নতুন পোস্ট

6/recent/ticker-posts

হযরত ইউসুফ ইবনে হুসায়েন রায়ী (র) এর জীবনী বাংলা

 
হযরত ইউসুফ ইবনে হুসায়েন রায়ী (র)

হযরত ইউসুফ ইবনে হুসায়েন রায়ী

সুন্দর একজন তরুণ এসে পড়েছেন আরব-মরুর এক জনবসতি হিসেবে হযরত ইউসুফ ইবনে হুসায়েন রায়ী (র) এসেছেন। নিজের জন্মভূমি ছেড়ে এক অচেনা জায়গায়। এক কাফেলার সহযাত্রী হিসেবে তিনি এসেছেন। সঙ্গীদের সঙ্গে বাস করছেন আরবের একটি গোত্রের বাসভূমিতে।

বাতাস যেমন সুগন্ধ ছড়ায়, তার রূপ লাবণ্যের খবরও তেমনি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র এলাকায়। দীর্ঘকায়, পৌরুষদীপ্ত উজ্জ্বল দেহকান্তি যেন আল্লাহ পাকের প্রিয়দর্শী নবী ইউসুফ (আ) এর অনুরূপ ছিলেন হযরত ইউসুফ ইবনে হুসায়েন রায়ী (র)।

ঐ এলাকার গােত্রাধিপতির এক কন্যার রূপের খ্যাতিও মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায় বহু তরুণ তার পানি আগ্রহী ঘটনাক্রমে তাঁর মনে বুনে ছিল প্রণয়ের বীজাঙ্কর। রূপতৃষ্ণা প্রেম-পিপসায় পরিণত হলাে। আর সে পিপাসা এত তীব্র হয়ে উঠল যে, তিনি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। এক গভীর রাত্রে অভিসারিকা হয়ে চলে এলেন হযরত ইউসুফ ইবনে হুসায়েন রায়ী (র)-এর।

কিন্তু কী আশ্চর্য, বহু তরুণ-হৃদয়ে যে অনন্তযৌবনা রূপসী তুফান তুলেছিলেন, তিনি এই প্রবাসী তরুণ-হৃদয়ে সামান্য একটি তরঙ্গও সৃষ্টি করতে পারলেন না। তার অভিসার তাঁকে লজ্জিত করল। তরুণ একবার চোখ তুলেও তাঁর দিকে তাকালেন না। বরং, আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে বুক কেঁপে উঠল তার। বেগম যুলায়খার আকর্ষণ উপেক্ষা করে হযরত ইউসুফ (আ) যেমন দৌড়ে গিয়েছিলেন দরজার দিকে, তেমনি তিনিও রূপসী তরুণীর প্রেম নিবেদন প্রত্যাখ্যান করে ঐ এলাকা থেকে চলে গেলেন অন্য এক অচেনা অঞ্চলে।

সেদিন রাতে ঘটনা পরিস্থিতির কথা ভাবতে ভাবতে সে বিমূঢ় তরুণ হাঁটুর ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। স্বপ্নে দেখলেন, তিনি চমৎকার একটি জায়গায় উপস্থিত হয়েছেন। অসাধারণ তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। আরও দেখলেন, সবুজ রঙের পােশাক পরিহিত একদল লােক। আবার তাঁদের ও মধ্যে রয়েছেন আশ্চর্য সুন্দর মানুষ। আভিজাতিক অস্তিত্ব নিয়ে বসে রয়েছেন এক অমূল্য আসনে।

পুলক-চাঞ্চল বিস্ময়ে তিনি ঐ সুপুরুষ ও তার দলবলের পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। একজন উত্তর দিলেন, তারা আল্লাহর ফেরেশতা। আর ভুবন ভােলানাে রূপ নিয়ে যিনি বসে রয়েছেন তিনি হলেন নবী। হযরত ইউসুফ (আ) তিনি আরও বললেন, হযরত ইউসুফ ইবনে হুসায়েন (র)-এর সঙ্গে মােকাবেলা উদ্দেশ্যে তারা সেখানে সমবেত হয়েছেন।

তরুন বড় লজ্জা পেলেন। তার মতাে সামান্য একটি মানুষের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য হযরত ইউসুফ (আ) সদলে সেখানে উপস্থিত। এও কি সম্ভব । বুক ঠেলে কান্না এল তাঁর। তিনি এসব ভাবছেন, হঠাৎ মহিমান্বিত হযরত ইউসুফ (আ) আসন ছেড়ে উঠে এসে তাঁর সঙ্গে আলিঙ্গন করলেন। তারপর তরুণকে নিয়ে গিয়ে তার পাশের আসনে আলিঙ্গন করলেন। তারপর তরুণকে নিয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি বসিয়ে দিলেন। আপনি আমার মতাে অতি তুচ্ছ এক অধমকে এত বেশি সম্মান প্রদশন করছেন কেন, কিছুই বুঝতে পারছি না।

হযরত ইউসুফ (আ) বললেন, রূপমুগ্ধ সে অভিসারিকাকে আপনি প্রশ্রয় দেননি। পাপের ছােবল থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে আপনি দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আল্লাহ পাক স্বয়ং এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে সমস্ত ফেরেশতা ও আমাকে ডেকে বললেন, যুলায়খা যেমন নির্জন কক্ষে আপনাকে পাপপথে আহ্বান করেছিল, আর আপনি ছুটে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছিলেন, তেমনি আপনার নামের আর এক ইউসুফ আরবের এক আমীর-কন্যার প্রেম নিবেদন উপেক্ষা করে আমাকে খুব খুশি করেছে। 

অতএব আপনি ফেরেশতা সহ তাঁর কাছে গিয়ে তাকে আমার প্রিয় সাধকদের অর্ন্তভূক্ত করার সুসংবাদ দান করুন। আর তাকে একথা ও জানিয়ে দিন, সে যেন একালেও শ্রেষ্ঠ তাপস যুননুন মিশরীর দরবারে হাজির হয়ে তার কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে। 

বলাবাহুল্য এমন জান্নাতী স্বপ্ন দর্শনে তরুনের মনে প্রভূত আনন্দের সঞ্চার হয়। আর পরদিন প্রত্যুষেই তিনি হযরত যুননুন মিশরী (র)-এর উদ্দেশ্যে মিশর অভিমুখে যাত্রা করেন। মিশরে গিয়ে এক মসজিদে তিনি তাঁর সঙ্গে দেখা পেলেন বটে। তবে সাহস করে তাঁকে কিছু বলতে পারলেন না। আর এভাবে, সংকোচের শিকার হয়ে পুরাে একটি বছর পার করে দিলেন। পরে একদিন হযরত যুননুন মিশরী (র)-ই তাঁকে তাঁর নামধাম ও আগমন-উদ্দেশ্যেই কথা জিজ্ঞেস করলেন। এবার সাহস এল মনে। তরুণ বলেন, সে ‘রা প্রদেশ থেকে এসেছে। তার কিছু নিবেদন আছে।

কিন্তু না, আবার হতাশা। হযরত যুননুন মিশরী (র) তাঁর কথা শুনে আর কিছু বললেন না। কী তাঁর নিবেদন, জানতে চাইলেন না। ফলে তরুণ তার ইচ্ছার কথা এবারও প্রকাশ করতে পারলেন না। আরও একটি বছর কেটে গেল। তারপর একদিন হযরত যুননুন মিশরী (র)-এর হঠাৎ প্রশ্ন, তুমি কি যেন বলবে বলছিলে? বল, শােনা যাক।

আর যায় কোথা! প্রচুর সাহস নিয়ে তরুণ বললেন, আমি আপনার দরবারে ইসমে আজম শেখার জন্য এসেছি। কিন্তু আবার ও সে শীতলতা। হযরত যুননুন মিশরী (র) আবারও চুপ করে গেলেন। হ্যা-না কিছুই বললেন না। এবং এভাবে আরও এক বছর অতিবাহিত হল।

তারপর হঠাৎ একদিন। হযরত যুননুন মিশরী (র) তরুণের হাতে মুখ-আঁটা কাঠের একটি কৌটে দিয়ে বললেন, নীলনদের ওপারে অমুক জায়গায় একটা লােক আছে। তাকে এটা দিয়ে এস। আর সে যা বলে, তা মনে রেখাে।


কৌটো নিয়ে যেতে যেতে তরুণের মনে হল, এর ভেতরে কী যেন নড়াচড়া করছে। প্রবল কৌতূহল দমন করতে না পেরে তিনি কৌটোর মুখ খুলে যেই দেখতে যাবেন, অমনি ওর ভেতর থেকে ছােট একটা ইদুর লাফ দিয়ে বেরিয়ে গেল। বড় বেকুব বনে গেলেন তরুণ। এবার! খালি কৌটোটা নদীপারের লােকটিকে দিয়ে আসবেন, নাকি ফিরে যাবেন হযরত যুননুন মিশরী (র)-এর কাছে। 

অনেক ভেবে-চিন্তে তিনি লােকটির কাছেই গেলেন। তাঁকে কিছু বলার আগেই তিনিই বললেন, তুমি হযরত যুননুন মিশরী (র)-এর কাছে ইসমে আজম শিখতে এসেছিলেন? তরুণ সঙ্গে সঙ্গে বললাে, জি হুজুর। আপনি ঠিকই ধরেছেন। তিনি বললেন, তিনি হয়তাে তোমাকে একটু অসহিষ্ণু মনে করে ঐ ইদুরটি তােমার হাতে দিয়ে থাকবেন । আর তুমি সামান্য একটা ইঁদুর ধরে রাখতে পারলে না? কী করে সে মহান মহা পবিত্র নামকে অন্তরে ধরে রাখবে?

তরুণ সত্যিই বড় লজ্জিত হয়ে হযরত যুননুন মিশরী (র)-এর কাছে ফিরে এলেন। তিনি সবই জানতেন। তাই বললেন, তােমাকে ইসমে আজম শেখাবার ব্যাপারে পর পর সাতবার আল্লাহর কাছে অনুমতি চেয়েছি। পাইনি। শেষে ইঁদুর দিয়ে তােমাকে পরীক্ষা করার অনুমতি পেলাম। পরীক্ষায় বােঝা গেল, এ-ব্যাপারে তিনি আমাকে অনুমতি দেননি কেন। এখন তুমি দেশে ফিরে যাও। পরে সময়মতাে আবার এস।

মর্মাহত বিষ্ন্ন তরুণ তখন কাতর প্রার্থনা জানালেন, বিদায় বেলায় আমাকে কিছু উপদেশ দিন হুজুর । হযরত যুননুন মিশরী (র) তার এ প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। তাকে তিনটি উপদেশ দিলেন। তিনশ্রেণীর উপদেশ। উত্তম, মধ্যম ও অধম। উপদেশটি হলাে, এলমে কালাম যা তিনি শিখেছেন, সব মন থেকে মুছে ফেলতে হবে। নিজেকে সম্পূর্ণ অজ্ঞ বা মুখ বলে মনে করতে হবে। তাহলে তাঁর মধ্যে যে যবনিকা রয়েছে তা দূর হয়ে যাবে।

মধ্যমে উপদেশ, তিনি তাঁর শিক্ষাগুরুকেও ভুলে যাবেন। কারও কাছে কখনও বলবেন না যে, আমার মুর্শিদ অমুক বা তিনি আমাকে একথা বলেছেন। কেননা, এ ধরণের কথাবার্তার মধ্যেও আত্মগ্যেরব বা অহমিকা প্রচার করা হয়। তরুণ তাঁর ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে বললেন, তিনি প্রথম উপদেশটি পালন করতে পারবেন না। আর দ্বিতীয় উপদেশটি ও তার পক্ষে অনুসরণ করা সম্ভব নয়। 

অবশ্য আল্লাহর ইচ্ছে হলে তৃতীয়টি তিনি অবশ্যই পালন করবেন। হযরত যুননুন মিশরী (র) বললেন, এর মধ্যে ও শর্ত রয়েছে, এ কাজে নিজের বা শ্রোতাদের প্রতাতােষণনীতি চলবে না। কোন পার্থিব উদ্দেশ্যে নিয়ে নয়, কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই ওয়াজ নসীহত করবে। তরুণ তার এ নির্দেশ অবশ্যই মেনে চলবেন, একথা বলে স্বদেশে ফিরে গেলেন।

এদিকে হযরত ইউসুফ ইবনে হুসায়েন (র) দৈববাণী শুনলেন, সে অনুতপ্ত যুবককে খোঁজ করার নির্দেশ পেলেন তিনি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাকে বেহুশ অবস্থার কবরখানায় করার নির্দেশ পেলেন তিনি কাছে বসে পরম যত্নে মাথাটি কোলের ওপর তুলে নিলেন। অনেক্ষণ পরে যুবক চোখ মেলে তাকাল। দেখলাে কোলে মাথা রেখে সে শুয়ে আছে। এমন নিশ্চিত আশ্রয় এ জীবনে এর আগে সে কখনও খুঁজে পায়নি।

নিশাপুরের এক বিস্তশালী বণিক। হাজার টাকায় একবার কিনে আনল এক রূপসী বাঁদী । ঠিক এ সময় বণিকের এক খাতক টাকা শােধ না দেবার অভিপ্রায়ে শহর ছেড়ে চলে গেল। তাকে খোঁজ করা খুবই জরুরী। কিন্তু মুশকিল হলাে বাঁদীকে নিয়ে। এমন রমণীরত্ব তিনি কার কাছে রেখে যাবেন? তেমন আস্থাশীল বিশ্বস্ত মানুষ শহরে কে-ই বা আছে আর! শেষ পর্যন্ত সে সওদাগর আবু ওসমান জাকরীর হেফাজতেই মেয়েটিকে রাখল। আবু ওসমান প্রথম রাজি হননি। 

কিন্তু পরে তার অনুরােপধ অপেক্ষা করতে পারলেন না। নিশ্চিত হয়ে বণিক এবার খাতকের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল। কিছুদিন কেটে গেল। হঠাৎ একদিন আবু ওসমানের নজর পড়ল সুন্দরী বাদীর ওপর। আর সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠল কামনার আগুন। অনন্যোপায় হয়ে অস্থির আবেগে তিনি ছুটে গেলেন তাঁর মুর্শিদ আবু হাফস হাদ্দাদের কাছে। সব কথা খুলে বললেন। 

তিনি তাকে হযরত ইউসুফ ইবনে হুসায়েন রায়ী (র)-এর কাছে যেতে বললেন। আর ওসমান দেরি না কর তাঁর সন্ধানে গেলেন। হযরত ইউসুফ ইবনে হুসায়েন রায়ী (র) বাসভবনের কাছাকাছি গিয়ে লােকজনকে তিনি যখন তাঁর বাড়ির নিশানা জিজ্ঞেস করলেন, তখন এক বাক্যে সবাই বলতে লাগল, সে তাে খুব বাজে একটা লােক। আপনাকে ভদ্রলােক বলেই মনে হচ্ছে। তার কাছে আপনার কী দরকার? আমরা মনে করি, ওরকম বদলােকের সঙ্গে দেখা না করে আপনার বাড়ি যাওয়াই ভালাে।

লােকের কথায় প্রভাবিত হয়ে আবু ওসমান হযরত ইউসুফ ইবনে হুসায়েন রায়ী (র) সঙ্গে দেখা না করেই ফিরে এলেন। আর তার অভিজ্ঞতার কথা খুলে বললেন। মুর্শিদ হাফস হাদ্দাদকে। আবু হাফস খুবই দুঃখিত হয়ে তাকে ভৎসনা করলেন। এবং আরও জোর দিয়ে বললেন, তিনি যেন অতি অবশ্যই হযরত ইউসুফ ইবনে হুসায়েন রায়ী (র)-এর সঙ্গে একবার দেখা করেন।

অগত্যা আবু ওসমান আবার চললেন, ইবনে হুসায়েন রায়ী (র) তার সঙ্গে দেখা করতে। আর প্রতিবেশীদের বাধা, গালমন্দ উপেক্ষা করে হাজির হলেন তার দরজায়। দেখলেন, দশদিক আলাে করে বসে আছেন পূর্বে জ্যোতির্ময় পুরুষ-হযরত ইউসুফ ইবনে হুসায়েন রায়ী (র) আর তাঁর সমেন দাঁড়িয়ে আছে আশ্চর্য সুন্দর এক কিশাের। 

আর কাছেই রয়েছে একটি শরাবের সােরাহী ও পানপাত। আবু ওসমান তাকে সালাম জানালেন। তারপর শুরু হলাে কথাবার্তা। হযরত ইউসুফ ইবনে হুসায়েন রায়ী (র)-এর সুমিষ্ঠ ভাষণে ও বিনয়পূর্ণ আচরণে অভিভূত হলেন আবু ওসমান। পরে বললেন, আপনি আল্লাহর ওলী, মহাজ্ঞানী। একটা কথা জিজ্ঞেস করার বড় ইচ্ছে আমার । কিস্তু সংকোচবােধ করছি।

হযরত ইউসুফ ইবনে হসায়েন রায়ী (র) তাঁকে অভয় দিলেন। নিঃসঙ্কোচে তিনি বলতে পারেন। আবু ওসমান সাহস পেয়ে বললেন, আপনার কাছে দাঁড়িয়ে আছে দাড়িয়ে-গোঁফশূন্য সুশ্রী

বালক। সামনে রয়েছে শরাবের সােরাহী, পানপাত্র। এর রহস্য কী হুজুর? হযরত ইউসুফ ইবনে। হুসায়েন রায়ী (র) বললেন, মানুষ আসল ব্যাপর না জেনে, ভেতরে তলিয়ে না দেখে, শুধু বাইরে থেকে যা দেখে বা শােনে, তাকেই আসল মনে করে অনেক কিছু বলে বা ভাবে। কিন্তু তা সম্পূর্ণ ভুল। এ যে ছেলেটিকে দেখছ, এ আমার নিজের ছেলে। আর ঐ শরাবের সােরাহীও শরাবের নয়, পানির। আর ঐ যে, পানপাত্র, ও দিয়ে আমি পানিই পান করি।

কিন্তু হুজুর, আবু ওসমান খুব সহজ আর হালকা বােধ করছিলেন। তাই আরও অন্তরঙ্গ হয়ে বললেন, সব সময় তাে ভেতরের ব্যাপার সকলের পক্ষে জানা বা উপলক্ধি করা সম্ভব নয়। বরং মানুষ বাইরে থেকে যা দেখবে বা বুঝবে, তারই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে। তাে আপনি বাইরে দিকটাকে এভাবে উপস্থাপিত করেন কেন?

হযরত ইউসুফ ইবনে হুসায়ন রায়ী (র)-তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এর কারণ জানতে চাও? কারণ হলাে এ যে, এ দৃশ্য দেখে কেউ যেন তাঁর সুন্দরী বাঁদী আমার কাছে আমানত রাখতে না আসে।

হঠাৎ যেন আবু ওসমানের জ্ঞান-চুক্ষ উম্মিলিকত হলেন। তিন বুঝতে পারলেন, প্রকৃত যারা ধর্মভীরু, তাঁর পার্থিব বিষয়াদি থেকে হৃদয় ও দৃষ্টি সরিয়ে নেন। মানুষের দুর্নাম বা অপবাদে তাদের কিছু যায় আসে না। আর এ উপলব্ধি অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে তার মনে যে চাঞ্চল্য ও রূপজ মােহ দেখা দিয়েছিল, তা তিরােহিত হয়ে গেল। নির্মূল হয়ে গেল কামনার বীজহুর। শুদ্ধ স্নাত হয়ে গেলেন তিনি। 

এ মহাতাপস সম্পর্কে শােনা যায়, এশার নামাজের পর থেকে ফজর পর্যন্ত সারা রাত দাড়িয়েই তিনি কাটিয়ে দিতেন। অর্থা, দাণ্ডয়মান অবস্থায় তিনি আল্লাহর ধ্যান করতেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলতেন, এশার নামাজের পর রুকু কিংবা সেজদা দেবার মতো শক্তি থাকে না। তাই দাঁড়িয়ে দাড়িয়েই ইবাদত করি।

বিখ্যাত সাধক হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (র)-কে তিনি একবার এক পত্রে লেখেন, আল্লাহ পাক কখনও আপনাকে যেন প্রবৃত্তির স্বাদ উপভােগ না করান। কেননা, সে স্বাদ উপভােগের সুযােগ এলে, তখন কোন কিছুই আপনাকে দৃষ্টির সম্মুখে প্রতিবাত হবে না।

প্রত্যেক নবীর উম্মতের মধ্যে এক শ্রেণীর ধর্মভীরু লােক থাকেন, যারা প্রকৃতই আল্লাহর বন্ধু। আল্লাহ সর্বতােভাবে তাঁদের রক্ষা করেন। আর লােকচক্ষুর আড়ালে, গােপনে তাদের রেখে দেন। রাসুলে করীমের (সাঃ) উম্মতের মধ্যে সুধী-সাধকগণ হলেন সে শ্রেণীর ধর্মভীরু মানুষ, রাব্বুল আলামীনের একান্ত প্রিয়জন।

হযরত ইউসুফ ইবনে হুসায়েন রায়ী (র) এর অন্মিত প্রার্থনাঃ হযরত ইউসুফ ইবনে হুসায়েন রায়ী (র) যখন বুঝতে পারলেন যে, তাঁর মৃত্যু আসন্ন, তখন তিনি আল্লাহর কাছে এ প্রার্থনা জানান, প্রভু গাে! আমি মানুষকে কথার ও নিজেকে কাজের মাধ্যমে উপদেশ দিয়ে এসেছি। অতএব হে প্রভু, সে উপদেশের বিনিময়ে আমার পাপসমূহ মাফ করুন। 

তার মৃত্যুর পর কোন লােক স্বপ্ন দেখলেন, হযরত ইউসুফ ইবনে হুসায়েন রায়ী (র) শান- শওকতের সঙ্গে বেশ আড়ম্বরপূর্ণ জীবপযাপন করছেন। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনার জীবন তাে বেশ সুখে-শান্তিতে কাটছে। কোনু আমলের ফলে আপনি এমন মহার্ঘ জীবন পেলেন? উত্তরে তিনি জানান, আমি পার্থিব জীবনে কোনদিন সত্য ও মিথ্যাকে মিশিয়ে দিইনি।

হযরত ইউসুফ ইবনে হুসায়েন রায়ী (র) অসাধারণ এক সিদ্ধপুরুষ। সদা-সর্বদা রােজা রাখার অভ্যাস ছিল তাঁর। এক মহাজ্ঞানী-শ্রেষ্ঠ আরিফ। মারেফাতের মাহাত্ম্য প্রচার তাঁর জীবনের ব্রত ছিল। তিনি বহু জ্ঞানী-গুণী ও তাপস-দরবেশের সাহচর্যে আসেন। তাদের সঙ্গে তার ছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্য। 

হযরত যুননুন মিশরী (র)-এর প্রধান খলিফাগণের সঙ্গে ও তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। আল্লাহর অশেষ ইচ্ছায় তিনি সুদীর্ঘকালে জীবিত ছিলেন। এজন্য অন্যান্যদের তুলনায় তিনি অনেক বেশিকাল ধরে আল্লাহর ইবাদতের সুযােগ পান। ইবাদত, রিয়াজাত ও মারেফাতের সাধনায় হযরত ইউসুফ ইবনে হুসায়েন রায়ী (র) সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাধক।

আরও পড়ুন 

* হযরত আবু সাইদ খাযযার (রাঃ) জীবনী

* হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রাঃ) জীবনী

* হযরত আবু সুলায়মান দারায়ী (রাঃ) জীবনী

* হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রাঃ) জীবনী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ