নতুন পোস্ট

6/recent/ticker-posts

হযরত যুননুন মিশরী (র) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী বাংলা

 


হযরত যুননুন মিশরী (র)

এক দরবেশ তাঁর অনুচরবর্গসহ এক অরণ্যে গিয়ে পৌছলেন। আর অরণ্যের মধ্যে বিচরণ করতে করতে তারা একটি ধনভাণ্ডার দেখতে পেলেন। রাশি রাশি সােনা আর রূপা স্তুপীকৃত ছিল সেখানে। বিপুল এ ধনরাশি দেখে অনুচরবর্গের আনন্দের সীমা রইল না। তারা ঝাপিয়ে পড়লেন তার ওপর। আর যা কিছু ছিল, সব নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিলেন। 

কিন্তু দরবেশ কী করলেন? ধনাগারের দুয়ারে তিনি একটি কাঠের ফলক দেখতে পান। তাতে লেখা ছিল আল্লাহর পবিত্র নাম। অন্যদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে তিনি ওই কাঠের ফলকখানি গ্রহণ করে পরম ভক্তিভরে বারবার চুমু দিতে লাগলেন।

আর ওই রাতেই তিনি স্বপ্ন দেখলেন। স্বয়ং আল্লাহ্ বলছেন, আপনার অনুগামীরা সােনা-রূপার দিকে আকৃষ্ট হলাে। কিন্তু আপনি ওসব লক্ষ্য না করে আমার নামাঙ্কিত কাঠের ফলককেই মহামূল্যবান মনে করলেন। অতএব আমি খুব খুশি। এর পুরস্কারস্বরূপ আমিও আপনার জ্ঞান বিদ্যার দরজা খুলে দিলাম।

স্বয়ং আল্লাহর আশীর্বাদধন্য এ মহাতাপসের নাম হযরত যুননুন মিশরী (র) মিশরের সাধক তিনি। মারেফাতপন্থীদের শিরােমণি, তৌহিদবাদীদের মধ্যমনি। কিন্তু দুঃখের কথা, মিশরে তাঁর কোন কদর হয়নি। তারা তাঁকে কাফের' বলে চিহ্নিত করেন। তাঁর আচার-ব্যবহারে অনেকই সংশয় পােষণ করত। আর তিনিও তার পরিচয় প্রকাশ করেননি বলে, তাঁর আসল পরিচয়ও তাঁর জীবিতকালে কেউ জানতে পারেননি।

প্রথম জীবনে তিনি এক তরুণ তাপসের নাম শুনে তাকে দেখতে যান। গিয়ে দেখেন, এক দরবেশ গাছের ডালে ঝুলে রয়েছেন। আর নিজের মনে বলছেন, হে দেহ, আল্লাহর আদেম । পালনে তুমি আমাকে সাহায্য কর। না হলে তােমাকে আমৃত্যু উপবাসী রেখে শাস্তি দেব। অর্থাৎ তিনি নিজের শরীরকে শাসন করছেন। তাঁর কথা শুনে হযরত যুননুন মিশরী (র) কেঁদে উঠলেন। তাঁকে কাঁদতে দেখে ঝুলন্ত দরবেশ সাহায্য করে।

হযরত যুননুন মিশরী (র) এবার তাকে সালাম জানিয়ে তার অবস্থার কথা জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, আমার এ দেহ আল্লাহর উপাসনায় সাহায্য করছে না। আমি তাই একে শাস্তি দিচ্ছি। হযরত বললেন, আমি মনে করেছিলাম, আপনি হয়তাে কাউকে হত্যা করেছেন। অথবা অসৎ কোন বড় পাপ করেছেন। দরবেশ বললেন, না, তুমি ঠিক বােঝনি। লােক সংসর্গকেই আমি ঐ ধরনের অপরাধ সদৃশ বলে মনে করি।

মনে হয় আপনি প্রকৃতই সংসারবিরাগী। আমার চেয়েও বড় বিরাগী লােক আছেন। তাকে দেখতে চাও তাে সামানের পাহাড়ের দিকে যাও। তার কথামতাে হযরত যুননুন মিশরী (র) ঐ পাহাড়ে গিয়ে দেখলেন, এক তরুণ একখানা পা বাইরে ফেলে রেখে মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। আর সে পায়ে অসংখ্যা ক্ষত-পােকা কিলবিল করছে। হযরত তাকে সালাম জানিয়ে তাঁর অবস্থা জানতে চাইলেন।

তরুন বললেন, একদিন আমি এ মসজিদে বসেছিলাম। তখন এক রূপসী নারী এ পথ দিয়ে যাচ্ছিল। তার রূপে আকৃষ্ট হয়ে আমি এক পা অগ্রসর হয়ে যাই। তখন কানে আসে দৈববাণী: ত্রিশ বছর আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থেকে তুমি কিনা শয়তানের পথ অবলম্বন করলে! তুমি কি লজ্জাহীন? সঙ্গে সঙ্গে আমার চৈতন্য ফিরে আসে। সে থেকে আমি এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছি। দেখি, আল্লাহ আমার কী ব্যবস্থা করেন। এ বলে তরুণ এবার হযরত যুননুন মিশরী (র)-কে বলেন, এবার বল, তুমি কি জন্য এখানে এসেছ? যদি সত্যিকারের সংসারত্যাগী দরবেশ দেখতে চাও, তাহলে এই পাহাড়ের চূড়ায় চলে যাও।

কিন্তু ঐ পাহাড়-চূড়ায় উঠতে না পেরে হযরত যুননুন মিশরী (র) আবার তরুণ দরবেশের কাছে ফিরে এলেন। তখন তরুণ নিজেই তার পরিচয় দিয়ে বললেন, ঐ পাহাড়ের মাথায় এক কুঁড়েঘরে এক সাধক বহুদিন ধরে ধ্যানমগ্ন ছিলেন একবার এক ব্যক্তি কথা প্রসঙ্গে তাঁকে বললেন, ব্যবসা বাণিজ্য করা ছাড়া লােকের জীবিকা-নির্বাহ করা সম্ভব নয়। 

তাঁর কথা শুনে কেমন যেন জেদ চেপে গেল তাপসের মাথায়। তিনি নিজে রুজি-রােজগারের কোনও চেষ্টা করবেন না। দেখি, আল্লাহ তাঁর রুজির ব্যবস্থা করেন কি না। আর সত্যিই তিনি কয়েকদিন পানাহার করলেন না। আল্লাহ্ অবশ্য করেন কি না। আর সত্যিই তিনি কয়েকদিন পানাহার করলেন না। আল্লাহ অবশ্য মৌমাছিদের আদেশ দিলেন, তারা যেন তাকে নিয়মিত মধু সরবরাহ করে।

তাঁর কথা হযরত যুননুন মিশরী (র)-কে স্পর্শ করে। তার মনে এ প্রতি জন্মায় যে, আল্লাহর পরিপূর্ণ নির্ভরতা থাকলে তিনিই ব্যবস্থা করেন। দরবেশের কাছ থেকে ফেরার পথে তিনি দেখলেন, একটি অন্ধ পাখি গাছের ডাল থেকে মাটিতে পড়ে গেল। তার মনে কৌতুহল জাগল, এই পাখিটি কিভাবে আহার যােগাড় করে দেখা যাক। দেখলেন, পাখিটি ঠোট দিয়ে মাটি খুঁড়ে ফেলল। আর অমনি খাবার ভর্তি একটি সােনার পেয়ালা, আর পানিপূর্ণ একটি রুপাের পাত্র বের হয়ে এল। 

পাখি পানাহার সম্পন্ন করে আবার গাছের শাখায় উঠে গেল। আর পাত্র দুটিও অদৃশ্য হয়ে গেল। এই দৃশ্য দেখে তার আল্লাহ নির্ভরতা আরও বেড়ে গেল। আর তিনি সফলও হলেন। আমরা দেখছি, স্বয়ং আল্লাহ তাঁর ওপর প্রসন্ন হয়ে জ্ঞানের ভাণ্ডার খুলে দেন।

হযরত যুনুন মিশরী (র)-এর কয়েকটি ঘটনাঃ একবার হযরত যুননুন মিশরী (র) এক পাহাড়ের মাথায় প্রচুর কুষ্ঠরােগী দেখতে পেলেন। জানা গেল, এখানে এক কুটিরে এক দরবেশ থাকেন। বছরে মাত্র একবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রােগীদের শরীরে ফুঁ দেন। আর তারা রােগমুক্ত হয়। তিনি আবার চলে যান তাঁর কুঁড়েঘরে। বর্তমানে তাঁর ঘর থেকে বেড়িয়ে আসার সময় হয়েছে। রােগীরা তার অপেক্ষায় রয়েছে।

নির্দিষ্ট দিনে তিনি সত্যিই বেরিয়ে এলেন। শীর্ণ শরীর। আর দুর্বল। চোখ দুটি ঢুকে গেছে। ভেতরে। কিন্তু হযরত যুননুন মিশরী (র) বুঝতে পারলেন তার বহির্গমনের প্রভাবে সমগ্র পর্বত যেন কম্পমান। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তিনি একবার সস্নেহ দৃষ্টি মেলে দিলেন রােগক্লিষ্ট লােকগুলির দিকে। তারপর আকাশের দিকে তাকালেন। 

তারপর তাদের শরীরে ফুঁ দিলেন আর দেখতে দেখতে সব রােগী সম্পূর্ণ ভাল হয়ে গেল। এবার তিনি ঘরে ঢুকলেন। হঠাৎ কাপড়ে পড়ল টান। তিনি হযরত যুননুন মিশরী (র)-কে দেকতে পেলেন। যুননুন মিশরী (র) বললেন, আপনি জাহরী রােগের চিকিৎসা করলেন। এবার আমার বাতেনী রােগের চিকিৎসা করুন হুযুর ।

দরবেশ বললেন, আপনি আমাকে ছেড়ে দিন যুননুন। তাকে ছেড়ে আপনি অন্যের আঁচল চেপে ধরছেন। এটা বিরক্তির সঙ্গে আল্লাহ লক্ষ্য করছেন। সুতরাং তিনি হয়তাে এবার আপনাকে নিজের হাতে না রেখে তারই হাতে সােপর্দ করবেন। একথা বলে তিনি কুটিরে ঢুকে পড়লেন।

একদা হযরত যুননুন মিশরী (র) আকুলভাবে কাঁদতে থাকেন। তার কারণ, তিনি এক রাতে সেজদাবনত অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েন। আর স্বপ্নে দেখেন, আল্লাহ বলছেন, তিনি এই সৃষ্টিজগৎকে দশভাগে ভাগ করেন। তার ন ভাগই দুনিয়ার প্রতি আসক্তি দেখান। মাত্র একভাগ কোন আকর্ষণ অনুভব করল না। এই এক ভাগকে আবার দশভাগ করা হল। 

আর তাদের সামনে রাখা হলাে জান্নাতকে সেখানেও ন'ভাগই জান্নাতের প্রতি আকৃষ্ট হলাে। শুধু একভাগ রইল নির্বিকার। তিনি তখন তাদের সামনে জাহান্নামকে উপস্থাপিত করলেন। কিন্তু তকনও তারা নির্বিকার। সামান্যতম ভয়ও তাদের স্পর্শ করল না। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তােমরা জান্নাতের প্রতি অনুরাগ দেখালেন না। আবার জাহান্নাম থেকেও মুক্তিকামনা করলে না। আসলে তােমরা কী চাও?

তারা বললে, আমরা কী চাই, আপনি তা জানেন প্রভু গাে। আমরা কেবলমাত্র আপনার সন্তুষ্টি চাই। আমাদের অন্য কোনও বাসনা নেই। আমরা শুধু আপনাকেই চাই। এই ক্ষুদ্র দলটির অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন কিনা, হযরত যুননুন মিশারী (র) হয়তাে সেই কথা ভেবেআস্তির আবেগে কান্নাকাটি করতে থাকেন।

একদিন একটি ছেলে এসে নিবেদন করল তার সেবায় সে এক লক্ষ দীনার দান করতে চায়। হযরত যুননুন মিশরী (র) তাকে সবুর করতে বললেন। কেননা, ছেলেটি তখনও নাবালক। তাঁর কথা শুনে ছেলেটি ফিরে গেল। বয়প্রাপ্ত হয়ে সে আবার এসে হযরত যুননুন মিশারী (র)-এর দরবারে তওবা করে ঐ লক্ষ দীনার দান করে। কিছুদিন পরে ছেলেটি আবার তাদের কাছে এসে দেখতে পেল, তারা খুবই অভাবস্ত। অথের প্রয়ােজন। অথচ তারা কপর্দকশূন্য। তখন সে হযরত যুননুন (র)-এর কাছে গিয়ে আফসােস করে বললে, আমার কাছে যদি আরও এক লক্ষ দীনার থাকত, তাহলে আমি তাও তাদের দিয়ে দিতাম।

তার কথা শুনে হযরত যুননুন মিশরী (র) বুঝলেন, ছেলেটি দরবেশ জীবনের গুরুত্ব এখনও অনুধাবন করতে পারেনি। তার মনে মধ্যে এখনও অর্থ-ভাবনা বেশ সক্রিয়, এ বিষয়ে তাকে একটু শিক্ষা দেওয়া উচিত। তিনি তিন দীরহাম মূলেও কিছু জিনিস কিনে আনার জন্য এক আতর বিক্রেতার কাছে পাঠালেন। ছেলেটি যা কিনে আনল, তাকে গঁড়াে করে তিনটি গুলি পাকিয়ে সূচ বিদ্ধ করে আনতে বললেন। সে তাই করল। 

এবার হযরত যুননুন মিশরী (র) গুলি তিনটির ওপর ফুঁ দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি মূল্যবান মণিতে পরিণত হলাে। তিনি সেগুলির দাম যাচাই করবার জন্য তাকে জহুরির কাছে পাঠালেন। কিন্তু সেগুলি বিক্রি করতে বারণ করলেন। নিদের্শমতাে মণিগুলি জহুরিকে দেখালে তারা প্রত্যেকটির জন্য এক লক্ষ দীনার মূল্য ধার্য করল। 

তখন তিনি ছেলেটিকে বললেন, দেখলে তাে, দরবেশগণ অর্থের প্রত্যাশী নন। বরং তারা স্বেচ্ছায় দারিদ্র বরণ করেন। ছেলেটির চৈতন্যোদয় হতে দেরি হলাে না। সে আল্লাহর কাছে তওবা করল। আর তার মন থেকে অর্থের মােহ মুছে গেল চিরদিনের জন্য।


হযরত যুননুন মিশরী (র) বলেছেন, তিনি অসংখ্য লােককে আল্লাহর পথে ডাক দিয়েছেন। কিন্তু সাড়া পেয়েছেন মাত্র একজনের কাছ থেকে। সে এক রাজকুমার। একদিন মসজিদের পাশ দিয়ে সে কোথায় যেন যাচ্ছিল। হযরত যুননুন মিশরী (র) তখন উপস্থিত শ্রোতাদের বলছিলেন, যে দুর্বল সবলের বিরুদ্ধে দ্বন্ধে লিপ্ত হয়, তার চেয়ে নিবাের্ধ আর কে আছে? কথাটা কানে গিয়েছিল রাজপুত্রের। সে এসে কথার মর্ম জানতে চাইল। তিনি বললেন, দেখ, মানুষ কত দুর্বল। আর তার তুলনায় আল্লাহ কত লক্ষ্য কোটি গুণ সবল। তবুও দুর্বল মানুষ মহাশক্তিধর আল্লাহর বিরােধিতা করে। এর চেয়ে নির্বুদ্ধিতার প্রমাণ আর কী আছে?

রাজপুত্রের মুখখানি মলিন হয়ে গেল। একটা কথাও সে বললেন না। নীরবে চরে গেল। পরদিন এসে সে হযরত যুননুন মিশরী (র)-কে জিজ্ঞেস করল, আল্লাহর দীদার লাভের উপায় কি? তিনি বললেন, দুটো উপায় আছে। একটি ছােট, অন্যটি বড়। সে যদি ছােট উপায় অবলম্বন করতে চায়, তাহলে তাকে পাপ কাজ ছেড়ে দিতে হবে। দুনিয়ার কথা ভুলে যেতে হবে। পরিহার করতে হবে প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা। আর যদি সে বড় উপায়টি গ্রহণ করতে রাজি থাকে, তাহলে আল্লাহর ছাড়া তাকে সবকিছু ছাড়তে হবে। বুকটাকে খালি করতে হবে। দুটির মধ্যে অবশ্য বড়টিই উত্তম।

রাজকুমার উত্তম পথটিই বেছে নিল। তখনই খুলে ফেললাে তার মহা মূল্যবান রাজ পােশাক। পরে নিল মােটা একটা কম্বল। আর দরবেশেগণের আসরে বসে আল্লাহর উপাসনায় বিভাের হয়ে গেল। আর পরবর্তীকালে এই ভাগ্যবান রাজার দুলাল সিদ্ধ পুরুষে পরিণত হলাে।

হযরত যুননুন মিশরী (র) বলেন, জড়বস্তুও আল্লাহর ওলিদের কথা মেনে চলে। একদিন তিনি যখন তার ভক্তদের একথা বলেছিলেন, তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন হযরত আবু জাফর আহরার (র)। তার বর্ণনা মতে হযরত যুননুন মিশরী বললেন, আমি যদি এই আসনখানাকে বলি যে, ঘরে চারপাশে একবার ঘুরে এস, তাহলে এটা তাই করবে। 

সত্যিই, তার কথা শেষ হতে না হতেই আসনখানা ঘরের চারদিকে ঘুরে এসে যথাস্থানে স্থির হয়ে যায়। আর এই আলৌকিক কাণ্ড দেখে তরুণ বিস্ময়-বিমূঢ় হয়ে কাঁদতে কাঁদতে প্রাণত্যাগ করে। কথিত আছে, তাঁকে ঐ আসনেই গােসল করে কাফন-দাফন করা হয়।

হযরত যুননুন মিশরী (র)-এর এক শিষ্য কঠোর সাধনায় লিপ্ত হন। তিনি একাধারে চল্লিশ দিন করে চল্লিশবার নির্জন ধ্যানে রত হন। হজও আদায় করেন চল্লিশ বার। তাছাড়া, একটানা চল্লিশ বার সারা রাত ইবাদতে মগ্ন ছিলেন। অথচ তিনি একদিন গুরুর কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, তাঁর সাধনার কোন ফল ফললাে না। আল্লাহ তাঁর দিলেন না। কোন গুপ্ত তাঁর কাছে প্রকাশিত হলাে না। তিনি আরও বললেন, এসব কথা বলে তিনি তাঁর নিজের গুণকীর্তন করছেন, তা নয়। 

বরং তাঁর দনিতা আর কাতরতার কথাই নিবেদন করেছেন মাত্র। আর আল্লাহর নিন্দা করাও তাঁর উদ্দেশ্য নয়। তিনি এখনও কায়মনােবাক্যে আল্লাহর কাছে আত্মনিবেদনে আগ্রহী। তাঁর উপাসনায় তার হৃদয় শিথিল হয়ে আসছে, তা-ও তিনি বলতে চান না। তবে তাঁর আশঙ্কা, হয়তাে দিন ফুরিয়ে আসছে। এই ব্যর্থতার মধ্য দিয়েই যদি জীবন শেষ হয়ে যায়, তাহলে আর কী হবে। সারা জীবন শুধু আশা পােষণ করে কেটে গেল।

শিষ্যের অভিমানী অনুযােগ শুনে হযরত যুননুন মিশরী (র) বললেন, আজ রাতে পেট পুরে খাও-দাও। আর এশার নামাজ আদায় না করে সারা রাত ঘুমাও। তােমার বন্ধু (আল্লাহ) যখন খুশি মনে দেখা দিলেন না, তখন হয়তাে কঠোর রূপেই দেখা দেবেন। মুর্শিদের নির্দেশে তিনি তাই করলেন। এমনকি, এশার নামাজ না পড়েই বিছানায় শুয়ে পড়লেন। কিন্তু স্বস্তি পেলেন না। অতএব নামাজ আদায় করলেন। তারপর আবার বিছানায় গেলেন। 

আর ঐ রাতেই তিনি রাসূলুল্লাহ (স)-কে স্বপ্নে দেখলেন। তিনি বলছেন, তােমরা বন্ধু তােমাকে সালাম জানিয়ে বলেছেন, আমার দরবারে এসে যে ধৈর্যধারণ না করে বিরক্ত হয়, সে কাপুরুষ। আল্লাহর উপাসনায় ধৈর্য অত্যন্ত জরুরি। তাতে বিরক্ত হওয়া চলে না। আল্লাহ আরও বলেছেন, তােমার চল্লিশ বছরের আশা পূর্ণ হবে। 

আল্লাহ তােমাকে তােমার প্রার্থিত বস্তু দান করবেন। তবে ঐ ডাকাত যুননুন মিশরী (র)-কে আমার সালাম জানিয়ে বলবে, সে মিথ্যুক। তাকে আমি শহরের বুকে অপমান করে ছাড়ব। তাহলে সে আর আমার প্রেমিক ও শরণাগত দাসদের সঙ্গে বঞ্চনা ও প্রতারণা করবে না।

হযরত যুননুন মিশরী (র)-এর শিষ্য জেগে উঠে কাঁদতে শুরু করলেন। আর মুরশিদের কাছে গিয়ে স্বপ্নেরও বৃত্তান্ত খুলে বললেন। হযরত যুননুন মিশরী (র) যখন শুনলেন আল্লাহ্ তাঁকে সালাম জানিয়ে মিথ্যুক দরবেশ বলেছেন, তথন তার চোখ বেয়ে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়ল। এখন প্রশ্ন, হযরত যুননুন মিশরী (র)-এর মতাে একজন সিদ্ধপুরুষ এশার নামাজ না পড়ে ঘুমিয়ে পড়ার পরামর্শ দিলেন কেন? এমন অসিদ্ধ সিদ্ধান্ত কি করে হয়?

এর উত্তর-প্রকৃত যিনি মুরশিদ, তিনি মূলত একজন চিকিৎসকের মতাে। চিকিৎসকগণ প্রয়ােজনে বিষকেও ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করেন। হযরত যুননুন (র) যখন বুঝতে পারলেন, ঐ ব্যবস্থা কার্যকর হতে পারে, কেবল তখনই তিনি ঐ রকম বিধান দেন। তিনি অবশ্য এও জানতেন যে, তার শিষ্য নামাজ আদায় না করে পারবেন না। যেমন, আল্লাহ তাঁর নবী হযরত ইব্রাহিম (আ) -কে তাঁর পুত্রকে কুরবান করার নির্দেশ দেন। কিন্তু আল্লাহ জানতেন, পুত্র কুরবানী হবে না। 

ইবাদতের ক্ষেত্রে এমন বহু ঘটনা দেখা যায়-আপাতদৃষ্টিতে যা শরিয়ত বিরােধী বলে মনে হয়। কিন্তু সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, তা সরিয়তসম্মতই বটে। যেমন, হযরত ইব্রাহিম (আ) কে প্রথমে পুত্র কুরবানীর আদেশ দেওয়া হয়ম কিন্তু পরে তা আবার নিষেধ করা হয়। অন্য একটি উদাহরণ-হযরত খিযির (আ) একটি নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করেন। আপাতদৃষ্টিতে তার কোন কারণ ছিল না। কিন্তু তাও স্বয়ং আল্লাহর ইচ্ছায় সম্পন্ন হয়। 

এক আল্লাহপ্রেমী ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর বন্ধু বলে প্রচার করতেন। তার অসুস্থাবস্থায় হযরত যুননুন মিশরী (র) তাঁকে দেখতে গেলেন। কথায় কথায় ঐ ব্যক্তি বললেন, আল্লাহর দেওয়া কষ্টকে যে কষ্ট বলে মনে করে, সে আল্লাহর বন্ধু নয়। হযরত যুননুন মিশরী (র) সুযােগ পেয়ে বললেন, নিজেকে যে আল্লাহর বন্ধু বলে প্রচার করে, সে কখনও আল্লাহর বন্ধু হতে পারে না। এ কথায় লােকটির চৈতন্যেদয় হয়। তওবা করে তিনি বললেন, আজ থেকে আর কোনদিন নিজেকে আল্লাহর বন্ধু বলে প্রচার করব না। 

একবার হযরত যুননুন মিশরী (র) পীড়িত হয়ে পড়লেন। তার সঙ্গে দেখা করতে এসে এক ব্যক্তি বললেন, বন্ধুর দেওয়া অসুখ আরামদায়কই হয়। তিনি বলেন, তুমি যদি তা বুঝতে, তাহলে তাঁর কথা অমন অসৌজন্যমূলকভাবে বলতে পারত না। 

তিনি একবার তার এক বন্ধুকে লেখেন, আমাদের দুজনকে অজ্ঞতার চাদর দিয়ে ঢেকে আল্লাহ আমাদের পার্থিব বিষয় থেকে অদৃশ্য করে রেখেছেন। আমরা শুধু তার ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করব। আর তিনি আমাদের ওপর খুশি থাকবেন। একবার বিদেশ ভ্রমণকালে তিনি দেখেন, এক অগ্নিপূজক বরফে ঢাকা মাঠের ওপর শস্যবীজ বুনছে। 


কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, সারা মাঠ বরফে ঢাকা। পাখিরা শস্যদানা খুঁজে পাচ্ছে না। তারা যাতে খাবার পায়, আর তাদের দোয়ার বরকতে আল্লাহ আমার ওপর দয়া বর্ষণ করেন, সেইজন্য এটা করছি। হযরত যুননুন মিশরী (র) বললেন, আমি এ ধরনের কাজ পছন্দ করি না। সে বললাে, আপনি পছন্দ করুন আর না করুন, এ কাজ আমার জন্য ফলদায়ক। 

এর কিছুদিন পর হজ্জে গিয়ে তিনি দেখলেন, ঐ অগ্নিপূজক ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তির মতাে কাবা শরীক তওয়াফ করছে। হযরত যুননুন মিশরী (রাঃ)-কে দেখে তিনি ফলবান বৃক্ষে পরিণত তাে, আমার সেদিনের ছড়ানাে বীজগুলাে আজ কেমন ফলবান বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। আল্লাহ সেদিন আমার কাজ কবুল করে খুশি হয়ে আমাকে এ পবিত্র কাবার পানে আহ্বান করেছেন। আর আমি তা তওয়াফ করার সৌভাগ্য অর্জন করছি।

তাঁর কথা শুনে হযরত যুননুন শিরী (র)-এর হৃদয় আনন্দে আপ্তুঁ হয়। তিনি তাঁর প্রভুর উদ্দেশে বললেন, প্রভু গাে, একমুঠো শস্যকণা ছড়ানাের পুরস্কার স্বরূপ আপনি চল্লিশ বছরের অগ্নিপুজককে আপনার সন্তুষ্টি ও হেদায়াত নসীব করে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে অদশ্যবাণী শান গেল, আমার ইচ্ছা ও শক্তির কথা জানাতে চেয়াে না। আমি যার প্রতি সন্তুষ্ট হই, তাকে মহাসৌভাগশালী করে দিই। আমার ইচ্ছা ও কাজের ব্যাপারে কারও কিছু বলার নেই। 

হযরত যুননুন মিশরী (র) যখন নামাযের জন্য দাড়াতেন, তখন বলতেন, প্রভু আমার! আপনার পাক দরবারে হাজির হবার জন্য আমি পা পাব কোথায়। আমার পা যে অপবিত্র। আর আমি কোন চোখ নিয়ে আপনার পবিত্র কেবলার দিকে তাকাব। আমার মুখ যে নিস্পাপ নয়। তবুও নানা অযােগ্যতা সত্ত্বেও নিলজ্জের ন্যায় আমি আপনার পবিত্র দরবারে এসে দাঁড়ালাম। 

নামায শেষ করে তিনি আবারও মােনাজাত করতেন, প্রভু গাে, এখন আমার সামনে যেসব বিপদ রয়েছে, আমি সে সব থেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করছি। আর শেষ বিচারের দিনে যেসব বিপদ-আপদ আমাকে ঘিরে ধরবে, সেগুলাে থেকেও আপনার শরণ নিচ্ছি। আপনি নিজগুণ সেদিনের লজ্জাজনক শাস্তি ও বিপদ থেকে আমাকে মুক্তি দেবেন।

হযরত যুননুন মিশরী (র)-এর ইন্তেকালঃ অবশেষে একদিন চিরাচরিত বিধান অনুযায়ী তাঁর জীবনের অন্তিম মুহুর্ত ঘনিয়ে এল। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলাে, আপনার মনের ইচ্ছা কি? তিনি বললেন, ক্ষণিকের জন্য হলেও আমার প্রভুকে জেনে নেওয়া। অতঃপর তিনি একটি প্রেমের গান আবৃত্তি করলেন।

প্রভু গো! আপনার ভয় আমাকে রােগা করেছে। আপনাকে দেখার ইচ্ছা।

আমাকে জীবিত রেখেছে।

আপনার প্রেম-বাসনা আমাকে দুর্বল করেছে।

প্রভু আমার! মূলত আপনিই আপনার

করুণা ও জ্ঞান দ্বারা আমাকে জীবিত রেখেছেন।

এর অল্পদিন পরেই তিনি রােগ-যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পড়েন। এ সময় তাঁর শিয়রে ইপস্থিত ছিলেন ইউসুফ ইবনে হুসাইন নামে এক ব্যক্তি। তিনি কিছু জানতে চাইলে হযরত যুননুন মিশরী (র) শেষবারের মতাে বলেন, এখন আমি আল্লাহর অনুহে আত্মবিস্মুত হয়ে আছি। তুমি আমাকে অন্যাদিকে নেবার চেষ্টা করাে না। এই তার শেষ কথা। এটি বলার পরেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।

শােনা যায়, তাঁর ওফাতের রাতে সত্তরজন আউলিয়া স্বপ্নযােগে দেখেন, রাসূলে করীম (স) এসে বলছেন, আল্লাহর বন্ধু যুননুন মিশরী (র) মহাযাত্রার পথে তাকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত হয়েছি। মৃত্যুর পর দেখা যায়, তার পেশানীতে লেখা আছে-ইনি আল্লাহর বন্ধু। আল্লাহর প্রেমেই মৃত্যুবরণ করলেন। ইনি শাহাদাতপ্রাপ্ত। আল্লাহর তরবারিতে শাহাদাত লাভ করেছেন।

তাঁর পবিত্র লাশ যখন কবর স্থানে দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন প্রচণ্ড রােদের তাপ। শােনা যায়, তখন নাকি অসংখ্য পাখি মাথার ওপর পাখা বিস্তার করে তাঁর মরদেহ ছায়াচ্ছন্ন করে রাখে। 

মরদেহ বহনের পথে এক মুয়াযযিন আযান দিচ্ছিলেন। তিনি যখন বললেন, আশ হাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ", তখন ঐ মৃতদেহ শাহাদাত আঙ্গুল উঠিয়ে আল্লাহর একত্ব ও রাসূলে করীমের (স) রেসালতের সাক্ষ্য প্রদান করেন। তা দেখে সবাই কেঁদে উঠল। বলতে লাগল যে, তিনি মারা যাননি। জীবিত আছেন। 

তরপর লাশ রেখে দেওয়া হলাে মাটির ওপর। বহুক্ষণ অতিক্রান্ত হলাে। কিন্তু জীবনের কোন লক্ষণ দেখা গেল না। আর উধ্বেথিত শাহাদত আঙুলটিকেও বহু চেষ্টা করে নামানাে গেল না। অবশেষে এভাবেই তাঁকে দাফন করা হয়। যারা তাঁর প্রতি বিরূপ ধারণা পােষণ করত, তারা এই দৃশ্য প্রত্যেক্ষ করে খুব লজ্জা অনুভব করল। মিশরের এই মহান সন্তান মানুষের মর্যাদাকে চির-উন্নত করে চলে গেলেন।

আরও পড়ুন

* হযরত বিশরে হাফী (রাঃ) জীবনী

* হযরত রাবেয়া বসরী (রাঃ) জীবনী

* হযরত সুফিয়ান সাওরী (রাঃ) জীবনী

* হযরত ইমাম আবু হানিফা (রাঃ) জীবনী

* ইমাম বোখারী (রাঃ) জীবনী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ