নতুন পোস্ট

6/recent/ticker-posts

বিখ্যাত মনীষী হযরত সাররী সাকতী (রাঃ) এর জীবনী বাংলা

বিখ্যাত মনীষী হযরত সাররী সাকতী (রাঃ)

বিখ্যাত মনীষী হযরত সাররী সাকতী (রাঃ) 

ইতিহাসের অনন্য শহর বাগদাদ। সে বাগদাদের এক বাজারে একদিন আগুন লাগল। পুড়ে ছাই হয়ে গেল আলাে -ঝলমল  পণ্য  বিপনি। শুধু  একটি ফলের দোকানে  কিছু  হলাে না। সম্পূর্ণ  অক্ষত রইল। দোকানের মালিক তখন দোকানে ছিলেন না। 

তবে তিনি ধরে নিয়েছিলেন, তাঁরা দোকানও বাঁচবে না। কিন্তু যখন জানা গেল, তার ফলের দোকানের কোন ক্ষতি হয়নি, তখন তিনি বললেন, যাক, আল্লাহর অনুগ্রহে আমি বেঁচে গিয়েছি।

কিন্তু তার মুখের এ কথাটি সঙ্গে সঙ্গে তার অন্তরায়িত হয়ে গেল । এল, হঠাৎ আলাের ঝলকানির মতাে তাঁর মনের পরিবর্তন। যার অনুগ্রহে তিনি আজ রক্ষা পেয়েছেন, তাঁরই পথে বেরিয়ে পড়লেন দোকানের যাবতীয় ফল-সম্ভার দীন-দুঃখীদের বিলিয়ে দিয়ে। 

এ মহাভাগ্যবান ফল-বিক্রেতা হলেন হযরত সাররী সাকতী (রাঃ)। একজন সিদ্ধকাম সাধক। সাধনার পথে সংযম, কৃচ্ছতা ও সংগ্রামের তিনি যে স্বাক্ষর রেখেছেন, তার কোন তুলনা নেই। এই মহান তাপস একাধারে ছিলেন জ্ঞানের সাগর ও মায়া-মমতার নিত্য প্রবাহমান নির্ঝরিণী।

হযরত সাররী সাকতী (রাঃ) ছিলেন বাগদাদের অধিবাসী। আর প্রখ্যাত সাধক হযরত মা'রূফ কারখী (রাঃ) ছিলেন তাঁর মুরশিদ। হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রাঃ) ছিলেন তার ভাগিনেয়। স্বনামধন্য সাধক হযরত হাবীব রায়ীর (রাঃ) সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তার কাছ থেকেও তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করেন। আরবী সতক' শব্দের অর্থ হলাে মাটিতে পড়া। 

প্রথম জীবনে তিনি মাটিতে পড়া ফল কুড়িয়ে বাজারে বিক্রি করতেন। আর এ থেকে তাঁর নাম হয় সাকতী। আমরা আগেই বলেছি, বাগদাদের বাজারে তার একটি ফলের দোকান ছিল। সামনে একখানি পর্দা টাঙিয়ে দিয়ে দোকানেই তিনি দৈনিক হাজার রাকায়াত নামায পড়তেন। একবার লাগাস পাহাড়ী এলাকা থেকে এক ব্যক্তি এসে দোকানের পর্দা তুলে তাকে সালাম জানিয়ে বলেন, লাগাস এলাকার অমুক পীরজাদা আপনাকে সালাম দিয়েছেন। 

হযরত সাররী সাকতী (রাঃ) জবাব দেন, পাহাড়ী এলাকার লােক হয়ে তিনি কোন বীরত্বের কাজ করেননি। বরং বীরত্বের কাজ হলাে জনবসতি এলাকায় বসবাস করে, মানুষের সঙ্গে সম্পূর্ণ সংশ্রব রেখে অন্তরে আল্লাহকে এমনভাবে জাগরুক রাখা, যেন মুহুর্তের তরে ও তাঁকে ভুলে না যাওয়া হয়।

ব্যবসায়ী হলেও অতিরিক্ত মুনাফা লাভের বিরোধী ছিলেন তিনি। দশ দীনার বিক্রি করে লাভ করতেন মাত্র আধ দীনার। একবার ষাট দীনার দামে বাদাম কিনলেন। আর, তারপরেই বাদামের দাম বেড়ে গেল। এ সময় এক দালাল এসে জানতে চাইল, তিনি তা বাদাম বিক্রি করবেন কিনা। তিনি বাদামের দর জিজ্ঞেস করলেন। 

দালাল জানান, বাদামের দর এখন নব্বই টাকা। বাদামের দাম শুনে হযরত সাররী সাকতী (রাঃ) বললেন, আমার নিয়ম হচ্ছে, প্রতি দশ দীনার আধ দীনার  লাভ করা। দালাল বললাে, কিন্তু বাজারদর অপেক্ষা কম দামেও তাে আমি বাদাম কিনতে পারি না। হযরত সাররী সাকতী (রাঃ) বললেন, তাহলে আমারও কিছু করার নেই। 

আমার নীতি বিসর্জন দিয়ে এত চড়া দামে বাদাম বিক্রি করতে পারি না। অথাৎ বাদাম তাঁর ভাণ্ডরেই রইল, কেনাবেচা হলাে না। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, আপনার সাধনাপথের সূচনা কিরূপ ছিল? হযরত সাররী সাকতী (রাঃ) জবাব দেন, একবার মহান তাপস হাবীব রায়ী (রাঃ) তার দোকানে আসেন। 

তিনি তাঁর হাতে কিছু পণ্যদ্রব্য তুলে দিয়ে অনুরােধ করেন, আপনি এগুলি দরবেশগণের মধ্যে বিলিয়ে দেবেন। হযরত হাবীব রায়ী (রাঃ) বললেন, আল্লাহ তােমার মঙ্গল করুন। আর এ দোয়ার সঙ্গ সঙ্গে তাঁর মন থেকে পার্থিব লােভ-লালসা দূরীভূত হয়।

একদিন দোকানে আসেন মুরশিদ হযরত মা'রূফ কারখী (রাঃ)। তার সঙ্গে ছিল একটি অনাথ বালক। তিনি ছেলেটিকে একখানি কাপড় দিতে বলেন। তিনি তখনই কাপড় দিয়ে দিলেন। আর মুরশিদ দোয়া করলেন, আল্লাহ করুন, দুনিয়া যেন তােমার শত্রু হয়ে যায়। আর দুনিয়াদারীর কর্মব্যস্ততা ও আসক্তি থেকে তিনি তােমাকে মুক্তি দিন। পীরের দোয়ার বরকতে ঐদিন থেকে দুনিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ।

তিনি সমকালের এক শ্রেষ্ঠ সাধক ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রাঃ) বলেন, হযরত সাররী সাকতী (রাঃ) অপেক্ষা বড় সাধক ও উপাসক আর কাউকে দেখিনি। দীর্ঘ আটানব্বই বছরের মধ্যে তিনি কখনও মাটিতে পিঠ লাগাননি। কখনও কখনও দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসতেন এবং এভাবেই কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতেন। অবশ্য মৃত্যুর আগে অসুস্থ অবস্থায় কিছুদিনের জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিলেন।

একরাতে তিনি হযরত ইয়াকুব (আ)-কে স্বপ্নে দেখেন। হযরত সাররী সাকতী (রাঃ) আল্লাহর নবীকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি আল্লাহর সঙ্গে পূর্ণ প্রেম অক্ষুন্ন রেখেও কী করে পুত্র ইউসুফ (আ) কে এতাে ভালােবাসলেন? 

এরূপ প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে এক অদশ্যবাণী শােনা গেল, হে সাররী সাকতী ! আদব রক্ষা করে কথা বলতে হয়। এরপর এক রাতে তিনি পুনরায় হযরত ইউসুফ (আ)-কে স্বপ্নল দেখেন। সে সময় তার অন্তরে এমন এক ভাবের সৃষ্টি হয় যে, বিকট চিকার করে বেইশ হয়ে পড়েন। আর তা তেরাে দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এর পরে চেতনা ফিরে এলে আবার আকাশবাণী শােনেন; হে সাররী সাকতী: স্মরণ রেখে, যে আমার বন্ধুদের প্রতি আশিষ্ট আচরণ করে, তার এমন দশাই হয়। 

একবার তিনি এক আল্লাহপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম জিজ্ঞেস করেন। তিনি উত্তর দেন, হুওয়া (অথাৎ তিনি)। তাকে আবার জিজ্ঞেস করা হলাে, আপনি পানাহার করেন কি? 

এবারেও তিনি একই উত্তর দিলেন, হওয়া (অর্থাৎ তিনি)। এভাবে প্রতি প্রশ্নের জবাবে তিনি যখন হুওয়া বলতে লাগলেন, তখন হযরত সাররী সাকতী (রাঃ) বললেন, হুওয়া বা তিনির মর্ম কি আল্লাহ? একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড জোরে তিনি এমন চিৎকার করে উঠলেন যে, তাতেই তাঁর পবিত্র আত্মা দেহের খাঁচা থেকে বের হয়ে, তার পরম বন্ধু আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌছে গেল। হযরত সাররী সাকতী (রাঃ)। 

একবার হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রাঃ)-কে ভালােবাসার অর্থ জিজ্ঞেস করেন, জুনায়েদ বাগদাদী (রাঃ) বলেন, কেউ কেউ সদৃশ বস্তুর দ্বারা আবার কেউ কেউ সাম্কেতিকতার মাধ্যমে ভালােবাসার অর্থ প্রকাশ করেছেন। জুনায়েদ বাগদাদীর (রাঃ) কথা শােনার পর তিনি নিজের একখানি চামড়া ধরে সজোরে টানতে থাকেন। কিন্তু সে চামড়াকে স্বস্থান থেকে ওঠানাে গেল না। তখন তিনি। 

বললেন, আমি যদি একথা বলি যে, কেবল ভালােবাসার কারণেই আমার চামড়া এভাবে শুকিয়ে গেছে, সম্ভবত তা নির্ভুল হবে না। একথা বলেই তিনি জ্ঞান হারালেন। কিন্তু এ সময় তার পবিত্র চেহারা ঝকককে চাঁদের মতো ঝলমল করে উঠল। 

ভালােবাসা সম্বন্ধে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায়, যখন মানুষ তরবারির আঘাতের যন্ত্রণাও অনুভব করে না। হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রাঃ) বলেন, ঐ দিনটির পূর্বে আমি সত্যিই ভালােবাসার সংজ্ঞা সম্বন্ধে অনভিয় ছিলাম। সেদিন থেকে আল্লাহ আমাকে ভালােবাসার প্রকৃত অর্থ জানিয়ে দিয়েছেন।

যখন তিনি বুঝতে পারতেন, কোন লোক তাঁর কাছে বিদ্যার্জনের উদ্দেশ্যে এসেছে, তখন আল্লাহর দরবারে মােনাজাত করতেন, হে দয়াময়, আপনি তাকে এমন বিদ্যা দান করুন যেন, তাকে আমার মুখাপেক্ষী হতে না হয় এবং এদের দ্বারা আমার উপাসনার বিঘ্ন না ঘটে।

কোন লােক একটানা ত্রিশ বছর উপাসনায় অতিবাহিত করার দুর্ভল সৌভাগ্য লাভ করেন। সেটি কিভাবে লাভ করেন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি একবার হযরত সাররী সাকতী (রাঃ)- এর দরজায় করাঘাত করি।


ভেতর থেকে প্রশ্ন আসে, আপনি কে? আমি জবাব দিই, আপনার এক পরিচিত ব্যক্তি। 
একথা শুনে তিনি দোয়া করেন, হে প্রভু, তুমি তাকে এমন কর, যেন আপনি ছাড়া কারও সঙ্গে তাঁর পরিচয় না থাকে। আর সেদিন থেকেই আমার মর্যাদা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেল । আমি উঠে এসেছি বর্তমান পর্যায়ে।

এক ধর্মসভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন হযরত সাররী সাকতী (রাঃ)। ঐ সময় খলিফার সভাসদ আহমদ ইবনে ইয়াজিদ বহু অনুচরসহ সভার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ধর্মীয় সভা দেখে তিনি তার সাথীদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে সভায় চলে এলেন। হযরত সাররী সাকতী (রাঃ) তখন বলে চলেছেন, আল্লাহর সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে মানুষের চেয়ে দুর্বল কিছু নেই। আবার মানুষের মতাে অবাধ্য জীবও আর নেই। 

হায় রে মানুষ, এমন দুর্বল ও অক্ষম হওয়া সত্ত্বেও সর্বশক্তিমান, আল্লাহর অবাধ্যতা করছ। বক্তার এ বাক্যটি যেন তীরের মতাে ইয়াজিদের বুকে বিদ্ধ হয়। হঠাৎ তিনি কঁদতে শুরু করেন। তারপর অচৈতন্য হয়ে পড়ে যান। চেতনা যখন ফিরে এল, তখন ও কাঁদতে কাঁদতেই তিনি বাড়ি ফিরলেন। সেদিন আর কিছুই খেলেন না। কারও সাথে কথাও বললেন না। 

পরদিন, বিষণ্নচিওে গিয়ে দাঁড়ালেন হযরত সাররী সাকতী (রাঃ) দরবারে। দরবারে তখন আলাপ-আলােচনা চলছিল। তার শেষ হবার পর তিনি সবিনয়ে হযরতকে বললেন, আপনার গতকালের ভাষণে আমার অন্তর বিগলিত। 

আপনি আমার পাথির্ব আনন্দ আর উৎসবকে নিরানন্দ করে দিয়েছেন। এখন আমি নির্জনতা কামনা করছি। এবং মানুষের সংস্পর্শ ত্যাগ করে নিরিবিলি পরিবেশ চাইছি। প্রার্থনা, আপনি আমাকে আল্লাহর পথ ধরিয়ে দিন।

হযরত সাররী সাতকী বলেন, পথ দুরকমের । একটি সাধারণ পথ-শরয়ী। তা হলাে, পাঁচ ওয়াক্ত নমায। পড়বে, রোজা রাখবে, আর্থিক সচ্ছতা থাকলে জাকাত দেবে, হজ্ব আদায় করবে। আর দ্বিতীয় পথ হলাে বাতেনী বা বিশেষ পথ। তা হলাে, দুনিয়ার প্রতি বিমুখ হও। দুনিয়ার কোন আরামের প্রতি দৃষ্টি দেবে না। এমনকি তা তােমার হাতের মুঠোয় এলেও ছুঁড়ে ফেলবে। 

আমহদ ইবনে ইয়েজীদের পাথিব মােহমুক্তি ঘটে সম্পূর্ণরূপে। হযরত সাররী সাকতীর (রাঃ) নির্দেশিত দ্বিতীয় পথ তিনি গ্রহণ করেন। একদিন জমকালাে পােশাক ছুঁরে ফেলে মােটা কম্বল আর চটের পােশাক পরে নির্জন বনে চলে যান। বেশ কিছুদিন কেটে গেল। একদিন আহম্মদ ইবনে ইয়াজীদের বৃদ্ধা জননী বুক চাপড়াতে চাপড়াতে, কাঁদতে কাঁদতে চলে এলেন হযরত সাররী সাকতী (রাঃ)-এর দরবারে। 

আমার একমাত্র সন্তান। আপনার সংস্পর্শে এসে কোথায় যেন বিবাগী হয়ে চলে গেল। আর খবর নেই। বেঁচে আছে কিনা তাও জানি না। দয়া করে তার একটু খোঁজ দিন। হযরত সাররী সাকতী (রাঃ) পুত্র বিরহে বিরহ-কাতর জননীকে প্রচুর প্রবােধ ও সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, আপনার পুত্র সৌভাগ্যক্রমে সত্য ও খাটি পথ অবলম্বন করে পৃথিবীর মােহ ত্যাগ করেছে। 

নিশ্চয় তার কোন বিপদ ঘটেনি। সে যথাসময়ে আমার এখানে আসবে। আমি তখন আপনাকে খবর পাঠাব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

অনেক দিন পর আহমদ ইবনে ইয়াজীদ একদিন সত্যিই হযরত সাররী সাকতী (রাঃ)-এর দরবারে এসে হাজির হলেন। আর প্রতিশ্রুতি মতাে তিনি তার বৃদ্ধা জননীর কাছে খবর দিলেন। আহমদ তখন ভীষণ কৃশ আর দুর্বল-অস্থি কঙ্কালসার হয়ে গেছে। 

তিনি হযরত সাররী সাকী (রাঃ)-কে বললেন, আপনি আমার অলস ঘুম ভাঙিয়ে যেভাবে কৃতার্থ করেছেন, তার কোন বিনিময় দিতে আমি সক্ষম নই। আল্লাহ পাকের দরবারে বলেছি, তিনিই আপনার পুরস্কার প্রদান করুন। দু মহাত্মার মধ্যে কথাবার্তা চলছে। এমন সময় এসে পড়লেন আহমদ জননী। সঙ্গে সন্তানসহ তাঁর স্ত্রী । তাঁরা দেখলেন, একজন জরাজীর্ণ মানুষ। নীরক্ত। 

বিবর্ণ শরীর ঝুঁকে পড়েছে সবে দিকে। পরনে শতচ্ছিন্ন পােশাক। মাথার চুল অবিন্যস্ত। পুত্রের দুর্দশা দেখে জননী আর স্থির থাকতে পারলেন না। তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে বুকে জড়িয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলেন। একপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল তাঁর স্ত্রী ও সন্তান। আর সে কান্না সংক্রামিত হল সারা দরবারে। স্বয়ং হযরত সাররী সাকতী (রাঃ) ও অশ্রু  সংবরণ করতে পারলেন না। 

পুত্রকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য মা যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। কিন্তু ইবনে ইয়াজীদ আর ঘরে ফিরে যেতে চাইলেন না। আহমদের স্ত্রী তাঁর পুত্র সন্তানটিকে স্বামীর সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি ফিরতে না চান, আপত্তি নেই। কিন্তু ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে যান।

ইবনে ইয়াজীদ তখন হযরত সাবরী সাকতী (রাঃ)-কে বললেন, আপনি কেন আমার চলার পথে এ অন্তরায় সৃষ্টি করলেন আপনি এদের খবর না দিলে তাে আমি এমন বিপাকে পড়তাম না। 

আহমদ ইবনে ইয়াজীদের স্ত্রী বললেন, আপনি বর্তমান থাকতে আমাকে বিধবা করেছেন, করুন। কিন্তু এ মাসুন ছেলেটিকে অনাথ করতে চলেছেন, এ কেমন বিচার? দয়া করে তাকে সাথে নিন। না হলে এর বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আর স্থির থাকতে পারব না।

এবার আহমদ বললেন, তাই হবে। আমি একে আমার সঙ্গেই নিয়ে যাচ্ছি। এ বলে তিনি তার পরনের পােশাক খুলে নিয়ে পরিয়ে দিলেন এক টুকরাে পুরু কম্বল। হাতে দিলেন একটি খলে তারপর তাকে নিয়ে দরবার ত্যাগ করলেন। আর এ দৃশ্য দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না আহমদ জননী। কাজ নেই তােমার কলজের টুকরােকে তােমার সঙ্গে দিয়ে-বলে তিনি তাঁর আদরের পৌত্রকে তার পিতার কাছ থেকে কেড়ে নিলেন।

এ ঘটনার কয়েক বছর পর। এশার সময়। একটি লােক এসে হযরত সাররী সাকতী (রাঃ)-কে বললেন, আহমদ খবর পাঠিয়েছেন, তার সময় খুবই সংকীর্ণ। তিনি একবার তাঁর কাছে গেলে দেখলেন, আহমদ শুয়ে আছেন মাটির বিছাানায়। অন্তিম লগ্ন আসন্ন। জিভ আর ঠোট নড়ছে কেবল। নিজের কান পেতে তিনি শুনলেন, অস্পষ্ট স্বরে আহমদ বলছেন, এ প্রকারের উদ্দেশ্যে কর্মীদের কার্য অবশ্য কর্তব্য।

হযরত সাররী সাকতী (রাঃ) আহমদের মাথাটি তুলে নিলেন নিজের কোলের ওপর। তখন আমহদ চোখ খুলে বললেন, হুজুর, একেবারে শেষ মুহুর্তে এসেছেন, আর একটু সময় নেই। একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তার বুকের শেষ স্পন্দনটি শেষবারের মতাে থেমে গেল।

হযরত সাররী সাকতী (রাঃ) নিজেই তার শেষকৃত্যের আয়ােজনে ব্যস্ত হলেন। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল, অসংখ্য দরবেশ আর সাধারণ অসাধারণ মানুষ তার দিকে এগিয়ে আসছেন। তিনি বলেন, আপনারা এমন দল বেঁধে কোথায় চলেছেন? তাঁরা বললেন, হযরত গতকাল আমরা এক অদৃশ্য আওয়াজ শুনলাম, যারা কোন ওলী-আল্লাহর দাফন-কাফনে সামিল হতে চাও, তারা অমুক কবরস্থানে কাল হাজির থেকো। আমরা তাই ঐ দিকেই যাচ্ছি। 

যুবকের উদ্দেশে হযরত সাররী সাকতী (রাঃ) বলতেন, তােমরা যারা যুবক, তারা এখনই আল্লাহর কিছু কাজ করে নাও। বার্ধক্য দেখা দিলে আর কিন্তু সম্ভব হবে না। দুর্বলতা মানুষের কর্মশক্তি নষ্ট করে। হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রাঃ) বলেন, একদিন হযরত সাররী সাকতী (রাঃ) এরূপ উক্তি করেন যে, আমি বাগদাদ শহরে এ জন্য মরতে চাই না যে, 

আমার পাপে বাগদাদের মাটি আমাকে কবুল করবে না। যার ফলে, আমার ওপর যারা ভালাে ধারণা পােষণ করে, তারা ও খারাপ ধারণা করবে। হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রাঃ) বলেন, হযরত সাররী সাকতী (রাঃ) বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি তার পরিচর্যার জন্য হাজির হন। তখন গরম চলছিল। তাই একখানা পাখা নিয়ে তিনি তাকে হাওয়া করতে শুরু করেন। 

কিন্তু হযরত সাররী সাকতী (র) পাখা করতে নিষেধ করে বলেন, বাতাস আগুনের তেজ বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। শেষ মুহুর্তে হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রাঃ) কিছু উপদেশ প্রার্থনা করলে তিনি বলেন, মানুষের সান্নিধ্য বর্জন করে শুধু আল্লাহর ধ্যান-ধারণা নিয়ে থাক। তাঁর এ উপদেশ শুনে হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রাঃ) বলে উঠলেন, একথা যদি আমাকে আগে বলতেন, তাহলে হয়তাে বা আমি সংস্পর্শে আসতাম না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ