নতুন পোস্ট

6/recent/ticker-posts

হযরত রাবেয়া বসরী (রাঃ) এর জীবনী বাংলা


হযরত রাবেয়া বসরী (র)

হযরত রাবেয়া বসরী (র)-এর পিতার সংসার ছিল খুব অভাবের শুধু অভ্যব আর অভাব। কিন্তু সেখানেও সংসার থেমে থাকে না। সেখানেও জীবন আপন ছন্দে বয়ে যায়। নতুন প্রাণ অঙ্কনিত হয়। আসন্ন প্রসবা এক জননী বুঝতে পারেন, তার জঠর থেকে আরও একটি প্রাণ পৃথিবীর আলাে- বাতাসে অচিরেই মুক্তি পাবে। সময় আসন্ন। আর কিছুক্ষণ পরে হয়তাে একটি নবীন প্রাণ তার অস্তিত্ব ঘােষণা করবে

রাত্রিবেলা। আলাে জ্বালতে হবে। কিন্তু ঘরে এক ফোটা তেল নেই। আলাে জ্বালবে কি করে? তিনি স্বামীকে এক পড়শীর ঘর থেকে খানিকটা তেল ধার করে আনতে বললেন। কিন্তু এর আগে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন, কোন লােকের কাছে ধার করবেন না। কিন্তু আজ? আর স্ত্রীর অবস্থা উপলব্ধি করে, অনিচ্ছা সত্ত্বে ও ঐ প্রতিবেশীর বাড়িতে গেলেন তেল ধার করতে। স্ত্রীর জন্য তিনি প্রতিজ্ঞা ভাঙলেন। কিন্তু কাজ হলাে না। 

ধার দেয়া তাে দূরের কথা, প্রতিবেশী বাড়ির দরজা পর্যন্ত খুলল না। নিরাশ হয়ে তিনি ফিরে এলেন। তারপর একসময় যে চোখ দু'টি পানিতে ভাসছিল, তা বুজে এল তন্দ্রায়। আর তিনি স্বপ্ন দেখলেন, রাসূলুল্লাহ এসে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, কেঁদো না, দুঃখ করাে না। আল্লাহর ইচ্ছায় তুমি এক অসাধারণ কন্যার পিতা হতে চলেছ। ভবিষ্যতে সে এক অন্যতমা মহিয়সী নারী হবে। জান্নাতের অগ্রবর্তিনীদের অন্যতম হবে। তার সুপারিশে আমার সত্তর হাজার পাপী উম্মত মুক্তি পাবে।

স্বপ্নযােগে রাসূলে করীম (স) তাকে বসবার আমীর ঈসার নিকট যেতে বললেন। এক টুকরাে কাগজে কয়েকটি কথা নিখে নিতেও বললেন। কথাগুলি হল-হে আমীর, তুমি প্রতি রাতে শােবার সময় একশাে বার দরূদ শরীফ পাঠ করে থাক, আর জুমআর রাতে পড়াে চারশাে বার। আর যেহেতু গত জুমআয় দরূদ পাঠ করনি, অতএব ক্ষতিপূরণ স্বরূপ চারশাে দিরহাম দান করে দাও।

ঘুম ভেঙে গেল। এ আশ্চর্য স্বপ্ন দেখে তিনি জেগে উঠলেন। আর স্বপ্নের নির্দেশমতাে একখানি কাগজে রাসূলুল্লাহ (স)-এর কথাগুলি লিখে নিলেন। পরদিন ভােরে একটি লােক মারফত সে বাণীলিপি পাঠিয়ে ছিলেন বসরার আমীরের কাছে। লিপি পড়ে বসবার আমীর ঈসা অবাক। মহানবী (স)-এর মূল্যবান উপদেশের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তিনি দশ হাজার দিরহাম দীনদুঃখীদের দান করলেন। 

আর যার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (স)-এর এ অমূল্য বাণী লাভ করেছেন, তার জন্য চারশাে দিনার আলাদা করে রাখলেন। পরে একদিন নিজেই দিনার গুলি নিয়ে গেলেন তার সঙ্গে দেখা করতে। যথাসময়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হল বসরার আমীর ঈসার। দিনারগুলি তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, আপনার যখন যা দরকার হবে, দয়া করে আমাকে জানাবেন। কোন সঙ্কোচ করবেন না। আমি তার ব্যবস্থা করব।

রাসূলুল্লাহর (স)-এর স্বপ্ন প্রদত্ত বাণী বৃথা যায়নি। অভাবপীড়িত, অতি-দরিদ্র মানুষটি সত্যিই এক মহিমান্বিত কন্যা-রত্ন লাভ করলেন। এই কন্যাই রমণীকুলশিরোমণি মহাতাপসী হযরত রাবেয়া বসরী (র)। এক দরিদ্র-জীর্ণ পরিবারে নিম্প্রদীপ কুটিরে আলাে ফুল হয়ে ফুটলেন। তাঁর আলােকপ্রভায়, সুবাসে শুধু সে কুটিরই নয়, তমসাচ্ছন্ন পৃথিবীর যাবতীয় অন্ধকার দূর হয়ে গেল।

হযরত রাবেয়া বসরী (র) ক্রমশ বড় হলেন। কিন্তু সহসা তার পৃথিবী হঠাৎ শূন্যে হয়ে গেল। প্রথমে চির-বিদায় নিলেন রত্নপ্রসবিনী জননী। পরে পিতা। রয়ে গেল চারটি অনাথ বােন।

শুরু হলাে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। মা নেই, বাপ নেই, অথচ ক্ষুধা আছে, তৃষা আছে। আছে জীবন। চার বােনে এর ওর তার বাড়িতে কাজ করতে লাগল । ঝিয়ের কাজ। কখনও খাওয়া জোটে, কখনও জোটে না। একবেলা আধবেলা খেয়ে বা না খেয়ে তাঁদের দিন যায়, রাত যায়। 

তার ওপর বসরায় দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। কে কাকে খেতে দেয়, কে-ই বা কাকে দেখে। বাপ-মা তাদের আদরের সন্তানদেরও বেঁচে খেতে শুরু করে। তখন কে বা কার। তখন নিজের পেট বড় হয়ে দেখা দেয়। আর কারাে কথা মনে আসে না। রাবেয়া বসরী (র)-এর তিন বােন এ দুঃসময়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। তাদের আর হাদিস পাওয়া গেল না। এখন রাবেয়া বসরী (স) একা-বিশাল পৃথিবীতে সম্পূর্ণ একা।

অবশ্য আরও একজন আছেন। তিনি অনন্ত করুণাময় আল্লাহ, মানুষের মহান প্রতিপালক। মানুষের জীবনে তিনি জেগে আছেন সর্বক্ষণ। 

নিঃসঙ্গ অবস্থায় কান্নাকাটি করে কিছুদিন কাটল হযরত রাবেয়া বসরী (র)-এর। পরে একদিন অনাথিনীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেল এক পাষাণ-হৃদয়। আর তাকে বিক্রি করে দিল ততোধিক কঠোর-হৃদয় এক গেরস্থের কাছে। 

হযরত রাবেয়া বসরী (র) এখন ক্রীতদাসী। মনিবের বাড়িতে দিন-রাত কাজ করেন। এতটুকু এদিক-ওদিক হলে কপালে জোটে প্রহার আর নির্যাতন, নিষ্ঠুর গঞ্জনা। এক ফোটা আর নেই কোথাও, নেই ভালােবাসা। শুধু কাজ আর কাজ। আর পীড়ন আর যন্ত্রণা। কিন্তু সহ্যের ও একটা সীমা আছে। আর পারেন না হযরত রাবেয়া বসরী (র) একদিন মনিবের বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেন গােপনে। মুক্তি। অবাধ মুক্তি। মুক্তির নেশায় তিনি দৌড়াতে শুরু করলেন। আর দৌড়াতে গিয়েই আচমকা মুখ থুবড়ে পড়লেন মাটিতে। আর একখানা হাত সম্পূর্ণরূপে ভেঙে গেল। আল্লাহ তাকে কোন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে নিয়ে গেলেন, হয়তাে তখন তিনি তা বুঝলেন না।

হতের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে তিনি হাত ওঠালেন মহান প্রতিপালকের দরবারে আল্লাহ গাে, আমি এক অসহায় দাসী। আমার একখানি হাত গেল, যাক। তার জন্য আমার কোন দুঃখ নেই। কেবল আপনি আমার ওপর প্রসন্ন থাকুন তাহলেই আমি খুশি। প্রভু আমার! আপনি আমার ওপর প্রসন্ন কিনা, দয়া করে আমাকে জানান।

তর এই আপুত প্রার্থনার উত্তর পাওয়া যায়। আকাশ থেকে উত্তর আসে-দুঃখ করাে না, হতাশও হয়াে না। দুঃখ-কষ্টে ভেঙে পড়ে না। মনে রাকবে, রােজ কিয়ামতে তােমার যে মযাদা হবে, তা দেশে ফেরশতারাও ঈর্শা পােষণ করবে। সবাই তোমাকে মর্যাদা দেবে। অভিনন্দন জানাবে।

আকাশবাণী হযরত রাবেয়া বসরী (র)-এর মনে অঢেল শান্তি এনে দেয়। এখন বড় স্বস্তি তাঁর মনে। এ ভাঙা হ্যত নিয়ে তিনি আর কোথায় যাবেন | মালিক নিষ্ঠুর হােক। তবুও তাে মাথা গোজার একটা ঠাই, আছে ওখানে। সাত-পাঁচ ভেবে তিনি আবার মনিবের বাড়িতেই ফিরলেন। এবার নিজের জন্য তিনি একটা নিয়ম করে নিলেন। দিনে কাজ। রাতে উপাসনা। আগে রাতের বেলায় কিছু সময় বিশ্রাম নিতেন। এখন থেকে পুরাে রাত বরাদ্দ হয়ে গেল আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীর জন্য। 

এক গভীর রাত্রে ঘুম ভেঙে যায় মনিবের। তার কানে এল কিছু অস্পষ্ট কথার গুঞ্জন। চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে সে উঠে এল। চারপাশে গভীর অন্ধকার। অথচ সে দেখল হযরত রাবেয়া বসরী (রা)-এর ঘরে এক আশ্চর্য আলাের রােশনাই। দেখল, হযরত রাবেয়া বসরী (রা) তন্ময়চিত্তে অস্কুট উচ্চারণে আল্লাহর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করছেন, প্রভু আমার! আপনি জানেন, আমি সারাক্ষণ আপনার ইবাদতে আত্মনিয়ােগ করতে চাই। কেননা, আপনার স্ব-স্তুতি প্রশংসাই আমার চোখের জ্যোতি। 

আমার যদি সুযােগ ও শক্তি থাকত, তাহলে আপনার ইবাদত ছাড়া এক মুহুর্ত ও আমি অন্য কাজে নষ্ট করতাম না। কিন্তু কী করব প্রভু, আমি পরাধীনা। ইচ্ছা থাকলেও আমি আপনার ইবাদতে সব সময় উপস্থিত হতে পারি না। আপনার উপসনায় আমার অনেক দেরি হয়ে যায় ।

দাসীর এ আকুল প্রার্থনা মনিবের নিষ্ঠুর হৃদয় স্পর্শ করে। তার মনে হয়, এ সাধারণ কোন দাসী বাদী নয়। আল্লাহর প্রকৃত সেবিকা সে। তাকে বন্দিনী অবস্থায় রেখে তার সেবা ও শ্রম গ্রহণ করা ঠিক নয়। বরং এ অশ্রুমতী অপাপবিদ্ধা বালিকার সেবা করা তার কর্তব্য। মনে মনে সে স্থির করে, দাসীকে সে মুক্তি দেবে। ইচ্ছে হলে সে এখানে থাকতে পারে, অথবা অন্য কোথাও যেতে পারে। আল্লাহ তার হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটালেন। পরদিন ভােৱে হযরত রাবেয়া বসরী (র)-কে সে তার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিল।

আল্লাহর প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়লেন হযরত রাবেয়া বসরী (র)। তিনি এখন এক স্বাধীনা রমণী। স্বাধীনভাবে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হলেন। সারা দিন, সারা রাত। অন্তত হাজার রাকাত নফল নামায আদায় শুরু করলেন। মাঝে মাঝে যেতে লাগলেন মহাতাপস হযরত হাসান বরসী (র)-এর আলােচনা সভায়। হযরত হাসান বরসী (র)-ও তার আলােকময়ী শিষ্যাকে খুবই স্নেহের চোখে দেখতে শুরু করলেন। তাপসী হযরত রাবেয়া বসরী (র) ডুবে গেলেন জ্যোতির সমুদ্রে। 

কেউ কেউ বলেন, হযরত রাকেয়া বসরী (র) প্রথম জীবনে ভক্তিগীতি গাইতেন। পরে সব ছেড়ে শুধু ইবাদতে মগ্ন হন। এ উদ্দেশে তিনি কিছুদিন নির্জন বনভূমিতেও বাস করেন। পরে এক নিরিবিলি স্থানে এক উপাসনালয় নির্মাণ করেন সেখানেই ধ্যানরত থাকতেন। অবশ্য শেষ জীবনে তিনি চলে যান পবিত্র মক্কা শরীফে। সেখানেই তার অধ্যাত্ম-জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

এ মহিমান্বিতা মহাতাপসীর আলােকোজ্জল জীবনের বিচিত্র পরিচয় ছড়িয়ে আছে মানুষের মনােলােকে।

হযরত রাবেয়া বসরী (র)-এর জীবনের কয়েকটি ঘটনাঃ ১, এক দুর্বল গাধার পিঠে মালপত্র তুলে দিয়ে তিনি চলছেন চিরবাঞ্জিত মক্কা মােয়াজ্জামায়। রাস্তায় গাধাটি মারা গেল। সঙ্গের লােকেরা তার মালপত্র বয়ে নিয়ে যেতে চাইল। তিনি রাজি হলেন না। অগত্যা, তাকে ছেড়ে সবাই চলে গেল। আর তিনি হাত ওঠালেন আল্লাহর দরবারে । প্রভু গো, আপনি আপনার দাসীকে পবিত্র করার দিকে ডাক দিলেন। অথচ, গাধাটিকে মেরে ফেলে তাকে এমন বিপাকে ফেললেন? কাজটি কি ঠিক হল? আল্লাহ, তাঁর অভিমান-ক্ষুব্ধ হৃদয়ের প্রার্থনার বিচলিত হয়ে মৃত গাধার প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন। তার হজ্জযাত্রায় আর বিঘ্ন ঘটল না।

২. মক্কা শরীফের উপকণ্ঠে নির্জনে তিনি তার প্রভুর কাছে আবেদন জানালেন, তিনি তাঁকে দেখতে চান। আল্লাহ তাকে খবর দিলেন, তুমি কি চাও দুনিয়া ধাংস হােক, আর তার দায়-দায়িত্ব তােমার ওপরে পড়ুক? তুমি কি জানাে না আমাকে দেখতে চেয়ে মুসার কী অবস্থা হয়েছিল? আমি তাকে বার বার বাধা দিয়েছিলাম। সে শােনেনি। ফলে আমার নূরের কণামাত্র প্রকাশ করায়তূর পর্বত জ্বলে উঠে শেষ হয়ে গেল।

৩. হযরত রাবেয়া বসরী (র) দ্বিতীয়বার যখন হজ্জযাত্রায় যান, তখন কাবার অদূরে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হন। হঠাৎ তিনি দেখেন, খােদা কাবা তাকে স্বাগত জানাবার জন্য এগিয়ে আসছে। তখন তিনি বলেন, এ ঘর নিয়ে আমি কী করব? আমি ঘরের মালিককে চাই। কেননা, ঘরের মালিক নিজেই বলেছেন, যে আমার দিকে আধ হাত এগিয়ে আসে, আমি তার দিকে এক হাত এগিয়ে যাই। অতএব কেবল কাবা নিয়ে আমি খুশি হতে পারি না।

৪. ঠিক এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অন্য একটি কাহিনী শােনা যায়-যা তাপসী হযরত রাবেয়া বসরী (র)-এর মর্যাদা বহুগুণ বৃদ্ধি করে। মহাসাধক হযরত ইব্রাহীম আদহাম (র) চলেছেন মক্কা শরীফে। এক পা করে যান, আর দু দু রাকায়াত করে নফল নামায পড়েন। আর পায়ে হাঁটার বদলে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে থাকেন। দারুণ কষ্টকর সে হজ্জযাত্রা। মক্কায় পৌঁছাতে তার সময় লেগে গেল চৌদ্দ বছর। 

কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখলেন, কাবা শরীফের জায়গায় কাবা শরীফ নেই, নাকি তার চোখ খারাপ? তাই দেখতে পাচ্ছেন না? তার সংশয়-সন্দেহ-হতাশার উত্তরে একজন ফেরেশতা বললেন, না, চোখের দোষ না। আসলে এক বৃদ্ধাকে স্বাগত জানাবার জন্য কাবাঘর সাময়িকভাবে তার স্থান ত্যাগ করেছে। কে, কে সে? চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন ইব্রাহীম আদহাম (র)

আর তখন লাঠিতে ভর দিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছেন হযরত রাবেয়া বসরী (র) সেই পবিত্র কাবাঘরও ফিরে এসেছে আপন জায়গায় । হযরত ইব্রাহীম আদহাম (র) বললেন, পৃথিবীতে আপনি এক নজির স্থাপন করলেন। হযরত রাবেয়া বসরী (র) বললেন, আপনি তাে পথে নামায পড়তে পড়তে চৌদ্দ বছর লাগিয়ে দিলেন। আর দিব্যি হেসে খেলে এখানে এসে হাজির হয়েছি। নজির স্থাপন করল কে, আমি না আপনি?

আল্লাহর প্রিয়জনদের ও রহস্যময় সংলাপের অর্থ একমাত্র আল্লাহই জানেন। আল্লাহর উদ্দেশে তাপসী হযরত রাবেয়া বসরী (র) এর প্রার্থনা, কোন ত্রুটিবিচ্যুতির কারণে আল্লাহ যদি তাঁর হজ্জ কবুল না করেন, তাহলে সেটি তার পক্ষে চরম বিপদ-স্বরূপ। সে বিপদের পুণ্য অর্জনের সৌভাগ্য যেন তার হয়।

অতঃপর হজ্জ সম্পন্ন করে তিনি বসরায় ফিরে আসেন। পরবর্তী এক বছর গভীর সাধনায় মগ্ন থেকে আবার হজ্জের ইচ্ছা করেন। মনে মনে ঠিক করেন, গতবার কাবা তাঁকে সম্মান জানিয়েছে, এবার তিনি তাকে সম্মান জানাবেন।

৫. পরবর্তী ঘটনা বর্ণনা করেছেন হযরত ফারমাদী (র)। তিনি বলেন, এবার বসরার এক বনাঞ্চল থেকে হামাগুড়ি দিয়ে তিনি হজযাত্রায় বেরিয়ে পড়েন। আর দীর্ঘ সাত বছর কৃচ্ছসাধনার পর আরাফতের ময়দানে পৌঁছান। তখন এক দৈববাণী হয়-তুমি যদি চাও, তবে তোমার কৃচ্ছসাধনার পুরস্কারস্বরূপ আমি এখনই আমার নূরের এক ঝলক দেখাই। 

হযরত রাবেয়া বসরী (র) বলেন, না প্রভু, আমি নূরের তাজাল্লী দেখার যােগ্য নই। আমি দারিদ্র চাই। দারিদ্র আমার ক্রোধ ও দুর্ভিক্ষস্বরূপ, আসমানী স্বর তরঙ্গায়িত হয়, অবশ্য যদি ঐ প্রেমিক ও আমার মধ্যে এক চুলও ব্যবধান না থাকে, তবে সে কথা আলাদা। 

আল্লাহর প্রতি তার কী অবিচল আস্থা ছিল একটি ঘটনার বিবরণ থেকে তা স্পষ্ট হয়। একদিন দুজন দরবেশ এলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। দুজনেই ক্ষুর্ধাত। কিন্তু ঘরে মাত্র দুখানা রুটি। হযরত রাবেয়া বসরী (র) তা-ই এনে দিলেন অতিথিদের সামনে। ঠিক তখনই দরজায় এক ভিক্ষুক। সেও কিছু খেতে চায়। তাপসী হযরত রাবেয়া বসরী (স) রুটি দুখানা তুলে এনে তাকেই দিলেন। 

বলা বাহুল্য, এতে অতিথিরা অসন্তুষ্ট হলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে অন্য বাড়ির এক দাসী এক গােছা রুটিও মাংস এনে রাবেয়া বসরী (র)-কে দিলেন। তিনি গুণে দেখলেন, রুটি রয়েছে। আঠারােখানা। দাসীকে বললেন, তােমার ভুল হয়েছে। উনি অন্য কারাে জন্য রুটি পাঠিয়েছেন, আমার জন্য নয়।

দাসী বললে, না, আমার ভুল হয়নি। এগুলি আপনার জন্যই । কিন্তু হযরত রাবেয়া বসরী (র) তা মানবেন না। রুটি ফিরিয়ে দিলেন। যে গৃহকত্রী রুটি দিয়েছিলেন, তিনি দাসীর মুখে বিবরণ শুনে আরও দুখানি রুটি দিয়ে আবারও তাকে পাঠালেন। এবারে রুটির সংখ্যা বিশ। আর আপত্তি উঠল না। প্রসন্নচিত্তে হযরত রাবেয়া বসরী (র) অতিথিদের আপ্যায়িত করলেন। তাঁর এই আচরণের রহস্য কোথায়? অতিথিরা কৌতুহলী হয়ে উঠলেন।

রহস্য উদঘাটন করে তিনি জানালেন, মাত্র দুখানা রুটিতে দুজন দরবেশের হতাে না। এজন্য তিনি বড় অস্বস্তিতে ছিলেন। হয়তাে আল্লাহ তাঁর অন্তরের অস্বস্তি উপলবিন্ধ করে ঐ ভিক্ষুককে পাঠান। আর তিনি রুটি দুখানা তাকেই দান করেন। একটি দানের বদলে, আল্লাহ্ দশগুণ দেন আল্লাহর এ প্রতিশ্রুতির ওপর অবিচল আস্থা রেখে অতিথি-আপ্যায়ণের পুরাে দায়িত্ব তিনি আল্লাহর ওপরেই ন্যস্ত করেন। 

দাসী যখন প্রথমে আঠারােখানা রুটি এনে দিল, তখন তিনি বুঝলেন এ তাঁর জন্য নয়। কেননা, তিনি যখন দুখানা রুটি দিয়েছেন, তখন তিনি পাবেন তার দশগুণ, অর্থাৎ দশ দুগুণে কুড়িখানা। তাই তখন তিনি রুটি ফেরত দেন। দ্বিতীয় দফায় অবশ্য বিশখানা রুটিই এল। আর তিনি তা গ্রহণ করলেন নিশ্চিন্তে।

বিষয়-বিমূঢ় দরবেশ-অতিথিরা নির্বাক হয়ে গেলেন। অন্য একদিন

হযরত রাবেয়া বসরী (র) এসেছেন হযরত হাসান বসরী (র)-এর বাড়িতে। তিনি তখন কাঁদছেন; প্রবল কান্না। রাবেয়া বসরী (র) বললেন, এ কান্না যদি অকৃত্রিম হয়, খুব ভালাে কথা। কিন্তু যদি কৃত্রিমতা থাকে, তাহলে কান্নার অতলে আপনি হারিয়ে যাবেন। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

হযরত রাবেয়া বসরী (র)-এর কথায় হযরত হাসান বসরী (র) আহত হলেন। কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলেন।

আরও একদিন-হযরত রাবেয়া বসরী (র) ফোরাত নদীকূলে ধ্যানরতা। হযরত হাসান বসরী (র) গিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। তাপসীর ধ্যান ভাঙলে দুজনের মধ্যে কিছু কথাবার্তা হল। এক সময় হযরত হাসান বসরী (র) নদীর পানির ওপর তার জায়নামায বিছিয়ে বললেন, এসাে, নামায পড়ি। তাপসী হযরত রাবেয়া বসরী (র) বললেন, হযরত! এটা যদি আপনার লােক-দেখানাে হয় তাে খুব ভালাে কথা। আর তা যদি না হয়, তহলে আসুন, আমরা শূন্যে নামায পড়ি। এ বলে তিনি শূন্যে তার জায়নামায পেতে দিলেন।

হযরত হাসান বসরী (র) মনে মনে নিজেকে অতি ক্ষুদ্র মনে করলেন। হযরত রাবেয়া বসরী (র) তার অবস্থা অনুধাবন করে বললেন, আপনি যা দেখালেন, তা এমন কিছু নয়। সামান্য মাছ ও তা পারে। আর আমি যা দেখালাম, তা তুচ্ছ মাছিও পারে। আসল কাজ কিন্তু এর অনেক ওপরে। 

তাঁর সম্পর্কে হযরত হাসান বসরী (র) বলেন, একবার অধ্যাত্নসাধনার নানা জটিল তত্ত্ব নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার অহােরাত্র আলােচনা হয়। কিন্তু মুহুর্তের জন্যে ও আমার যেমন মনে হয়নি যে, আমি একজন পুরুষ, তেমনি তারও মনে হয়নি, সে একজন মহিলা। বিদায় নেবার সময় মনে হল, আমি অতি তুচ্ছ একটি লােক আর সে বিশুদ্ধ এক তাপসী।

তাঁর বিশুদ্ধতা সম্পর্কে হযরত হাসান বসরী (র) এর মনে কোন সংশয় ছিল না। এক রাতে তিনি একদল অনুগামী সহ হযরত রাবেয়া বসরী (র)-এর বাসভবনে যান। তার বাড়িতে আলাের ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু হযরত রাবেয়া বসরী (র) জানতেন, হযরত হাসান বসরী (র)-এর আলাের দরকার। তাই তিনি তার একটি আঙুলে দম দিলেন। আর আঙ্গুলটি উদ্ভাসিত হয়ে আলাে দিতে লাগল। 

হাসান বসরী (র)-এর শিষ্যগণ সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, এটা কি করে সম্ভব হল? তাপসী হযরত রাবেয়া বসরী (র) তার উত্তর দিতে গেলেন। কিন্তু তাঁর আগেই হযরত হাসান বসরী (র) বললেন, যিনি রাসূলুল্লাহ (স)-এর একান্ত অনুগত, তার পক্ষে এসব কাজ কিছুই নয়। আল্লাহর নবীদের দ্বারা যদি মােজেযা প্রকাশ পায়, তাহলে আল্লাহর আউলিয়াদের দ্বারা আলৌকিক কাণ্ড হতে পারে। তাতে অবাক হওয়ার কি আছে।

একবার হযরত রাবেয়া বসরী (র) হযরত হাসান বসরী (র)-এর কাছে তিনটি উপহার পাঠিয়ে সেগুলির প্রতীকী তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন। উপহার তিনটি হল-মােম, সূচ ও একগাছি চুল। তাঁর কথা ছিল, মােমের মতাে আলাে দিয়ে বিগলিত হতে হবে। সূচের মতাে সবসময় মানুষের কাজে লাগতে হবে। আর এসব করতে করতে নিজেকে চুলের চেয়ে ও ক্ষীণতর করে তুলতে হবে। তবেই উদ্দেশ্যে সফল হবে।

হযরত হাসান বসরী (র) প্রশ্ন করলেন: তুমি এত উচ্চ মর্যাদার অধিকারিণী হলে কিভাবে? হযরত রাবেয়া বসরী (র)-এর উত্তর: সবকিছু আল্লাহতে সমর্পন করে দিয়ে। তাঁকে জানলে ও চিনলে কি করে?হযরত রাবেয়া বসরী (র) বললেন, আপনি তাকে চিনেছেন যুক্তি তর্কের মাধ্যমে। কিন্তু আমি তাঁর সন্ধান পেয়েছি বিনা বাক্যব্যয়ে।

হযরত হাসান বসরী (র) তাঁর কাছে মারেফাতের শিক্ষা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কয়েকটি টুপি সেলাই করে আমি বিক্রি করি। আর দুটি মুদ্রা পাই। একটি নিই ডান হাতে, অন্যটি বাম হাতে। দুটিকে একই হাতে ধারণ করি না। তা করলে হয়তাে মুদ্রা সঞ্চয়ের দিকে মনটা ঝুঁকে যেতে পারে। আর তা হতে পারে আমার পথভ্রষ্টতার কারণ। এভাবে আমি আমার প্রবৃত্তির ওপর জয়ী হয়েছি। অর্থাৎ, তিনি সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে মারফাতের শিক্ষালাভ করেন, কোন মানুষের মাধ্যমে নয়।

হযরত রাবেয়া বসরী (রাঃ)-এর প্রার্থনাঃ  হযরত রাবেয়া বসরী (র)-এর প্রার্থনা ছিল খুবই নিগুঢ়, ব্যঞ্জনাধর্মী। যেমন, তিনি বলতেন, প্রভু গাে, বিচারদিবসে আপনি যদি আমকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করেন, তাহলে আমি আপনার এমন এক গােপন রহস্য ফাঁস করব, যাতে জাহান্নাম আমার থেকে হাজার বছরের পথ দূরে পালিয়ে যাবে।

তাঁর প্রার্থনা সরল, কিন্তু সঙ্কেতময়। তিনি বলতেন, প্রভু আমার, এ জগতে আমার জন্য যা রেখেছেন তা আপনার শত্রুদের দিয়ে দিন। আর ঐ জগতে আমার জন্য যা নির্দিষ্ট, তা আপনার মিত্রদের দান করুন। আমি ওসবের প্রত্যাশী নই। আমার জন্য আপনিই যথেষ্ট। জাহান্নামের ভয়ে আমি যদি আপনার উপাসনা করি, তাহলে আপনি আমাকে জাহান্নামে ছুঁড়ে দিন। 

আর জান্নাতের আশায় যদি আপনার ইবাদত করে থাকি, তাহলে আমাকে তা থেকে বঞ্চিত করুন। আর যদি শুধু আপনার উদ্দেশে ইবাদত করে থাকি, তাহলে দয়া করে আমাকে আপনার চিরসন্তুষ্টি দান করুন। আপনার দীদার থেকে আমি যেন বঞ্চিত না হই।

তাঁর প্রার্থনার অতলস্পর্শী আবেদন মানুষের মর্মমূল কাঁপিয়ে দেয়, আপনি যদি জাহান্নামে নিক্ষেপ করেন, তাহলে আমি আর্ত-চিৎকারে বলব, প্রভু গাে, আমি তাে আপনাকে ভালােবাসতাম। তারপরেও কি সে প্রিয় বন্ধু তার বন্ধুর সাথে এরূপ ব্যবহার করে? এ প্রার্থনার উত্তরে তিনি শুনতে পান, তুমি আমার ওপর এমন ভ্রান্ত ধারণা পােষণ করাে না। 

তুমি আমার সে বন্ধুদের অন্তর্ভুক্ত হবে, যারা রােজ কিয়ামতে আমার সঙ্গে কথা বলবে। কি আপ্লুত উচ্চারণ তার; প্রভু গাে, এ জগতে আমার একমাত্র ইচ্ছা ও কাজ আপনাকে স্মরণ করা ও স্মরণে রাখা। আর পরকালে আপনার দীদারের প্রত্যাশা। প্রভুর আমার! একমাত্র আপনিই আমার কামনা ও লক্ষ্য। আমার হৃদয়কে আপনি আপনার সংস্পর্শেই রাখুন। আর আমার দুর্বল নামাযকে কবুল করুন।

হযরত রাবেয়া বসরী (র)-এর ইন্তেকাল ঃ 

অবশেষে একদিন তাঁর প্রভুর ডাক এল, আসন্ন হয়ে উঠল জগৎ ও জীবন থেকে বিদায় নেবার পালা। তার অন্তিম শয্যার পাশে ছুটে এলেন কত বিশুদ্ধ হৃদয় মানুষ। হযরত রাবেয়া বসরী (র) তাদের বললেন, আপনারা দয়া করে আল্লাহর দূতগণের জন্য জায়গা করে দিন। তারা আসছেন। তারা কথায় সবাই বাইরে চলে গেলেন। আর ঘরের দরজা বন্ধ করা হল। বাইরে দাঁড়িয়ে তাড়া শুনতে পেলেন; হে পবিত্র আত্মা! তােমার প্রভুর দিকে সানন্দে প্রত্যাবর্তন কর।

কিছুক্ষণের স্তব্ধতা। পরে সবাই যখন তার ঘরে এলেন আবার, তখন দেখা গেল হযরত রাবেয়া বসরী (র) এর প্রাণহীন দেহ পড়ে আছে। শেষ উপাসনা শেষ করে তিনি যেন চিরনিদ্রায় শায়িত। এক নিষ্প্রদীপ আলয়ে, রাত্রির অন্ধকারে তিনি এসেছিলেন। আর আজ মানুষের জন্য এক আলাের ভুবন রচনা করে চলে গেলেন তার মহিমময় প্রভু ও প্রেমাস্পদের কাছে।

আল্লাহর বিধি-বিধানের এতটুকু ব্যত্যয় ঘটেনি তার জীবনে। আল্লাহ, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সংস্পর্শ ছাড়া অন্য কোন ইচ্ছার অনুবর্তী হননি কোনদিন।

মৃত্যুর পর তাঁকে এক শুভ্র-হৃদয় স্বপ্নে দেখেন। তাকে প্রশ্ন করা হয়, কবরে মুনকীর-নকীর আপনাকে কি প্রশ্ন করেন আর আপনিই বা তার কি উত্তর দেন? তিনি বলেন, তাঁরা জিজ্জেস করেন বলুন, আপনার প্রভু কে? আমি বলেছিলাম, দয়া করে আপনারা আল্লাহর কাছে ফিরে গিয়ে আমার এ কথাগুলাে তাঁকে বলুন যে, জগতে এত লােক থাকা সত্ত্বেও আপনি এঅবলা দাসীকে ভুলবেন না। আমি তাে আপনাকে ছাড়া আর কাউকে বন্ধু বলে জানি না, তা সত্ত্বে ও আপনি কিভাবে অন্যকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করছেন, বল তােমার প্রতিপালক কে?

কত আলােকোজ্জ্বল মানুষ তার পবিত্র কবর জিয়ারতে গেছেন। আর উজ্জ্বলতর হয়েছেন আর ও। একদিন তার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে হযরত আসলাম (র) ও হযরত নিজামী তুসী (র) জিজ্ঞেস করেছেন, হে তাপসী রাবেয়া বসরী আপনি তাে গর্ব করতেন, ইহকাল ও পরকাল থেকে মুক্তিলাভ করেছেন। এখন বলুন, আপনি কী অবস্থায় রয়েছেন? উত্তর এল, আমি ইহকালে যা দেখেছি, এবং এখনও যা দেখছি, আপনাদের ভাগ্যেও যেন তাই হয়।

আরও পড়ুন

* হযরত যুননুন মিশরী (রাঃ) জীবনী

* হযরত বিশরে হাফী (রাঃ) জীবনী

* হযরত সুফিয়ান সাওরী (রাঃ) জীবনী

* হযরত ইমাম আবু হানিফা (রাঃ) জীবনী

* ইমাম বোখারী (রাঃ) জীবনী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ