশ কিছু টাকা পাঠান। তিনি তা গ্রহণ করেননি এ বলে যে, তিনি তেমন পুণ্যবান সাধক নন।
রােমের খ্রীষ্টান শাসক বাগদাদের খলিফা হারুন-অর রশীদকে প্রতি-বছর বার্ষিক কর পাঠাতেন। একবার তিনি কিছু তত্ত্বজ্ঞানী পাদ্রী পাঠিয়ে খলিফাকে বলেন, আমার পাদ্রীগণের সঙ্গে আপনার মুসলিম পণ্ডিতগণ যদি তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তাদের হারিয়ে দিতে পারেন, তাহলে আমি নিয়মিত কর দেব। আর তা যদি না পারেন, তবে কর দেয়া বন্ধ করে দেব। রােম থেকে চারশাে পাদ্রী এসেছিলেন।
খলিফা এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের বিখ্যাত পণ্ডিতগণকে সমবেত করে তর্কনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। তর্ক বসল দজলা নদীর তীরে। মুসলিম আলেমগণের নেতৃত্ব করার জন্য হযরত শাফেয়ী (র)-কে বলা হল। তিনি তর্কস্থানে উপস্থিত হয়ে দজলা নদীর পানির ওপর জায়জানায় বিছিয়ে বসলেন। আর ডাক দিলেন খ্রীস্টান পাদ্রীদের। আসুন, আমরা এখানে বসেই আলােচনা আরম্ভ করি।
কিন্তু এই অলৌকিক কাণ্ড দেখে তারা আর তর্কযুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন না। শুধু তাই নয়, সবাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। আর এ খবর যখন রােম সম্রাটের কাছে গিয়ে পৌছল, তখন তিনি বললেন, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, এদেশে তর্কের স্থান নির্ধারিত হয়নি। তাহলে, হয়তাে দেশের সব খ্রীস্টান মুসলমান হয়ে যেত।
হযরত ইমাম শাফেয়ী (র) কিছুদিন মক্কা শরীফে অবস্থান করেন। তখন তার আর্থিক অনটন ছিল। রাত্রে বই পড়তেন চাদের আলােয়। একজন কেউ বললেন, কাবাঘরের কাছে যে আলাে শুধু কাবার উদ্দেশেই জ্বালানাে হয়েছে। সুতরাং তাতে অন্য কিছু করা ঠিক নয়। তাঁর ধর্মনিষ্ঠার এ এক অসাধারণ উদাহরণ।
হযরত ইমাম শাফেয়ী (র)-এর মর্যাদাহানির জন্য একদিন এক ব্যক্তি খলিফা হারুন-আর রশীদকে বললেন, ইমাম শাফেয়ী (র) কুরআন মুখস্থ করেননি। কথাটা বিশ্বাস হল না খলিফার। তবুও তা পরীক্ষা করার জন্য তিনি তাকে রমযান মাসের তারাবীহের নামাযে ইমাম নিযুক্ত করলেন।
কেননা, তারাবীর নামাযে কুরআন শরীফে খতম করার রীতি বরাবর চলে আসছে সেখানে প্রমাণিত হবে, কুরআন তার মুখস্থ কিনা। ইমাম শাফেয়ী (র)-এর অবশ্য একটু অসুবিধা হলাে। কিন্তু তিনি সে বিষয়ে সজাগ ও তৎপর হলেন। প্রতিদিন দিনের বেলায় এক পারা মুখ কতেন আর রাতে তারাবীহের নামাযে তা আবৃত্তি করতেন। এভাবে এক রমযান মাসে পুরে কুরআন শরীফ খতম হয়ে গেল । আল্লাহ তার মর্যাদা ও সম্মান অক্ষুন্ন রাখলেন।
হযরত ইমাম শাফেয়ী (র)-এর ইন্তেকালঃ রবিয়ে খাশাম বলেন, ইমাম শাফেয়ী (র)-এর মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে স্বপ্ন দেখলাম, হযরত আদম (আ)-এর মৃত্যু হয়েছে আর লােকজন তাঁর মরদেহ বাইরে আনার ব্যবস্থা করছে। ঘুম থেকে জেগে উঠে আমি এক আলেমের কাছে এর ব্যাখ্যা চাইলাম। তিনি বললেন, বর্তমান কালের সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি এ দুনিয়া থেকে বিদায় নেবেন। হযরত আদম (আ) তাঁর বিদ্যাবওার জন্যই ফেরেশতাগণের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হন। এ যুগে সেদিক দিয়ে ইমাম শাফেয়ী (র) ও যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন, তা ঐ স্বপ্নের মাধ্যমেই প্রতীয়মান হয়।
মৃত্যুর আগে তিনি বলে যান, অমুক লােক তাকে গোসল করিয়ে দেবেন, কাফন পরিয়ে দেবেন। যার কথা বলা হয়, তিনি তখন মিশরে ছিলেন। তিনি যখন দেশে ফিরলেন, তখন ইমাম শাফেয়ী (র) আর ইহলােকে নেই। ইমাম সাহেবের ইচ্ছার কথা তাকে বলা হল। তাতে হযরত ইমাম শাফেয়ী (র)-এর সত্তর হাজার টাকার ঋণের কথাও লেখা ছিল। ঐ ব্যক্তির তাঁর ঋণ পরিশােধ করে দিলেন। আর বললেন, আমার দ্বারা গােসলের অর্থ হল এ ঋণ পরিশােধ করে দেয়া। ইমাম শাফেয়ী (র) মাত্র চুয়ান্ন বছর বয়সে ২০৪ হিজরীতে জান্নাতবাসী হন।
আরও পড়ুনঃ
* হযরত শায়খ আবু বকর কেতানী (রাঃ) জীবনী
* হযরত আবু হাসান নূরী বাগদাদী (রাঃ) জীবনী
0 মন্তব্যসমূহ