নতুন পোস্ট

6/recent/ticker-posts

হযরত আবু সাঈদ খাযযার (রঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী বাংলা


 

হযরত আবু সাঈদ খাযযার (র)

তাপস-নগরী বাগদাদের আরও একজন সুযােগ্য সন্তান হলেন হযরত আবু সাঈদ খাযযার (র)। সাধারণত তিন মারেফাতের ভাষ্যকার নামে পরিচিত। কেননা, সমকালে এ বিষয়ে তিনি চারশাে বই লেখেন। সেগুলি ইসলামের অমূল্য সম্পদ। 

তাঁর প্রাত্যহিক জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হয় হযরত যুননূর মিশরী (র) ও হযরত বিশরে হাফি (র)-এর সান্নিধ্য-সংস্পর্শে। ফানা (ধ্বংস) ও বাকার (স্থায়ীত্) তত্ত্ব তিনিই সর্ব প্রথম বর্ণনা করেন। তাঁর মতামতকে তিনি উত্ত দুটি কথার মাধ্যমে প্রকাশ করেন। মারেফাতের কিছু কিছু ব্যাপারে কোন কোন পণ্ডিত তার বক্তব্যকে অস্বীকার করেন। এমনকী তাঁরা তার বিরুদ্ধে কুফরী অবিযােগও তােলেন। তাঁর একখানি বইয়ের নাম কিতাবুস সিরবি-তত্ত্বগ্রন্থ। এ বইয়ের কিছু কিছু কথার ভুল ব্যাখ্যা হয়। 

ধর্মহীনতার অভিযােগের তাও একটি কারণ। যেমন, তিনি লিখেছিলেন আল্লাহর দিকে রুজু একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত সমগ্র সৃষ্টি এমনকি রিপু পর্যন্ত বিস্মৃত হয়ে যায় এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেই স্থিত হয়। তখন যদি তাকে বলা হয়, তুমি কোথাকার লােক এবং কী কী কামনা করছ? তখন এ প্রশ্নের উত্তরে শুধু আল্লাহ বলা ছাড়া তার পক্ষে উত্তম জবাব আর কিছুই হবে না। 

এ ধরনের সুফীগণকে যদি প্রশ্ন করা হয়, তুমি কী চাও, তবে তিনি জবাবে বলবেন, আল্লাহ, এমনকি তাঁর প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও বলতে থাকবে, আল্লাহ জাল্লা জালালুহু। কেননা, এ শ্রেনীর সুফীগণের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও আল্লাহর জ্যোতির প্রেমে ডুবে যায় এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের এমন সীমায় পৌঁছায় যে, কেউ তার সামনে আল্লাহ শব্দ উচ্চারণ করলেই তিনি আহর প্রেমে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন ধারণা করেন যে, এ শব্দ দাসের নয়, বরং স্বয়ং মহান প্রভুর থেকে এসেছে। 

এখানে পৌঁছেই সমস্ত জ্ঞানীর জ্ঞনের ভরাডুবি ঘটে। হযরত আবু সাঈদ খাযযার (র) কয়েক বছর সুফীদের সান্নিধ্যে থাকেন। তখন তাদের সঙ্গে তাঁর কোন মতবিরােধ ছিল না। পরে অবশ্য তিনি পৃথক হয়ে যান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমার মধ্যে কাছে, দুজন ফেরেশতা আকাশ থেকে অবতরণ করে তাকে জিজ্ঞেস করেন, সত্য কি? তিনি উত্তর দেন, প্রতিশ্রুতি পালন করা।

তিনি ঠিক বলেছেন বলে মন্তব্য করে তারা চলে গেলেন। একবার রাসূলে করীম (স) তাকে স্বপ্নের মধ্যে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আমাকে ভালােবাস? তিনি জবাব দেন, মাফ করবেন, মহান প্রভুর ভালােবাসায় নিমগ্ন হয়ে অন্য যে কোন দিক থেকে আমি গাফেল হয়ে পড়েছি। রাসুলুল্লাহ  (স) বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভালােবাসে, সে আমাকে ও ভালােবাসে।

একবার তিনি শয়তান ইবলীসকে স্বপ্নে দেখে তাকে মারার জন্য লাঠি তােলেন। তখন অদৃশ্যবাণী আসে, ইবলীস লাঠিকে ভয় পায় না। বরং ভয় করে বিশ্বাসীদের অন্তর জ্যোতিকে। তখন আবু সাঈদ খাযযার (র) ইবলীসকে তাঁর কাছে ডেকে বসতে বললেন। ইবলীস বললে, আর বসে কাজ নেই। কারণ, যে বস্তু দিয়ে আমি মানুষকে প্রবঞ্চিত করি, আপনি আপনার অন্তর থেকে তা বের করে দিয়েছেন। আমার ছলনায় ভােলে না। অবশ্য আপনার যখন দুটি পুত্র আছে, তখন কোন না কোন সময় আপনি আমার ফাঁদে পড়বেন।

হযরত আবু সাঈদ খাযযার (র)-এর দুটি পুত্র ছিল। একজন তাঁর জীবিতকালে মারা যান। মৃত পুত্রকে স্বপ্নে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করেন, আল্লাহ্ তােমার সাথে কিরূপ আচরণ করেছেন। ছেলে বলেন, তিনি আমাকে তার দরবারে ঠাই দিয়েছেন। আবু সাঈদ খাযযার (র) আবারও বলেন, আমাকে কিছু উপদেশ দাও। পুত্র বলে, কপট অন্তর নিয়ে আল্লাহকে কোন আচরণ প্রদর্শণ করবেন না। হযরত আবু সাঈদ খাযযার (র) বলেন, আরও কিছু বল। 

পুত্র বললেন, আরও বললে, আপনি তা কাজে পরিণত করতে পারবেন না। পিতা বলেন, কাজে পরিণত করার জন্য আমি আল্লাহর দরবারে সাহায্য প্রার্থনা করছি। পুত্র বললে, আল্লাহর উপাসনা করার জন্য সর্বদা মনকে স্বাভাবিক রাখবেন। আর একটির বেশি জামা কখনও ব্যবহার করবেন না। শােনা যায়, সেদিন খেকে আমৃত্যু-ত্রিশ বছর, তিনি কোনদিন একটির বেশি জামা ব্যবহার করেননি।

একবার তার মনে পার্থিব কিছু বস্তুর জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার ইচ্ছা জাগে। কিন্তু অদৃশ্য বাণীর মাধ্যমে তাকে জানিয়ে দেয়া হয় যে, আল্লাহর দরবারে একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া অন্য প্রার্থনা সমীচীন নয়। তিনি বলতেন, আল্লাহ যখন আমাদের রুজিদাতা, তখন আগামী কালের জন্য কিছু সঞ্চিত রাখা লজ্জার বিষয়।


একবার পথ চলতে চলতে তিনি ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েন। রিপু তাঁকে আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করার তাগাদা দেয়। তিনি শুনলেন না। তখন রিপু অন্যভাবে তাঁকে প্রতারিত করে। রিপু বলেন, খাদ্য না চাও, অন্তত আল্লাহর কাছে ধৈর্য ভিক্ষে কর। তিনি ধৈর্ষের প্রার্থনা করতে উদ্যত হয়েছেন।

আর তখনই তাঁর মনে ভাবান্তর সৃষ্টি হয়। তিনি অদৃশ্যবাণী শুনতে পেলেন, আমার বন্ধু জানেন যে, আমি তার খুব কাছে আছি। আর এও সত্য যে, যে আমার দিকে এগিয়ে আসে, আমি তাকে ধ্বংস করি না। আমার নিকট খাদ্য চাইতে তার মন চায় কেননা, খাদ্য আল্লাহর বিপরীত। বরং নিজের অক্ষমতা ও দুর্বলতার কথা স্মরণ করে সে মনে করে যে, আমার সাহায্য ছাড়া সবরও করতে পারে না। তবুও আমার নিকট ধৈর্যের প্রার্থনা করতেও সে ইতস্তত বােধ করে। আমি এমন লােককে কখনও বিনষ্ট করি না।

 এভাবে প্রবৃত্তির সঙ্গে বুঝতে তিনি একটি খেজুরের বাগানে হাজির হলেন। বাগান দেখে প্রবৃত্তি কিছুটা আশ্বস্ত বােধ করে। কিন্তু তিনি ওদিকে না গিয়ে নেমে পড়লেন মাঠে। এ সময় কাফেলার একটি লােক জোর করে তাকে ধরে নিয়ে গেল। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি যে এখানে আছি, তা তুমি জানলে কী করে? সে বললে, আমি অদৃশ্য শব্দের নি্দেশে এখানে এসেছি। ঐ শব্দ আমাকে বলে যে, আল্লাহর এক বন্ধু এক বালুস্তুপের আড়ালে আত্মগােপন করে আছে। তাকে গিয়ে নিয়ে এস।

তিনি দিনে মাত্র একবার খেতেন। কিন্তু একধারে তিনদিন অনাহারে থাকেন। আর দুর্বলতাশত এক এক জায়গায় বসে পড়েন। তখন অদৃশ্য আওয়াজ শােনা যায়, তুমি খাদ্য চাও, না শক্তি? তিনি শক্তি কামনায় কথা বললেন। আর সত্যিই তার মধ্যে এমন প্রবল শক্তি অনুভূত হল যে, অভুক্ত অবস্থায় তিনি বারাে মঞ্জিল পথ পার হয়ে গেলেন।

এক নদীতীরে একজনের সঙ্গে তাঁর দেখা, লােকটির পরণে দরবেশী জোব্বা। হাতে দোয়াত- কলম। হয়তাে কোন সাধক হবেন। অথবা কোন ধর্মতত্ত্ববিদ। এরূপ ধারণা করে তিনি তার কাছে জানতে চাইলেন, আল্লাহকে পাওয়ার মতাে পথ কি? সে বলল, দুটি পথ আছে। একটি সাধারণ লােকের জন্য, অন্যটি বিশেষ লােকদের জন্য। তবে আপনি যে পথের অনুসারী, তা আম-জনতার পথ। কেননা আপনি উপাসনাকেই মিলনের উপলক্ষ্য ও ধনসম্পদকে তার পর্দাস্বরূপ মনে করেন।

একবার এক বনে দশটি শিকারী কুকুর তাকে ঘিরে ধরে। উপায়ান্তর না দেখে তিনি মােরাকাবায় বসে গেলেন। তখন কোথা থেকে একটি সাদা কুকুর এসে অন্য কুকুরগুলিকে তাড়িয়ে দিয়ে তার কাছে দাড়ায়। তারপর তিনি যখন গন্তব্যস্থানের দিকে রওনা দিলেন, তখন সে তাঁকে কিছুদুর এগিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। একবার তার সঙ্গে আলােচনা প্রসঙ্গে হযরত আব্বাস মুহতাদী (র) বলেন, প্রভু পৃথিবীতে বাস করে, পৃথিবীর নদী-নালার পানি ব্যবহার করে ধর্মনিষ্ঠার কথা উচ্চারণ করতে লজ্জা করে না? তার কথা শুনে হযরত আবু সাঈদ খাযযার (র) লজ্জায় মাথা নিচু করে বললেন, আপনি সত্যিই খাটি কথা বলেছেন। তিনি বলেন, আল্লাহ সকলের সঙ্গে প্রেম করতে পারেন না।

হযরত আবু সাঈদ খাযযার (র)-এর উপদেশঃ 

১. সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীন। দাসের অন্তরে তাঁর ছায়া প্রতিফলিত হলে আল্লাহ ছাড়া সব দূরীভূত হয়।

২. অভিজ্ঞতা বা বিচক্ষণতার দৃষ্টি দিয়ে দেখলে মূলত তা আল্লাহর জ্যোতির আলােকেই দেখা যায়। তাঁর জ্ঞানের মূল্য আল্লাহ। কাজেই তাতে ভুল-ভ্রান্তির কোন অবকাশ নেই। বরং তাঁর মুখ থেকে যা বের হয়, তা আল্লাহর কথা বটে।

৩. আল্লাহর দাসগণের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যিনি আল্লাহর কালাম সমূহ প্রকাশে খুবই দক্ষ, পারদর্শী। তাঁরা বাকপটুও বটে। কিন্তু আল্লাহর ভয়ে একেবারে নির্বাক।

৪, অন্তরে যার আল্লাহর মারেফাত, তিনি দুনিয়া ও আখেয়াতে আল্লাহ ছাড়া কোন কিছুই দেখতে পান না। আল্লাহর কালাম ছাড়া কারও কথা তার কানে প্রবেশ করে না। আর আল্লাহ ছাড়া আর কারও দিকে মুখও করে না।

৫. আল্লাহ ছাড়া অন্য সব বস্তু থেকে মনকে মুক্ত এবং পবিত্র রাখা ও তাঁর ধ্যানে মগ্ন থাকাতেই শান্তি।

৬. ধ্যান তিন ধরনের। যথা, (ক) জিভের যিকির, অন্তর অনুপস্থিত, (খ) জিভের যিকির ও সেই সঙ্গে অন্তরের উপস্থিতি। (এটি সফল ও পুন্যযােগ্য।), (গ) ধ্যানে হৃদয় নিমগ্ন কিন্তু জিভ নির্বাক। ( এর মূল্য একমাত্র আল্লাহই জানেন।)

৭. সবকিছু থেকে সম্পর্ক শূন্য হয়ে শুধু আল্লাহর দিকে ঝুঁকে পড়ার নামই তওহীদ। 

৮. তত্ত্বজ্ঞানী পূর্ণতা প্রাপ্তির পূর্বে পার্থিব বস্তুর কামনা করে। পূর্ণতা প্রাপ্তির পর আর এ অবস্থা থাকে না। তখন সবকিছু তারই মুখাপেক্ষী।

৯. যার নৈকট্যপ্রাপ্তি হয় তাকে ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি বা বস্তুর কোন কল্পনা মনে আসে না। এলেও তার দিকে দৃষ্টি যার না। এটিই হল নৈকট্যের নিদর্শন। 

১০. আমল যুক্ত হলেই তা খাঁটি জ্ঞান হয়। যা উন্নত করে, তাই হল খাঁটি ঈমান।

১১. আল্লাহ ছাড়া কোন কিছুর যিনি মুখাপেক্ষী নন, বরং সবকিছু তারই মুখাপেক্ষী, তিনিই হলেন আরিফ বা তত্ত্বজ্ঞানী।

১২. আরিফ আল্লাহর পথে অবিরাম ক্রন্দনশীল। অতঃপর তিনি যখন তার প্রেমিকার সঙ্গে মিলিত হন, তখন তার অন্তর হতে সবকিছু বিলীন হয়ে যায়। 

১৩. সাধকের আনন্দ সাধনাতেই শান্তি। অন্য কিছুতে তাঁর শান্তি নেই।

১৪. মনে-প্রাণে আল্লাহ নির্ভরতাই হল প্রকৃত তাওয়াক্কুল।

১৫. নিজের ও আল্লাহর মধ্যে মিলনের বাধা যিনি দূর করতে পারেন না, তার তাকওয়া, মােরাকাবা, কাশক ও মােশাহাদাহ প্রভৃতি কিছুই সফল হয় না।

আরও পড়ুনঃ  

* হযরত ইউসুফ ইবনে হুসায়েন রায়ী (রাঃ) জীবনী

* হযরত আবু হাফস হাদ্দাদ খোরাসানী (রাঃ) জীবনী

* হযরত ইমাম শাফেয়ী (রাঃ) জীবনী

* হযরত ইমাম  আহমদ ইবনে হাম্বল (রাঃ) জীবনী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ