নতুন পোস্ট

6/recent/ticker-posts

হযরত আহমদ কাযরুইয়া বলখী (রাঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

 
হযরত আহমদ কাযরুইয়া বলখী (রাঃ)

হযরত আহমদ কাযরুইয়া বলখী (রাঃ)

হযরত আহমদ কাযরুইয়া বলখী (রাঃ) সেকালের এক স্বনামধন্য সাধক ছিলেন । শুধু সাধক নন, শুধু অলৌকিক শক্তির অধিকারী নন, তিনি সুলেখকও ছিলেন। 

বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করে খ্যতি অর্জন করেন। প্রথম হযরত হাতেমে আসাম (রাঃ)-এর কাছে তিনি মারেফাত বিদ্যালাভ করেন। পরবর্তীকালে দীর্ঘদিন হযরত আবু তুরাব-এর সান্নিধ্যে থেকে কালাতিপাত করেন।

খােরাসানের বলখের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি সাধারণত সব সময়ে সৈনিকদের পােশাক পরতেন। তাঁর বিবাহের ঘটনা বেশ চমকপ্রদ। স্ত্রী ফাতিমা ছিলেন এক বিত্তশালীর কন্যা। 

তিনি স্বয়ং হযরত আহমদ কাযরুইয়া বলখী (রাঃ)-এর কাছে বলে পাঠান, তিনি যেন তাঁর পিতাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। হযরত আহমদ খারুইয়া বলখী (রাঃ) তাঁর এ আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। 

কিন্তু নিরাশ না হয়ে ফাতিমা আবারও তার কাছে এ বলে লােক পাঠান যে, সত্যপথের পথিক হিসেবে মানুষকে সৎপথ দেখানাে আপনার একান্ত কর্তব্য। আর কেউ যদি সুপথে চলার আগ্রহ পােষণ করে থাকে, তবে তাকে বাধা দেয়াও আপনার উচিত নয়। 

হযরত আহমদ আর দিরুক্তি না করে তাঁর আবেদনে সাড়া দেন। তিনি তাঁকে পত্নীত্বে বরণ করেন। অতঃপর পতি-পত্নী উভয়েই সাধনামার্গে চলতে থাকেন।

তাঁর সম্পর্কে বিখ্যাত সাধক হযরত আবু হাফস (রাঃ) বলেন, তাঁর মতাে সত্য সাধক, ন্যায়নিষ্ঠ, সৎ সাহসী ব্যক্তি আর ক্যউকে দেখি নাই। 

তিনি আরও বলেন, আমার মনে হয়, আহমদ খাযরুইয়া বলখী (রাঃ)-এর অনুপস্থিতিতে মানুষ সৎ সাহস ও মনুষ্যত্বের পরিচয়ই লাভ করত না।

তিনি একবার সস্ত্রীক হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (রাঃ)-এর দরবারে যান। তাঁর স্ত্রী এ মহাতাপসের সঙ্গে যখন কথাবার্তা বলেন, তখন তার মুখের ওপর কোন পর্দা ছিল না। 

তাতে হযরত আহমদ কাযরুইয়া বলখী (রাঃ) বড় ক্ষুব্ধ হন। স্বামীর মনােভাব বুঝতে পেরে শ্রদ্ধেয়া ফাতিমা বলেন, আপনি আমার পরম শ্রদ্ধেয় মুরশিদ। আপনার দ্বারা যৌথ কামনা চরিতার্থ করি। 

আর হযরত বাযেজীদ বােস্তামী (রাঃ)-এর কাছে আল্লাহর নৈকট্যের সন্ধান করি। তিনি আমার সঙ্গ চান না। কিন্তু আপনি আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী। এটিই বাস্তব। হযরত আহমদ কাযরুইয়া বলখী (রাঃ) অতঃপর আর কোনদিন এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি। 

ফাতিমাও বায়েজীদ বােস্তামী (রাঃ)-এর সঙ্গে খােলামেলা ভাবে কথা বলেছেন। কিছুদিন পরে তিনি হঠাৎ দেখতে পান, ফাতিমার হাতের তালুতে মেহেদী লাগানাে আছে। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, যতদিন আমার কোন অঙ্গের ওপর

আপনার দৃষ্টি পড়েনি, ততদিন আপনার দরবারে যাতায়াত করা আমার কাছে ছিল আনন্দজনক। কিন্তু আজ যখন তা পড়েছে, তখন এখানে আসা আর সম্ভব নয়। তা আমার জন্য হারাম হয়ে গেল। এ বলে সেখান থেকে তিনি উঠে আসেন। পরে তারা নিশাপুরে চলে যান।

একবার নিশাপুরে এলেন হযরত ইয়াহইয়া ইবনে মা’আত (রাঃ) তাকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ জানানাের জন্য স্বামী-স্ত্রী শালা-পরামর্শ করলেন। ফাতিমার ইচ্ছা, নিমন্ত্রণের আয়ােজন ভালােভাবেই করা হােক। 

ছাগল চাই, মেশক আম্বর, জাফরান চাই, বিশ কুড়ি খেজুর চাই ইত্যাদি। কথাটা হযরত আহমদ কাযরুইয়া বলখী (রাঃ)-এর তেমন বােধগম্য হয় না। 

ফাতিমা বুঝিয়ে বললেন, পরম সম্মানিত অতিথির আগমনে পাড়া প্রতিবেশীদের নিমন্ত্রণ করতে হবে। একটা কুকুরকেও বাদ দেয়া যাবে না হযরত আহমদ কাযরুইয়া বলখী (রাঃ) স্ত্রীর এ প্রস্তাব মেনে নিলেন। 

তার নিদেশমত সবকিছুর আয়ােজন করা হলাে। হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (রাঃ) যথার্থ বলেছেন, যদি তোমাদের কোন নারীবেশী বীরকে দেখার ইচ্ছা হয়, তাহলে হযরত আহমদ কাযরুইয়া বলখী (রাঃ)-এর পত্নী ফাতিমাকে দেখে নাও।

একবার হজ্জে যাবার সময় হযরত আহমদ (রাঃ) পায়ে কাঁটা বিদ্ধ হয়। পাছে নির্ভতার নিষ্ঠা নষ্ট হয়, সেজন্য তিনি সেটি তুলে ফেললেন। কাটাবিদ্ধ পা নিয়ে চলতে গিয়ে তাঁর পা ফুলে উঠল। 

প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে খোড়াতে খোড়াতে তিনি মক্কা শরীফে গিয়ে হজ্জ সমাধা করলেন। ফেরার সময় দেখা গেল ক্ষতস্থান থেকে পুঁজ গড়িয়ে পড়ছে। অবস্থা দেখে সঙ্গীরা কাটাটি তুলে ফেললেন। আর তিনি পৌছলেন হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (রা')-এর দরবারে। 

তখন ও রয়েছে দারুণ ব্যথা। বায়েজীদ বােস্তামী (রাঃ) হালকা হাসি হেসে বললেন, তােমার পায়ে যে কাঁটা যুটেছিল তার কী করলে? হযরত আহমেদ কাযরুইয়া বলখী (রাঃ) বললেন, হুজুর, আমার ইচ্ছা অনিচ্ছা সবকিছু ছেড়ে দিয়েছি আল্লাহর ওপরে। 

এবার রাগে ফেটে পড়লেন হযরত বায়েজীদ বােস্তামী (রাঃ) বললেন, তােমার আবার ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রশ্ন কিসের? এটা শেরেক ছাড়া আর কিছু নয়।

এক রাতে চোর এল হযরত আহমদ কাযরুইয়া বলখী (রাঃ)-এর ঘরে। কিন্তু কিছু না পেয়ে হতাশ হয়ে সে যখন চলে যাচ্ছে, হযরত আহমদ কাযরুইয়া বলখী (রাঃ) বললেন, তুমি কুয়াে থেকে পানি তুলে অযু বানিয়ে আমার সঙ্গে নামাজ আদায় কর। 

সকালে দেখা যাবে কী দিয়ে তােমাকে বিদায় দেয়া যায়। তার কথায় রাজি হয়ে চোরটি সত্যিই তার সঙ্গে সারারাত নামায পড়ল। আর ভােরবেলায় এক ধনী লােক হযরত আহমদ কামরুইয়া বলখী (রাঃ) কে একশাে দীনার নজরানা দিলেন। 

তিনি সেগুলি চোরকেই দিয়ে দিলেন। বললেন, তুমি সারা রাত আমার সঙ্গে নামাজ পড়ে। এগুলি তাঁর পুরস্কার। এবার চোরের মনে ভাবান্তর সৃষ্টি হলাে। যিনি একটি মাত্র রাতের উপাসনার বিনিময়ে এমন অনুগ্রহ করেন, 

সে মহিমময় প্রভুকে ছেড়ে আমি এতদিন কোথায় ছিলাম সে হযরতের পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ে। টাকা নয় দয়া করে আমাকে সৎ পথে পরিচালিত করুন। হযরত আহমদ কাদরুইয়া বলখী (রাঃ) কে নবজীবন দান করলেন।

আর ও একটি মজার ঘটনা। একটি গরিব লােক। সংসার চালাবার জন্য তাঁর কাছে জীবিক নির্বাহের কিছু উপায় প্রার্থনা করে। তিনি তাকে বললেন, বৈধ-অবৈধ টাকা রােজগারের যতগুলি ব্যবসা আছে, 

এক-একটি কাগজের টুকরোয় তার নাম লিখে সেগুলি একটা পাত্রে রাখ। সে তাই করল। তখন তিনি বললেন, এবার যে কোন এক টুকরাে কাগজ তুলে দেখ, তাতে যে ব্যবসার নাম লেখা থাকবে, তুমি তাই করবে।

লটারিতে ডাকাতির নাম লেখা কাগজ খণ্ড উঠে এল। তিনি এবারও জোর দিয়ে বললেন, তুমি তাহলে ডাকাতিই শুরু করে দাও। লােকটি মহা ফাঁপরে পড়ে গেল। ডাকাতি করতে মন সায় দিল না। 

কিন্তু শেষ পর্যন্ত হযরত আহমদ কাযরুইয়া বলখী (রাঃ)-এর কথায় ডাকাতিই করবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। একটি ডাকাত দলের সর্দার এ বলে তাকে দলে নিল যে, সে যখন যা আদেশ করবে, সাথে সাথে তা পালন করতে হবে। 

কিছুদিন পরে এ দলটি চড়াও হলাে এক বাণিহ্য-কাফেলার ওপর। ডাকাত সর্দারের নিদের্শ এল, বড় ব্যবসায়ীর সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তাকে বধ করতে হবে। আর এর ভার পড়ল নবনিযুক্ত লােকটির ওপর । 

সে ভাবতে লাগল অযথা লােকটিকে প্রাণে মেরে কী লাভ! মালপত্র যা ছিল, সবই তাে হস্তগত হয়েছে। ডাকাতরা যে কত নৃশংস, অকারণে এরা যে কত নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়, এসব কথা তার মনে আলােড়ন সৃষ্টি করল। 

আর সে মন বিদ্রোহীও হয়ে উঠল। এদের এ জঘন্য ও মারাত্মক অন্যায়কে কিছুতেই প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত ডাকাত সর্দারকেই সে খুন করার সিদ্ধান্ত নিল। বণিক বধের আদেশ পালিত হয়নি বলে ডাকাত সর্দার এবার লােকটিকে তেড়ে ধরে। 

গালি-গালাজ দেয়। লােকটি বলল, আল্লাহর আদেশ পালন না করে আমি তোমার আদেশ পালন করব, ভেবেছ। বলেই সে অতর্কিতে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার শিরশ্ছেদ করল। অবস্থা দেখে দলের অন্যান্য ডাকাত যে যেদিকে পারল, হতবুদ্ধি হয়ে দৌড়ে পালাল। রেখে গেল যাবতীয় লুটের মাল। 

হৃতসর্বস্ব বণিকরা অদুরে বসে সব দেখছিল। তারা এবার এগিয়ে এসে লােকটিকে ধন্যবাদ জানাল। এবং কৃতজ্ঞতা স্বরূপ অর্ধেক মাল তাকে উপহার দিল। আর অচিরেই সে ধনী হয়ে গেল। এভাবে হযরত আহমদ কাযরুইয়া বলখী (র)-এর নিদের্শ সফল হন।

তিনি একবার গেছেন এক সাধকের সাধানালয়ে। পরনে জীর্ণ বসন। দরবারে যারা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা তাঁর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেন। কিছুক্ষণ পরে ওখানকার কুয়াের পানি তােলার বালতির দড়ি ছিড়ে গেল। 

বালতি পড়ে গেল কুয়াের তলায়। বহু চেষ্টা করেও তা আর উঠানাে গেল না । গােসল ও অযুর জন্য বেশ অসুবিধা দেখা দিল। তখন তিনি সাধককে বললেন, আপনি আল্লাহর দরবারে দোয়া করুন। বালতি উঠে আসবে। না হয়, আমাকে অনুমতি দিন। 

আমিই প্রভুর কাছে মিনতি জানাই। দরবেশ অনুমতি দিলেন। দেখা গেল, তাঁর মােনাজাতের সঙ্গ সঙ্গে পানির নিচ থেকে বালতিটি ভেসে উঠল। আর দরবার শুদ্ধ লােক এ অভাবনীয় ব্যাপার দেখে তাজ্জব বনে গেল। 

এবার তিনি সকলের পরম শ্রদ্ধেয় হয়ে উঠলেন। তিনি দরবেশকে বললেন, তিনি যেন তাঁর শিষ্যদের উপদেশ দেন, মুসাফিরকে তারা যেন কখনও এভাবে অবজ্ঞা না করেন।

হযরত আহমদ কামরুইয়া বলখী (রাঃ) একবার এক স্বপ্নে দেখেন, সব মানুষ গাধা ও গােরুর মত ঘাস খাচ্ছে। তার স্বপ্নের বিবরণ শুনে একজন বলেন, আপনি তখন কোথায় ছিলেন? 

তিনি বললেন, আমিও অবশ্য তাদের সঙ্গে ছিলাম। তবে তফাতটা এ যে, তারা ঘাস খাচ্ছিল, হাসছিল আর আনন্দ করছিল। নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে তাদের কোন অনুভূতি ছিল না। আর আমি রুটি খাচ্ছিলাম আর হাঁটুতে মাথা গুঁজে নিজের দুরবস্তার কথা ভাবছিলাম।

অভাবগ্রস্ত লােককে দান করতে গিয়েই তিনি ঋণগ্রস্ত হন। মৃত্যুকালে তার ঋণের পরিমাণ ছিল সত্তর হাজার দীনার। তিনি আল্লাহর দরবারে মােনাজাত করেন, প্রভু গাে, আপনি আমাকে দুনিয়া থেকে তুলে নিচ্ছেন, 

কিন্তু ঋণের দায়ে আমার প্রাণ এখানেই বন্দী হয়ে থাকছে। আপনি এমন কাউকে পাঠিয়ে দিন, যিনি শােধ করবেন। তার দোয়া শেষ হতেই একটি লােক দরজায় করাঘাত করে বললেন, যারা পাওনাদার আছেন, তারা বাইরে আসুন। 

তারা বাইরে গেলে আগন্তুক কড়ায়-গণ্ডায় সব টাকা শােধ করে দিলেন। আর, এভাবে সকলের পাওনা পরিশােধ হবার পরই হযরত আহমদ কাযরুইয়া বলখী (রাঃ) -এর পবিত্ৰাত্মা পৃথিবী থেকে বিদায় নিল।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ