নতুন পোস্ট

6/recent/ticker-posts

হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী বাংলা

হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)

 হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) জীবনী 

হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু ছিলেন ইসলামের প্রথম খলিফা এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও নিবেদিতপ্রাণ সহচর। 

হিজরী সাল গণনার পঞ্চাশ বছর ছয় মাস পূর্বে তিনি মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে তিনি আবুল কাব নামে পরিচিত ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর মহানবী সা

ল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নতুন নাম দেন আবদুল্লাহ এবং খেতাব প্রদান করেন আল সিদ্দিক। তিনি বিখ্যাত কুরাইশ বংশের বনি তাঈম গােত্রভুক্ত এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সপ্তম পূর্ব পুরুষের সাথে তার গােত্রের সম্পর্ক ছিল। 

ইসলাম গ্রহণের আগে ও পরে তিনি আরবের সম্মানিত নেতৃবৃন্দের অন্যতম ছিলেন। তার পৈতৃক পেশা ছিল ব্যবসা এবং তিনি নিজেই কখনাে কখনাে ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে সিরিয়া ও ইয়েমেনে যেতেন। 

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তার পূর্ব পরিচয় ছিল। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ওহি নাযিলের সময় হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু ছিলেন ইয়েমেনে। 

মক্কায় ফিরে আসার পর কুরাইশ নেতা আবু জাহল, ওতবা, শােয়াইব প্রমুখ তার সামনেই মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তের ঘােষণা নিয়ে হাসিঠাট্টা করলাে। এতে আবু বকর অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়লেন এবং দ্রুত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহন করলেন। 

তারিখ উল খােলাফা গ্রন্থের রচয়িতা আল্লামা সুয়ুতি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, “যখনই আমি কাউকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি সে ইসলাম কবুলের পূর্বে কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব প্রকাশ করেছে। কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু। 

তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ইসলাম কবুল করেন। প্রবীণদের মধ্যে হযরত আবু বকর, তরুণদের মধ্যে হযরত আলী এবং মহিলাদের মধ্যে হযরত খাদিজা প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন।" 

হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু সম্পদশালী ব্যক্তি ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি তার সমুদয় সম্পদ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পেশ করলেন। এছাড়া অনেক ক্রীতদাস ক্রয় করে তিনি তাদেরকে মুক্তি দেন। 

তাদের মধ্যে হযরত বিল্লাল রাদি আল্লাহু আনহু ও ছিলেন, যাকে ইসলাম গ্রহণের দায়ে অবর্ণনীয় নিপীড়ন করা হয়। নতুন ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার অপরাধে তার মনিবের আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে একদিন সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। 

এ ধরনের তিক্ত ও মারাত্মক বিরােধিতার মুখে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার সঙ্গীরা যে সাহসিকতা ও দৃঢ়তা প্রদর্শন করেছেন তা যুগ যুগ ধরে ইসলামের অনুসারীদের কাছে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। 

ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আসার সময় হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহুর কাছে চল্লিশ হাজার দিরহাম ছিল, হিজরতের সময় তার কাছে ছিল মাত্র পাঁচ হাজার দিরহাম।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পরই হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু ইসলামের প্রথম খলিফা নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পর তাকে শ্রদ্ধা জানাতে আগত জনমন্ডলীর উদ্দেশ্যে তিনি এক স্মরণীয় ভাষণ পেশ করেন। 

তিনি বলেন, প্রিয় ভাইয়েরা, আমি আপনাদের খলিফা নির্বাচিত হয়েছি। যদিও আমার যােগ্যতা আপনাদের চাইতে বেশি নয়। আমি যদি সঠিক পথে চলি তাহলে আমাকে সাহায্য করবেন, আর ভুল করলে আমাকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিবেন। 

সত্য হচ্ছে, একটি আমানত। মিথ্যা হচ্ছে, বিশ্বাসঘাতকতা। আপনাদের মাঝের দুর্বল বাক্তিটিও সবচেয়ে সবল যদি তিনি সত্যের উপর অবিচল থাকেন এবং আপনাদের মাঝের সবল ব্যক্তিটিও আমার মত দুর্বলে পরিণত হবেন যদি তার নিকট হতে যা প্রাপ্য তা আদায় না করি। 

আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ পালন না করলে আমার উপর থেকে আপনাদের আনুগত্য প্রত্যাহার করুন।

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী অপশক্তির বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন অনড় প্রস্তর স্তম্ভের মত। তখন এমন এক আশংকাজনক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছিল যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কঠোর পরিশ্রমে ইসলামের যে কাঠামাে গড়ে উঠেছিল তা বুঝি ভেঙ্গে পড়ে। 

তার অতি প্রিয় সাহাবা আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু বিশৃ্ঙ্খলা  দমনে অবতীর্ণ হয়ে নিজেকে এক শক্তিশালী নেতা হিসেবে প্রমাণ করে রাসূলের প্রদর্শিত পথে অটল রইলেন। 

রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন রােগশয্যায় তখন সাতশত সৈন্যের এক বাহিনীকে উসামা বিন জায়েদের নেতৃত্বে প্রেরণ করার উদ্যোগ নেয়া হয় রােমানদের হাতে মুসলমানদের পরাজয়ের বদলা নিতে। 

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইস্তকালের খবরে সমগ্র আরবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এবং তার ঘনিষ্ট সাহাবারা নতুন খলিফাকে পরামর্শ দেন এই সংকট মুহর্তে মুসলিম বাহিনীকে মদিনার বাইরে কোন অভিযানে প্রেরণ না করতে। 

কিন্তু আবু বকর এ ব্যাপারে তার পূর্ব সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ কিছুতেই পরিবর্তন করা হবে না। 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই উসামা বিন জায়েদকে এই অভিযানের সেনাপতি নিযুক্ত করেছিলেন। নতুন খলিফা তার নিয়ােগকে বহাল রেখে মুজাহিদ বাহিনীকে অভিযানে প্রেরণ করলেন। 

ইসলামী বাহিনী চল্লিশ দিনের মধ্যে তাদের অভিযানে সাফল্য অর্জন করলাে। এই বিজয় ইসলামের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা সম্পর্কে সন্দিহান আরবের বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেললাে। 

হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহুর দূরদৃষ্টি, সময়ােপযােগী ও গতিশীল পদক্ষেপে ইসলামী শক্তির ভিত্তি সুদৃঢ় হয়।

রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকারের পর আরবের বিভিন্ন অংশ থেকে কিছু সংখ্যক ভন্ড নবী মাথাচাড়া দিয়ে উঠলাে। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল বনি আসাদ গােত্রের তালহা, মুসাইলামা এবং ইয়েমেনের এক মহিলা। 

আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহ এগারজন সেনাপতির হাতে এগারটি পতাকা দিয়ে তাদেরকে আরবের বিভিন্ন দিকে প্রেরণ করলেন ভন্ড নবীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। 

এর মধ্যে ভন্ড নবী মুসাইলামার বিরুদ্ধে অভিযানই ছিল সবচেয়ে কঠিন, সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদি আল্লাহু আনহু রক্তক্ষয়ী এক সংঘর্ষের পর দুশমন বাহিনীকে পরাজিত করেন। যুদ্ধে মুসাইলামা নিহত হয়। ইতিহাসবিদ তারাবীর মতে, মুসলমানদেরকে আর কখনাে এতো কঠিন যুদ্ধে লড়তে হয়নি।

হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহ আনহু তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দৃঢ়তার দ্বারা ইসলামের মৌলিক ধ্যান-ধারণাগুলােকে ইতিহাসের এক সংকট সন্ধিক্ষণে সংরক্ষণ করতে সক্ষম হন। 

হিজরী ১১ সনের শেষদিকেই তিনি ধর্মত্যাগী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সকল অভিযানে সাফল্য অর্জন করেন এবং আরব ভূমি থেকে বিদ্রোহী চেতনাকে চিরতরে নির্মূল করেন। 

অভ্যন্তরীণ আন্দোলন হতে মুক্ত হয়ে খলিফা বাইরের বিপদের দিকে দৃষ্টি দিলেন, বিপদ ইসলামের অস্তিত্বকে দুর্বল করে তুলেছিল। 

তখনকার বিশ্বের দু’জন শক্তিধর সম্রাট কায়সার ও কিসরা আরবের নতুন ধর্মবিশ্বাসের মূলে আঘাত হানার সুযােগের সন্ধানে ছিল। পারসিকরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আরবভূমিতে তাদের শাসন চালিয়ে এসেছে। 

কিন্তু যুদ্ধপ্রবণ আরবরা নিজেদেরকে সংগঠিত করে একটি দুর্দান্ত বাহিনীতে পরিণত করবে-পারসিকরা তা কোনভাবেই সহ্য করতে পারছে না। 

সম্রাট কিসরার পক্ষে হুরমুজ ইরাক শাসন করতাে। আরবদের উপর তার নির্যাতন তাদেরকে প্রথমে দাঙ্গা-হাঙ্গামা এবং পরে চূড়ান্ত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য করে। পারসিকরা তাদের অজ্ঞতাবশতঃ মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে গুরুত্ব দেয়নি।

মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব দেন মুসান্না। দুশমনের বিরুদ্ধে তিনি বহু গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করেন। পরে তার সাথে যােগ দেন আল্লাহর তরবারি বলে খ্যাত অজেয় সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদি আল্লাহু আনহু। হুরমুজের চূড়ান্ত যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হয়। 

খলিদ বিন ওয়ালিদ রাদি আল্লাহু হুরমুজকে হত্যা করেন এবং পারসিক বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। যুদ্ধক্ষেত্র হতে এক উট বােঝাই সাত লােহার শিকল সংগৃহীত হয়।


সম্রাট হিরাক্লিয়াসের অধীনে ছিল সিরিয়া ফিলিস্তিন। ইসলামের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় শক্তিশালী দুশমন ইসলামকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য সে ইসলামের শত্রুদের সাথে অব্যাহত ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছিল। 

তার ষড়যন্ত্র তৎপরতার ফলে আরবের অমুসলিম উপজাতিগুলাের মধ্যে কয়েক দফা বিক্ষোভ দেখা দেয়। ইসলামের প্রতি এটা ছিল স্থায়ী উপদ্রব। হিজরী নবম সনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং রােমানদের বিরুদ্ধে একটি অভিযান পরিচালনা করেন। 

হযরত উসামা বিন জাযেদের নেতৃত্বেও রােমানদের বিরুদ্দে আরেকটি অভিযান পরিচালিত হয়। হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু রােমান বাহিনীর মােকাবেলায় তার বাহিনীকে চার ভাগে বিভক্ত করে আবু ওবায়দা, শারজিল বিন হাসানাহ, ইয়াজিদ বিন সুফিয়ান এবং আমর বিন আল আস রাদি আল্লাহু আনহুমের সেনাপতিত্বে ন্যস্ত করে তাদেরকে সিরিয়ার বিভিন্ন অংশে প্রেরণ করেন। 

অনুন্নত অস্ত্রশস্ত্র, স্বল্প সংখ্যক প্রশিক্ষনহীন মুসলিম বাহিনী তাদের চাইতে উন্নত অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিপুল সংখ্যক রােমান মােকাবেলা করবে। খলিফা আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদি আল্লাহু আনহুকে নির্দেশ দিলেন সিরিয়ায় মুসলিম বাহিনীর সাথে যােগ দিতে। 

দুই বাহিনী ইয়ারমুকের সমতলভূমিতে যুদ্ধে লিপ্ত হলাে। রােমান বাহিনীতে সৈন্যসংখ্যা ছিল তিন লক্ষাধিক। এর মধ্যে প্রায় ৮০ হাজার সৈনিক ছিল শৃঙ্খলে আবদ্ধ, যাতে যুদ্ধক্ষেত্র হতে কোন অবস্থায়ই তারা পালাতে না পারে। 

অপরদিকে মুসলিম বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৪৬ হাজার। দুশমনের সংখ্যাদিক্যের মােকাবেলা করতে খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদি আল্লাহু আনহু মুসলিম বাহিনীকে ৪০টি ভাগে বিভক্ত করেন কৌশলগত যুদ্ধে লড়ার জন্য। 

তার কৌশল সফল প্রমাণিত হয় এবং রােমান বাহিনীর ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে এই স্মরণীয় যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। যুদ্ধক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যক মৃতদেহ ফেলে রােমানরা পশ্চাদপসরণ করে। 

মুসলিম বিজয়ের ফলে সিরিয়ায় রােমান শাসনের অবসান ঘটে। ইয়ারমুকের যুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহুর আমলে এবং হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহুর আমলে এ বিজয় সম্পন্ন হয়।

হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সাহাবা ছিলেন। রাসূলুল্লাহ আলইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি এমন কোন লােককে মানি না, যিনি অপরের কল্যাণ সাধনে আবু বকরকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। 

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসুস্থতা যখন গুরুতর তখন তিনি আবু বকরকে নামাজে ইমামতি করার আদেশ দেন।

ইমাম আহমদ, হযরত আলী রাদি আল্লাহু আনহুর বক্তব্য উল্লেখ করেছেন এভাবে, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর মুসলিম উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম মানুষ হচ্ছেন আবুবকর ও ওমর। 

ইতিহাসবিদরা হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহুর বৈশিষ্ট্য, গুণাবলী ও কৃতিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। তিনি ছিলেন ইসলামের সুদৃঢ় স্তম্ভের মত। যিনি এই নতুন আদর্শকে বিশ্বে প্রবল শক্তিতে পরিণত করেন। 

তিনি বিশ্বে ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতাদের অন্যতম, যে বিল্পব মাত্র ত্রিশ বছরের সংক্ষিপ্ত সময়ে মানব ইতিহাসের বিরাট সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন সাধন করে।

তিনি প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকারীদের একজন, যে গণতন্ত্র বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছিল ১৪০০ বছর পূর্বে এবং এরপর আর কখনাে নয়। 

সেই গণতন্ত্রে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি, যিনি ছিলেন তার সময়ে সবচেয়ে ক্ষমতাধর তিনি নিরাপত্তা রক্ষী ছাড়াই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন, সাধারণ খাবার খেতেন এবং 

স্বল্প মূল্যের মােটা বস্ত্র পরিধান করতেন। একজন সাধারণ নাগরিকও যে কোন সময়ে তার কাছে গিয়ে প্রকাশ্যে তার কাজের ব্যাপারে প্রশ্ন করতে পারতেন। 

হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু ও হযরত আলী রাদি আল্লাহু আনহু তাদের বাকপটুতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। 

আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু একদিন খালিদ বিন ওয়ালিদকে উপদেশ দেন, দায়িত্ব থেকে পালাবার চেষ্টা করলে দায়িত্ব তােমাকে অনুসরণ করবে। মৃত্যু কামনা করলে তােমার উপর জীবনের আলাে বর্ষিত হবে।

সেনাবাহিনীর কাছে প্রেরিত তাঁর নির্দেশে সৈন্যদের নৈতিক বিধান স্থির করে দেয়া হয়েছিল, যা ইসলামী সৈনিকদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতাে। 

এই আচরণবিধি যুদ্ধ বিধ্বস্ত ও যুদ্ধে আশংকার মধ্যে পতিত বর্তমান বিশ্বেও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের জন্যে আদর্শ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। সেনাবাহিনীর প্রতি তার নির্দেশ ছিল, তােমার ক্ষমতার অপব্যবহার করাে না, কাউকে বঞ্চিত করাে না। 

তোমার নেতার আদেশ লংঘন করাে না, মানুষের মৃতদেহের উপর অত্যাচার করো না, বৃদ্ধ নারী বা শিশু হত্যা করাে না। ফলের গাছ কর্তন বা অগ্নিসংযােগ করাে না। 

খাদোর প্রযােজন ছাড়া পশু হত্যা করাে না। খ্রিস্টান পাদ্রীদের পীড়ন করাে না এবং তােমার উপর আল্লাহর যে অনুগ্রহ রয়েছে তা বিস্মৃত হয়ো না।

হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহ আনহুর সরলতা, সততা এবং ন্যায়পরায়ণতা ছিল বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। ইসলামের জন্য তিনি সবকিছু কোরবানী দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সমৃদ্ধ ব্যবসায়ী। 

কিন্তু ইসলামের প্রথম খলিফার দায়িত্ব পালনকালে তিনি যখন ইন্তেকাল করেন, তখন ছিলেন একেবারে কপর্দকশূন্য। খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি পৈত্রিক পেশা ত্যাগ করেননি এবং পরবর্তী ছয় মাস পর্যন্ত কাধে কাপড়ের বােঝা নিয়ে যেতেন মদিনার বাজারে। 

যদিও সরকারি কাজের চাপে ব্যক্তিগত ব্যবসা পরিচালনার জন্য তিনি খুব কম সময় পেতেন। সে কারণে তাকে বায়তুল মাল থেকে কিছু ভাতা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছিল এবং 

একজন সাধারণ নাগরিকের জীবন নির্বাহের জন্য ন্যূনতম মাসিক ভাতা তার অনুমােদন করা হয়েছিল। নতুন কাপড়ের প্রয়ােজন হলে তিনি নিজের পুরনাে কাপড় বায়তুল মালে জমা দিতেন।

খলিফার পদ গ্রহণের পূর্বে হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু তার মহল্লায় বকরীর দুধ দোহন করতেন। 

একদিন রাস্তা অতিক্রম করার সময় তিনি এক বালিকার মন্তব্য শুনলেন-লােকটি এখন খলিফা হয়েছে, তাই আমাদের বকরী দোহন করতে আসবে না। তিনি মেয়েটিকে বললেন, হে আমার কন্যা! আমি আগের মতােই বকরীর দুধ হােন করতে আসবাে। 

আমি আশা করি আল্লাহর অনুগ্রহে পদমর্যাদা আমার নিয়মিত কর্মসূচিতে কোন পরিবর্তন আনবে না। শিশুদের প্রতি তিনি ছিলেন স্নেহশীল ও মমতায়ম। 

হযরত ওমর রাদি আল্লাহু আনহু মাঝে-মধ্যে মদিনার এক দরিদ্র মহিলাকে নিত্য প্রয়ােজনীয় জিনিস দিয়ে আসতেন। কিন্তু যখনই সেখানে যেতেন, তিনি শুনতেন, তার আগে কেউ গিয়ে বৃদ্ধাকে প্রয়ােজনীয় সামগ্রী দিয়ে এসেছে। 

একদিন ওমর রাদি আল্লাহু আনহু খুব সকালে বৃদ্ধার বাড়িতে গিয়ে ঘরের এক কোণে নিজেকে লুকিয়ে রাখলেন, কে এই রহস্যজনক ব্যক্তি যে তার আগে এসে বৃদ্ধাকে সাহায্য করে তা দেখার জন্য। তিনি অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করলেন, লােকটি স্বয়ং খলিফা আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু।

বায়তুল মাল হতে হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু সাধারণ জীবনযাপনের জন্য যেটুকু না হলে চলে না শুধু সেটুকুই নিতেন। একদিন তাঁর স্ত্রী তাকে কিছু মিষ্টি আনতে বললেন। কিন্তু সেজন্য তার কাছে অতিরিক্ত কোন অর্থ ছিল না। 

তার স্ত্রী পনের দিনে কিছু কিছু অর্থ সগ্রহ করে হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহুর কাছে দিলেন যা দিয়ে মিষ্টি কেনা সম্ভব। আবু বকর স্ত্রীকে বুঝালেন, এর দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলাে যে, তিনি প্রয়ােজনের অতিরিক্ত বাতা গ্রহণ করছেন। তিনি স্ত্রীর সঞ্চিত অর্থ বায়তুল মালে ফেরত দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য নিজের ভাতা কমিয়ে দিলেন।

গৃহস্থালীর কাজ করতে হযতর আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু পছন্দ করতেন এবং অন্যকে গৃহস্থালীর কাজ করতে দিতেন না। এমনকি তার হাত থেকে উটের লাগামও যদি ফসকে যেত, সেটা তুলে দেয়ার জন্যও তিনি কাউকে বলতেন না। বরং উট থেকে নেমে লাগাম তুলে নিতেন। 

কেউ তার সামনে প্রশংসা করলে তিনি আল্লাহর কাছে বলতেন, তুমি আমাকে আমার চেয়েও ভালােভাবে জানাে এবং এই লােকগুলাের চাইতে আমি নিজেকে বেশী জানি। আমার সেইসব পাপ ক্ষমা করে যেগুলাে তারা জানে না এবং তারা যে আমাকে প্রশংসা করছে সেজন্যে আমাকে অভিযুক্ত করাে না।

হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু তাঁর কন্যা হযরত আয়েশা রাদি আল্লাহু আনহার কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাফন কয় খন্ড কাপড় দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল। 

তিনি উত্তর দিলেন, তিন খন্ড। তারপর আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু তাঁর পরিধানের দুই খন্ড কাপড় ধৌত করে কাফনে ব্যবহার করলেন এবং তৃতীয়টি কেনার জন্য বললেন। 

আয়েশা রাদি আল্লাহু আনহা কাঁদতে কাঁদতে বললেন যে, পিতার কাফনের কাপড় কিনতে পারবেন না, এমন দরিদ্র তাে তিনি নন। খলিফা উত্তর দিলেন, নতুন কাপড় মৃতের চেয়ে জীবিতের জন্যই প্রয়ােজন বেশী ।

হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তিনি ছিলেন বিপুল বিত্তের মালিক। কিন্তু ইসলামকে এগিয়ে নেয়ার জন্য তিনি তার সম্পদের সম্পূর্ণই ব্যয় করেন। 

এছাড়া তার ব্যবসা থেকে উপার্জিত অর্থও ইসলামের সেবায় ব্যয় করেন। যখন তিনি  মৃত্যুবরণ করেন তখন তার কাছে একটি দিনার ছাড়া আর কিছুই ছিল না। 

হযরত আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু দুই বছর তিন মাস এগার দিন ইসলামী খেলাফতের দায়িত্ব পালনের পর তেষট্টি বছর বয়সে ৬৩৪ সারের ২৩শে আগষ্ট ইন্তেকাল করেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা শরীফের পাশেই তাকে দাফন করা হয়।

আরও পড়ুন

 হযরত ওমর ফারুক (রা.) এর জীবনী

*  হযরত আলী রাদি আল্লাহু আনহুর  জীবনী

*  হযরত ওসমান গণি (রাঃ) জীবনী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ