নতুন পোস্ট

6/recent/ticker-posts

বলখের বাদশাহ হযরত ইব্রাহীম ইবনে আদহাম (র) এর জীবনী বাংলা

 

হযরত ইব্রাহীম আদহাম (র) এর জীবনী

হযরত ইব্রাহীম আদহাম (র) প্রতাপশালী বাদশাহ তাঁর দাপটে পৃথিবী কম্পমান। প্রভূত ঐশ্বর্যের অধিকারী তিনি। শান-শওকতে ভরপুর। যখন রাস্তা দিয়ে চলেন, তখন তাঁর অগ্রভাগে চলে স্বর্ণালধারী চল্লিশজন অশ্বারােহী আরও চল্লিশজন দেহরক্ষী।

রাত্রি গভীর। নিস্তব্ধ পৃথিবী। বাদশাহ কিন্তু নিদ্রিত নন। উপাসনায় মগ্ন। হারেমের সুবর্ণ পালঙ্কে, সুকোমল শয্যায় তিনি ধ্যানরত। হঠাৎ কাছে কোথাও কার যেন পদশব্দ শুনলেন তিনি। মনে হল, ছাদের ওপর দিয়ে কে যেন ক্রস্তপায়ে চলে গেল।

কে, কে ও? তিনি জিজ্ঞেস করেন।

উত্তর এল, আমি তােমার এক বন্ধু। আমার একটি উট হারিয়েছে। তাই খুঁজছি।

বন্ধু? উট হারিয়েছে বলে সেটা সে খুঁজতে এসেছে রাজপ্রাসাদের ছাদের ওপর বিরক্ত হয়ে তিনি তাকে মূর্খ বলে ধমক দেন। কিন্তু ও-পক্ষ থেকে জবাব আসে, আমার এ কাজটিকে তুমি মূখামী বলছ। কিন্তু তুমি কি করছ? সােনার পালন্ধে শুয়ে, সুবর্ণ জরির পােশাকে ভূষিত হয়ে আল্লাহর ইবাদত করছ। তােমার কাজটি কি এর চেয়েও বােকামী নয়?

চেতনার ওপর চাবুক এসে পড়ে। শুরু হয়ে যায় এক অভূতপূর্ব আলােড়ন। অনুশােচনায় তিনি দগ্ধ হতে থাকেন। অদৃশ্য বন্ধু রাত্রির ঘন অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল । কেড়ে নিয়ে গেল মহাশক্তির শাহনেশাহর চোখের ঘুম। দারুণ দুশ্চিন্তায় রাত ভাের হয়ে এল।

পরদিন। পাত্রমিত্র পরিবেষ্টিত অবস্থায় রাজদরবারে তিনি উপবিষ্ঠি। এমন সময় মহাতেজস্বীএক পুরুষ দরবারকক্ষে প্রবেশ করলেন। বাদশাহ বললেন, কে আপনি? কি চান? আমি এক মুসাফির। এ মুসাফিরখানায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে চাই। কিন্তু এটা তাে মুসাফিরখানা নয়। আমার বাসভবন। মুসাফির বললেন, এটা আপনার বাসভবন? আপনার আগে এখানে কে বাস করতেন?

আমার পিতা।

তার আগে?

আমার পিতামহ।

তারও আগে?

আমার প্রপিতামহ।

তারা সব কোথায়?

তারা সব চলে গেলেন।

এখানে যখন একজন আসে আর চলে যায়, তখনও আপনি এটিকে মুসাফিরখানা বলবেন না? এ যদি স্থায়ী হত, তাহলে তারা আজ এখানে বাস করতেন। বলে সেই তেজস্বী পুরুষ যেমন এসেছিলেন, তেমনি চলে গেলেন। রাজদরবারে হােজার সময় তাকে তখন কেউ যেমন বাধা দেয়নি, তেমনি বের হবার সময়ও বাধা পেলেন না। দরবার কক্ষ ছেড়ে সদর্পে চলে গেলেন। 

ঝড় উঠেছিল মনের আকাশে। এখন তা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে প্রবল ঝটিকায় পরিণত হল। সিংহাসন থেকে বাদশাহ নেমে এলেন। আর ছুটে গেলেন অচেনা আগন্তকের পেছনে পেছনে। অনেকখানি পথ অতিক্রম করে তিনি তার নাগাল পেলেন। শর্কিত বক্ষে শুধালেন, আপনি কে জনাব? প্রশান্ত-গম্বীর কণ্ঠে উচ্চারণ হল, আমি আল্লাহর দাস খিজির। 

আত্মপরিচয় দান করেই আগন্তক অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযােগ হল না। গভীর অতূপ্তি আর উৎকষ্ঠা-উদ্বেগ নিয়ে শাহানশাহ ফিরে এলেন। আর এ অবস্থা তার সর্বস্ব দখল করল। রুটিনমাফিক দৈনন্দিন কাজ সম্পন্ন করেন ঠিকই, কিন্তু মনের মধ্যে মন থাকে না। অশান্তি আর অস্থিরতা তাঁকে অবিরাম কষ্ট দিতে থাকে।

এ মনােবিকলনের হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য তিনি শিকার করতে বের হলেন বিজন বাতাসে যদি যন্ত্রণা ভেসে যায়। পাখির ডানার ভর করে যদি উড়ে যায় মনের অশা্তি।

শিকারে এসে হঠাৎ তিনি দলছুট হলেন। এখন তিনি বিজন জঙ্গলে একা। সম্পূর্ণ একা । নিবিড় নির্জনে নিঃশব্দ। হঠাৎ এক শব্দ এল কানে: ইব্রাহীম! এখনও সাবধান হও। মৃত্যু আসার আগেই জেগে ওঠ।

একবার নয়। এ শব্দ প্রতিশতি হল বারবার। হঠাৎ চোখে পড়ল এক হরিণ। তাকে তাক করে তীর যে মূহুর্তে খুঁড়তে যাবেন তখন হরিণ বলে উঠল, ইব্রাহীম, তুমি আমাকে শিকার করতে পারবে না। বরং তােমাকে শিকার করার জন্যই আমাকে পাঠানাে হয়েছে। তুমি ভ্রান্ত। এসব কাজের জন্যই কি দুনিয়ায় এসেছ? বাদশাহ হতবাক। শিকার করা হল না। তিনি ফিরলেন। 

কিন্তু কি আশ্চর্য! যে ঘােড়ার ওপর তিনি বসে রয়েছেন, তার জীন থেকেও হরিণের কথার প্রতিধ্বনি শােনা যাচ্ছে। সে সতর্কতা- সূচক ধ্বনি- সন্ধেত বিদ্যুৎ তরঙ্গের মত তার স্নায়ুকোষে ছড়িয়ে গেল। নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলেন না। দু চোখ বেয়ে নেমে এল অশ্রুর উষ্ঠ ধারা। সিক্ত হল বসন- ভূষণ, সিক্ত হল তাঁর প্রিয় অশ্ব।

একটি মুহূর্তে এসে তার এতদিনে লালিত জীবনকে আমূল পরিবর্তন করে করলেন, আর লােকালয়ে ফিরবেন না। আর বাদশাহী নয়, তখত-ই- তাউস না। এবার শুরু হােক তার ধ্যান মৌন জীবন।

কিছুদুর গিয়ে তিনি এক চটের বস্ত্র পরিহিত এক রাখালের দেখা পেলেন। তাঁর সঙ্গে তিনি বদলে নিলেন পরিচ্ছেদ- পােশাক। সােনার অঙ্গ থেকে খসে গেল রাজভূষণ। বলখের বিখ্যাত বাদশাহ মুহর্তের মধ্যে হয়ে গেলেন এক দীনাতিদীন ফকির । শুরু হল তার আরণ্য জীবন। শুরু হল ধ্যান। এখন থেকে তওবা আর ক্রন্দনই হল তার একমাত্র অবলম্বন।

কে এ মহাপরাক্রমশালী বাদশাহ, যিনি মহাসাধকে রূপান্তরিত হলেন? বলখের সিংহাসন ছেড়ে আসন নিলেন মানুষের বুকের তলায়? তিনিই হযরত ইব্রাহীম আদহাম (র)।

নিবিড় নির্জনে পরিবর্তিত হয়েগেল বাদশাহ। অতঃপর ঘুরতে ঘুরতে চলে এলেন এক পুলের কাছে। দেখলেন একটি অন্ধলােক পুল পার হচ্ছে। টলমল করছিল সে। হয়তাে পড়েই য়েত। কিন্তু ইব্রাহীম আদহাম (র) বলে উঠলেন, ইয়া আল্লাহ! একে রক্ষা করুন। আশ্চর্য, বলার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল, লােকটি শূন্যে বিচরণ করছে। আরও আলােড়িত হল তাঁর হৃদয়-মন।

তারপর এলেন নিশাপুরে। আশ্রয় নিলেন এক অন্ধকার গুহায়। দেখতে দেখতে ন বছর পার হয়ে গেল আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে। ইবাদত মানে সে এক কঠিন তপস্যা। প্রতি শুক্রবার শুহা থেকে বের হয়ে তিনি বনে-জঙ্গলে কাঠ সহ করে বিক্রি করতেন নিশাপুরের বাজারে। তাতে যে আয় হত, তা দিয়ে রুটি কিনতেন । সে রুটির অর্ধেক দান করতেন গরিব-দুঃখীকে, আর অর্ধেক নিজে খেতেন। খুবই সামান্য খাবার। তাই খেয়ে নিশাপুরে জুম্মার নামায পড়ে আবার ঢুকতেন গুহায়। বেরিয়ে আসতেন পরবর্তী শুক্রবারে।

শীতের এক গভীর রাত। বেরিয়ে মধ্যে নামাযে নিমগ্ন তিনি। প্রবল শীত। তার ওপর তুষারপাত। হাঁড়- কাপুনে ঠান্ডায় একরকম জমে গেলেন তিনি। প্রচন্ড সর্দি। অবস্থা খুবই খারাপ । তবুও উপাসনার কোন আলস্য নেই। শৈথিল্য নেই। দেহ অবশ। মাথা ভারী হয়ে উঠল পাহাড়প্রমাণ। হয়তাে উপাসনার এবার বিঘ্ন ঘটবে। আর হয়তাে পারবেন না। একটু আগুনের যদি ব্যবস্থা হত এ সময়, তাহলে কী চমৎকারই না হত। 

এসব কথা ভাবছেন, মনে হল কে যেন তাঁকে একটি চামড়ার তৈরি গরম পােশাক পরিয়ে দিল। গরম হয়ে উঠল শরীর পরম নিশ্চিন্তে উপাসনায় রাত কেটে গেল তার। পরদিন সকালে দেখলেন, গরম পােশাক নয়, তাঁকে জড়িয়ে আছে এক বৃহৎ অজগর। বলাবাহুল্য তাঁর মনে ভীতির সঞ্চার হল। আল্লাহর কাছে মােনাজাত করলেন দয়াময়, যাকে আমি আপনার ভীষণ গজব স্বরূপ মনে করি, তাকেই আপনি আপনার রহমত স্বরপ নামিয়ে দিলেন। 

আপনার কুদরত বােঝা ভার: ধন্য আপনার কারিগরি। দেখতে দেখতে মাথা নিচু করে অজগর অদৃশ্য হয়ে গেল । হযরত ইব্রাহীম আদম (র)-এর কঠোর তপস্যা ক্রমশ লােকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। দলে দলে মানুষ ছুটে এল গুহাবাসীকে দেখতে। গভীর অরণ্য জনারণ্যে পরিণত হল। ফলে গুহা ত্যাগ করে তিনি মক্কায় চলে গেলেন। 

শােনা যায়, পরিত্যক্ত গুহাটি দেখতে এসেছিলেন অন্য এক দরবেশ হযরত আবু সাঈদ (র)। নিছক কৌতুহল বশেই তিনি এসেছিলেন। কিন্তু এসে অবাক হলে গেলেন। শুহার মধ্যে অপূর্ব এক সুগন্ধ ঘুরপাক খাচ্ছে। মৃগনাভীর তুলনা করা চলে না।

বনে অবস্থানকালে এক জ্ঞানী ব্যক্তি তাকে ইসমে আজম অর্থাৎ আল্লাহপাকের মহান শ্রেষ্ঠ নাম শিক্ষা দেন বলে শােনা যায়। ঐ জ্ঞানী ব্যক্তি হলেন হযরত খিজির (আ)-এর ভ্রাতা ইলিয়াস। একদিন তার সঙ্গে দেখা করতে এসে হযরত খিজির (আ) কথা প্রসঙ্গে এ কথা বলেন। দুজনের মধ্যে নানা কথাবার্তা হয় কথিত আছে, সেদিনই তিনি তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন। আর এই সাধনাপথেই মারফতী জ্ঞানের সর্বোচ্চ শিখরে আরােহণ করেন। 

এবং আল্লাহর সান্নিধ্যলাভে সক্ষম হন। তাঁর মক্কা পরিভ্রমণের কাহিনীও বেশ চমকপ্রদ। মক্কার পথে ইরাক সীমান্তে যাতুল তিনি সত্তরজন দরবেশের দেখা পান। একজন মাত্র জীবিত। আর সবাই মৃত-রক্তাক্ত কলেবরে শায়িত। যিনি জীবিত ছিলেন হযরত ইব্রাহীম আদহাম (র) তাঁরই কাছে ঘটনার বিবরণ জানতে চাইলেন। তিনি অবশ্য প্রথমে তাকে সদুপদেশ দিলেন। যেমন, কেবলমাত্র পানিকেই জীবনের অবলম্বন কর। আল্লাহ থেকে দূরে সরে যাবে না। সরে গেলে, তার রহমত থেকে সরে যাবে। আবার খুব বেশি কাছকাছি হয়াে না। ক্লান্তি আসবে। 

অপরাধ করে অশান্তি সৃষ্টি করা মােটেই উচিত নয়। হত্যাকারী কপট বন্ধুদের থেকে সাবধান-ইত্যাদি। পরে ঘটনার বিবরণ দিলেন। বললেন, তার একটি বিবাগী দরবেশ দল আল্লাহর ওপর নির্ভর করেই তারা পথ চলছিলেন। তারা স্থির করেন, কারাে সঙ্গে কথা বলবেন না। আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করবেন না। তিনি ছাড়া আর কারও ওপর নির্ভর করবেন না। তারা এ জঙ্গল পার হয়ে কাবাশরীফে পৌছেই হযরত খিজির (আ)-এর দেখা পান। 

তাঁকে সালাম জানিয়ে সানন্দে তারা বলে উঠলেন, আল্লাহকে ধন্যবাদ, আমাদের পরিশ্রম সার্থক, মনােবাঞ্ছা পূর্ণ। ধন্যবাদ আল্লাহকে যে, এমন মহান এক ব্যক্তি আমাদের নিকটে উঠেছেন। ঠিক তখনই তারা আশমানি শব্দ শুনলেন, রে ভক্তের দল, আমার সঙ্গে তােমাদের কি এই প্রতিজ্ঞা ছিল? যাও, এ অপরাধে ভুলে তোমরা কি এবার অন্যের সাথে বন্ধুত্বে আবদ্ধ হলে? যাও, এ অপরাধে আমি তােমাদের খতম করে ফেলব। হলও ঠিক তাই। 

ঐ সেই প্রেম-দগ্ধ শায়িত বাক্তিগণ, জীবিত ব্যক্তি হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র)-কে দেখালেন। বললেন, খুব সাবধানে এগিয়ে যাও। আর তা না হলে বিপদসঙ্কুল পথ থেকে এখনই প্রত্যাবর্তন কর। হযরত ইব্রাহীম আদহাম (র) তাঁর কথা শুনে নির্বাক হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু আপনি কিভাবে রক্ষা পেলেন? 

তিনি বললেন, এরা অবশ্য সবাই সিদ্ধপুরুষ ছিলেন। আর আমি এদের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করছিলাম। আমি তখনও সিদ্ধিলাভ করিনি। বিশুদ্ধ প্রেমিক হবার চেষ্টায় ছিলাম। বলতে বলতে

হঠাৎ তিনিও মৃত্যুমুখে পতিত হলেন। এক নতুন অভিজ্ঞতা হল ইব্রাহিম আদহাম (র)-এর। আরও গভীর সাধনায় ডুবে গেলেন। কেবল উপাসনা আর ক্রন্দন-এ হল তাঁর পথ চলার পদ্ধতি। একদিন নয়, দুদিন নয়, একটানা চল্লিশ বছর ধরে তিনি উপাসনা আর ক্রন্দন করতে করতে মক্কার পথে অগ্রসর হলেন। তাঁর আগমন-বার্তা পেয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য এগিয়ে এলেন মক্কার অনেক দরবেশ। 

কিন্তু তিনি তাঁর দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা একা পৌছে গেলেন মক্কার সন্নিকটে। আবার ওদিক থেকে দরবেশগণের এক সেবক তাঁকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করার উদ্দেশে চলে এসেছিলেন দরবেশদলের আগে। দুজনের দেখা হল রাস্তার ওপর। কেউ কাউকে চেনেন না। দরবেশ-শিষ্য তাকেই জিজ্ঞেস করলেন, অদূরবর্তী কাফেলায় কি ইব্রাহিম আদহাম (র) আছেন?

ইব্রাহিম আদহাম (র) বললেন, ঐ অবাধ্য লােকটির কাছে তােমার কাজ কি? তাঁর কথায় রেগে গিয়ে সেবক তাকে এক প্রচণ্ড ঘুষি বসিয়ে দেয়। তুমি এমন এক সাধককে অবাধ্য বলছ? আসলে তুমিই অবাধ্য। আমি তাে বলছি, আমি অবাধ্য। ইব্রাহিম আদহাম (র) এ কথা বলে কিছুটা দূরে সরে গেলেন। তারপর নিজেকেই বলতে থাকেন, তুমি আশা করেছিলে যে, মক্কার দরবেশগণ তােমাকে স্বাগত জানাবে। এবার যােগ্য শাস্তি পেলে তাে। আল্লাহকে ধন্যবাদ, তুমি যেমনটি আশা করেছিলে তেমন ফলই পেলে।

পরে ঐ খাদেম। অবশ্য তাকে চিনতে পেরে তার নিকট ক্ষমা চেয়ে নেন। 

মক্কায় পৌছে তিনি স্থায়ীভাবে সেখানে বসবাস শুরু করেন। বহু লােক তাঁর কাছে দীক্ষা নেয়। জীবিকার জন্য তিনি বনে-জলে কাঠ সগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করতেন। কখনও কখনও শাক- সবজিও বিক্রি করতেন। রাখালের কাজও করতেন।

বলখ ছেড়ে আসার সময় তার স্ত্রী ও এক শিশুপুত্র বর্তমান ছিল। বড় হয়ে ছেলেটি পিতার কথা জিজ্ঞেস করেন। মা তাকে সব কথা খুলে বলেন। তিনি যে এখন মক্কাবাসী-তা-ও তাঁকে জানান। মায়ের অনুমতি নিয়ে পিতার সঙ্গে মিলিত হবার উদ্দেশ্যে চার হাজার হজ্জযাত্রীর যাবতীয় খরচ বহন করে, হজযাত্রী ও জননীসহ তিনি একদিন এসে গেলেন মক্কায়। হারাম শরীফে দরবেশী পোশাক পরিহিত লােকজনদের কাছে পিতার কথা জিজ্ঞেস করেন। 

তাঁরা জানালেন, তিনিই তাঁদের দীক্ষাগুরু। এখন তিনি জঙ্গলে গেছেন কাঠ কাটতে। সেগুলি বিক্রি করে আমাদের জন্য রুটি নিবেন। পিতার কথা শুনে পুত্র ছুটে যান জঙ্গেলের দিকে। দেখলেন একটা বুড়াে মানুষ এক বেকা কাঠ নিয়ে বাজারে চলছেন। তাকেই তাঁর পিতা ভেবে তিনি তাঁর পিছু নিলেন। কান্নায় বুক ভেসে গেল তার। বাজারে গিয়ে বৃদ্ধ এ বলে কাঠ বেচতে লাগলেন; হালাল জিনিসের বদলে কে হলিল জিনিস কিনতে চায়? তার আহবানে সাড়া দিয়ে এক ব্যক্তি কাঠগুলি কিনে নিয়ে তার বদলে কয়েকখানি রুটি দিল । আর রুটি এনে তিনি তাঁর শিষ্যদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন। তারপর নামায আদায় করে সবাই মিলে খেলেন।

ইব্রাহিম আদহাম (র)-এর পুত্র সব দেখলেন। কিন্তু নিজের পরিচয় দিলেন না। শিষ্যসহ ব্রাহীম আদহাম একবার মুখােমুখি হলেন দুজনে। পিতার চোখ পড়ল পুত্রের চোখে। তিনি অপলকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। কাজটি তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। শিষ্যগণ অবাক হলেন।

কাবা পরিক্রমা শেষ হলে শিষ্যরা জিজ্ঞেস করেন, আপনি আমাদের উপদেশ দিয়েছেন, শ্মশ্রু শুস্ফহীন যুবক ও অপরিচিতা নারীর দিকে চোখ তুলে তাকাবে না। অথচ আপনি ঐ ধরনের একটি যুবকের দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে ছিলেন। এর কারণ কি?

তিনি বললেন, বলখ ছেড়ে আসার সময় আমি আমার এক দুগ্ধপােষ্য শিশুকে রেখে এসেছিলাম। মনে হল, যুবকটি বােধহয় আমার সেই শিশুপুত্র।

তাঁর কথাটি শিষ্যদের মাথায় রইল। পরদিন একজন মুরীদ বলখ থেকে আগত হজ্জ যাত্রীদের তাঁবুগুলি খুঁজতে শুরু করলেন। এক রেশমী কাপড়ের তাঁবুর ভেতরে তিনি তরুণকে দেখলেন। দামী আসনে বসে তিনি একমনে পবিত্র কুরআন পাঠ করছেন। তাকে তাঁবুতে ঢুকতে দেখে তরুণ তাঁর আগমনের উদ্দেশ্যে জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, আমি একটা জিনিস জানতে এসেছি। 

বলুন তাে, আপনি কার পুত্র? তরুণ কেঁদে ফেললেন। বললেন, আমি আমার পিতাকে দেখিনি, তবে গতকাল যে বৃদ্ধ লােকটিকে আমি কাঠের বােঝা নিয়ে যেতে দেখেছি, আমার মনে হয়েছে। তিনিই আমার পিতা। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারলে হয়তাে আমার সংশয় দূর হতাে। তাঁর নাম ইব্রাহীম আদহাম। মুরীদ বললেন, আপনি আমার সঙ্গে আসুন।

তরুণ পুত্রকে তিনি নিয়ে এলেন ইব্রাহিম আদহাম (র)-এর কাছে। আল্লাহর অশেষ ইচ্ছায় দীর্ঘদিন পর পিতা-পুত্রে মিলন ঘটল পবিত্র মক্কা শরীফে। পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে বিপুল কান্নায় ভেঙে পড়লেন। যেন আকাশ ও পৃথিবীও প্রবল কান্নায় উথলে উঠল। এক সময় তাঁরা জ্ঞান হারালেন। জ্ঞান ফিরে এলে হযরত ইব্রাহীম আদহাম (র) পুত্রকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কোন ধর্ম পালন করছ বাপ?

পুত্র বলেন, আমি ইসলাম ধর্মের অনুসারী। পবিত্র কুরআন শিখেছ?

জী আব্বা।

কিছু ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করেছ কি?

জী। আল্লাহর রহমতে তাও করেছি

আলহামদুলিল্লাহ! খুব খুশি হলেন হযরত ইব্রাহীম আদহাম (র) এবার বিদায় নেবার পালা। হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) এবার তার আপন বলয়ে ফিরতে চাইলেন। কিন্তু বাধা এল পুত্র ও অশ্রুমতী স্ত্রীর তরফ থেকে। তখন আকাশের দিকে চোখ তুলে তাপস বললেন, আল্লাহ্ গাে, আপনি আমাকে সাহায্য করুন।

আর সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ ঘটে গেল ঘটনাটি। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন, হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র)-এর প্রিয়তম পুত্র। আর উঠলেন না। শেষ নিঃশ্বাসটি শেষবারের মত বেরিয়ে গেল।

ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই বিমূঢ় হয়ে গেলেন। শিষ্যরা, বললাে একি হল হুযুর। তিনি জবাব দিলেন, আমি যখন পুত্র দর্শনে পাগল হয়ে তাকে কোলে তুলে নিলাম, তখন আমার কাছে এক দৈববাণী আসে, ইব্রাহিম, তুমি না আমার বন্ধুত্বের দাবী কর। কিন্তু এখন দেখছি, আমার ভালােবাসার সঙ্গে অন্যেকে ও হৃদয়ে স্থান দিয়েছ। তুমি তােমার শিষ্যদের উপদেশ দাও স্ত্রীপুত্রকন্যার প্রেমে আমি আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা জানাই, প্রভুগাে, হয় আমাকে না হয় আমার পুত্রকে আপনার দরাবের তুলে নিন। আল্লাহ আমার প্রার্থনা মুঞ্জর করেছেন। পুত্রের ক্ষেত্রে তা কার্যকারী হলাে।

মনে প্রশ্ন আসে, হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র)-এর মত মহান সাধক নির্দোষ পুত্রের মৃত্যু কামনা করলেন? তখন অন্য এক জ্যোতিষ্ক-হযরত ইব্রাহিম (র)-এর কথা মনে পড়ে। প্রিয়তম প্রভুর নির্দেশ পালনে, প্রভুর সন্তোষ বিধানে তিনি তাঁর প্রিয়মত পুত্রের গলায় ধারালাে ছুরি বসিয়েছিলেন। আল্লাহর পথের পথিক যারা, তারা কি কখনও মানবিক বা স্নায়বিক দুর্বলতার শিকার হন?

হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র)-এর বড় ইচ্ছে, রাত্রে কাবাগৃহে- একান্তে তিনি আল্লাহর কাছে মােনাজাত করবেন। একদিন অপূর্ব সুযােগ ও এসে গেল। রাতে তিনি ছাড়া কাবা-ঘরে কোন জনপ্রাণী ছিল না। আর এ সুযােগ হাতছাড়া হতে না দিয়ে তিনিও পবিত্র গুহে হাত রেখে নিজের পাপের জন্য তওবা করলেন। আর আল্লাহর দরবারে মাগফেরাতের জন্য প্রার্থনা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ধানিত হল অদৃশ্য বাণী; ইব্রাহিম! তােমার মত সমগ্র সৃষ্টি আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছে। এখনই যদি তােমাকে ক্ষমা করে দিই, তাহলে রােজ-কিয়ামতে আমার ক্ষমাগুণটি কিভাবে প্রকাশ করব?

প্রভুগো, অন্তত আমাকে মাফ করে দিন। ইব্রাহিম আদহাম (রাঃ) কাতরভাবে বললেন। উত্তর এল, তুমি নিজের জন্য প্রার্থনা না করে অন্যের জন্য কর। তােমার পক্ষে তাই হবে শােভন ও সুন্দর। আল্লাহপাক তার প্রিয়জনের কাছে কী চান, এ ঘটনায় তা স্পষ্ট হয়ে যায়। শুধু নিজের মুক্তি নয়, মানুষের মুক্তির জন্য আল্লাহর দাসগণ সর্বতােভাবে সচেষ্ট থাকুন।


আপনি রাজ্যত্যাগ করলেন কেন? তাঁকে প্রশ্ন করা হয়। তিনি বলেন, একদিন রাজসিংহাসনে বসে আছেন। তার সামনে ছিল একখানি সুদৃশ্য আয়না। সেদিকে তাকিয়ে তিনি দেখতে পেলেন, তিনি রয়েছেন কবরের মধ্যে। কোন সঙ্গীসাথী নেই, একা। সঙ্গে পাথেয় ও কিছু নেই। বিচারকক্ষে বিচারক বসে আছেন। কিন্তু নিজের পক্ষ অবলম্বন করার মতাে কোন কাগজপত্র তাঁর কাছে নেই। এই দৃশ্য দেখে তিনি চিরদিনের মত সিংহানের মায়া ত্যাগ করেন।

খােরাসান ত্যাগ করলেন কেন? আবারও প্রশ্ন হলাে। তার জবাব, ভিড়ের জন্য। সবাই আসত তার খোঁজ-খবর নিতে। তিনি গতকাল কেমন ছিলেন, আজ কেমন আছেন, এসব জানতে চাইতাে।

আপনি স্ত্রী গ্রহণ করেন না কেন?

স্ত্রী কি এ উদ্দেশে স্বামী গ্রহণ করে যে, সে অন্য বস্ত্রহীন ও খালি পায়ে দিন কাটাবে? আমার যা অবস্থা তাতে একজন স্ত্রীলােককে কি করে প্রতারণা ও ফাকির বন্ধনে বেঁধে রাখতে পারি? এক দরবেশকে পরনিন্দা করতে দেখে তিনি তাকে বলেন, আপনি বােধহয় বিনামূল্যে দরবেশী কিনছেন? 

দরবেশ রাগত দুরে বলেন দরবেশী কেউ আবার মূল্যের বিনিময়ে কেনে নাকি? তিনি জবাব দেন, কেন, আমি তাে বলখ রাজ্যের বিনিময়ে দরবেশী লাভ করেছি। আর আমি লাভবানও বটে। এক ব্যক্তি তাকে এক হাজার দিরহাম দিতে গেলেন। তিনি বললেন, গরিবের দান আমি গ্রহণ করি না। সে বলল, আমি গরিব নই।

তবে কি ধনী?

জী হ্যা।

তােমার যা আছে, তুমি কি তারও বেশী চাও না? চাই।

তাহলে তুমি ভিক্ষুক ছাড়া আর কি? দিরহাম ফিরিয়ে নিয়ে যাও। তিনি আরও বললেন, আমি দারিদ্র কামনা করি, অথচ আমার কাছে আসে কেবল ধনসম্পদ। কি বিপদ।

আল্লাহর তরফ থেকে তিনি যা কিছু কল্যাণ লাভ করতেন, তখন চুপ করে থাকতে পারতেন না। সে সুখবর তিনি জোরশােরে প্রকাশ করতেন। বললেন, হে রাজাবাদশাহগণ, সর্বশক্তিমান আল্লাহর অভাবনীয় মহিমা ও শক্তির নিদর্শন দেখে যান। তার কথা ছিল, যারা রিপুর দাস, তারা সত্যনিষ্ঠ নয়, আর সত্যনিষ্ঠ না হলে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনও সম্ভব নয়। তিনি বলেন, তিনটি অবস্থায় যার মন আল্লাহর প্রতি নিবন্ধ নয়, তার জন্য সত্যের দরজার উন্নুক্ত নয়।

১. কুরআন তেলাওয়াতের সময়,

২ নামায পড়ার সময়।

৩, মােরাকাবা-মােশাহাদার সময়।

আরেফগণের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে তিনি বলেন, তারা প্রতি মূহুর্তে আল্লাহর চিন্তায় বিভাের থাকেন। আর যে কোন বিষয় বা বস্তুর থেকে জ্ঞান আহরণ করেন।

আল্লাহর গুণকীর্তনের তাঁরা আনলস। তাঁর উপাসনাই তাদের প্রদান কর্ম। আল্লাহর সৃষ্টি-রহস্য সম্পর্কেও তারা চিন্তা-ভাবনা করেন।

চলার পথে তিনি একখন্ড পাথর দেখতে পান। তাতে লেখা আছে, তুমি যা জান, তা করার শক্তি সত্ত্বেও কেন করছ না? আর তুমি যা জান না, তা জানার জন্য কেন চেষ্টা করছ না? তিনি নিজেই এটি বলেছেন। সে সঙ্গে আরও বলেন, পার্থিব জগতে যা লাভ করা কষ্টকর, মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে তাই বেশী মূল্যবান। যিনি তপস্বী তাঁর সামনে থেকে তিনটি বিষয় সরে গেলেই তার পথ প্রশস্ত হয়। যেমন, (১) দুনিয়ার বাদশাহী লাভ করেও তাতে খুশি না হওয়া, আল্লাহর সতুষ্টির জন্য রাজত্বের প্রতি বিমুখ হওয়া, (২) রাজত্ব চলে গেলেও দুঃখিত না হওয়া। (৩) মানুষাে প্রশংসা বা দানের প্রতি লােভাতুর না হওয়া। কেননা প্রশংসা লােভী মানুষ কাপুরুষ দানের প্রতি আর কাপুরুষদের মধ্যে সততা ও সাহসের অভাব থাকে। আর তা আল্লাহ প্রাপ্তির পথে অন্তরায়।

আল্লাহর প্রেমিক হতে চাইলে শরীয়তবিরােধী সব কাজ পরিত্যাগ করতে হবে। আল্লাহর ছাড়া অন্য কিছু মন থেকে বের করে দিতে হবে। হালাল খাদ্য খেতে হবে। হালাল খাদ্য মনের অনুপম ইচ্ছা পূর্ণ করে-রাতের তাহাজ্জুদ নামায ও দিনের রােযা অপেক্ষাও। হালাল ছাড়া নামাজ, রােজা, যাকাত ইত্যাদি উপাসনার মাধ্যমে কে কোনদিন সাধক হতে পারে না। কোন এক ব্যক্তিকে কথা প্রসঙ্গে হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) বৈধ খাদ্যের শুরুত্ব সম্পর্কে এসব কথা বলেন।

কোন এক সাধকের সাধনা বিষয়ে লােকমুখে নানা কথা শুনে তিনি তাঁকে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তারপর একদিন চলেই গেলেন উক্ত দরবারে তাকে পেয়ে দরবেশ খুব খুশি। কম করেও তিনদিন তাঁর আতিথ্য গ্রহণের অনুরােধ জানালেন। বলামাত্র তিনি রাজি। কেননা, তিনি তাঁকে পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছিলেন। দেখলেন সত্যিই তিনি ইবাদত অনুরাগী। তার সম্পর্কে যা শুনেছিলেন, তার চেয়েও ইবাদত প্রিয়। রাতে চলে বিশ্রামহীন, বিরামহীন ইবাদত। 

নিজেকে তাঁর তুলনায় তুচ্ছ মনে হল ইব্রাহিম আদহাম (র)-এর। তাছাড়া তার আতিথেয়তাও অবাক করে দেয়। নানা ধরনের উপাদেয় ও সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করে তিনি তাকে আপ্যায়িত করেন। আর তখন-তখনই তার মনে অঙ্করিত হয় সন্দেহের বীজ। দরবেশের বাড়িতে খাবার-দাবারের এত তােড়জোড় কেন? এসব বৈধ খাদ্য তাে! খুব সন্তর্পণে তিনি তাও পরীক্ষা করে দেখলেন। আর জানা গেল, না, তাঁর এ খানদানী খানা হালাল নয়।


তিনদিন কেটে গেল। এবার বিদায়। যাবার সময় দরবেশকে তিনি মেহমান হওয়ার অনুরােধ করলেন। রাজিও হয়ে গেলেন দরবেশ। মেহমানকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র)। আর তাঁকে হালাল খাদ্য খাওয়াতে শুরু করলেন। আশ্চর্য ব্যাপার। দরবেশের উপাসনা বা আল্লাহপ্রেমের মাত্রা অনেকখানি কমে গেল । আর এর কারণ দরবেশও বুঝতে পারলেন না। 

অগত্যা তিনি হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র)-কে কারণটা জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, আমি কিছু করিনি। যা। করার, করেছে আমার পরিবেশিত খাদ্য। এতদিন আপনি অবৈধ খাবার খেয়েছেন। তাই শয়তান আপনার মধ্যে যাতায়াতের যথেষ্ট সুযােগ পেয়েছে। আর আপনার ইবাদত-বন্দেগী ছিল আসলে শয়তানের কারসাজি। এবারে আপনার পেটে পড়েছে বৈধ খাবার। 

আর ইবলিসের আনাগােনা ও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আপনি যেটুকু ইবাদত করছেন, তার মধ্যে কোন ভেজাল নেই। তওবা করুন। আর এখন থেকে হালাল রুজির ওপর নির্ভর করুন। জানবেন, ইবাদত হালাল রুজির ওপর নির্ভরশীল। অবৈধ খাবার খেয়ে যে উপাসনা করা হয়, তা মূলত শয়তানী প্ররোচনা।

একবার তিনি হযরত সুফিয়ান (র)-কে কথা প্রসঙ্গে বলেন, আপনি অবশ্যই বিপুল জ্ঞানের অধিকারী। কিন্তু আপনাকে আরও বেশী বিশ্বাসী হতে হবে। অর্থাৎ, তাপসগণের ক্রটি সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন।

হযরত শাকীক বলখী (র) একবার তাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি দুনিয়া থেকে এতবেশী দূরে থাকেন কেন? তিনি জবাব দেন, মানুষ যদি আমাকে দেখে তিনি ঘাস কাটতেন মাঠে। আর তা বিক্রি করে রুটি কিনতেন। আর সে রুটি দিয়েও দিতেন দরবেশদের । আর রাতের বেলায় বিরামহীন উপাসনা, উপাসনা আর উপাসনা।

লােকে জিজ্ঞেস করত, আপনার চোখে কি ঘুম আসে না? তিনি বলতেন, আল্লাহর আসক্তিতে আমার শান্তি লােপ পেয়ে গেছে। হৃদয়ে যার অশান্তি, তার ঘুম আসবে কি করে? নামায সম্পন্ন করে মুখের ওপর হাত রেখে বলতেন, আল্লাহ না করুন, এ নামায যদি আমার মুখের ওপর ছুড়ে মারা হয়, তাহলে কেমন হয়।

একদিন খাবার জুটল না। অনাহারে তিনি চার রাকায়াত শােকরনার নামায পড়লেন। পরদিনও তাই। আর সেদিনও তিনি শােকরানা নামায পড়লেন, ঐ চার রাকায়াত। এভাবে এক সপ্তাহ চলে গেল। না খেয়ে না খেয়ে তিনি খুবই দুর্বল হয়ে পড়লেন। আর এ অবস্থায় আল্লাহর দরবারে আরজ করলেন, প্রভুগাে, এখন কিছু খেতে দিলে ভালাে হতাে। মােনাজাত শেষ হলে এক তরুণ এসে তাঁকে অতিথি হিসেবে তার বাড়িতে নিয়ে গেল। 

কিন্তু বাড়িতে গিয়ে সে তাঁর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চিৎকার করে বললেন হুযুর । আমি আপনার পুরাতন ভৃত্য। আমার যা কিছু দেখছেন, সবই আপনার। হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) বললেন, তুমিই এসবরে মালিক। যাক, যা হবার হয়েছে। এবার আমাকে যেতে দাও। বলে তখনই তিনি তার আস্তানায় ফিরলেন। আর হাত ওঠালেন আল্লাহর দরবারে। প্রভু আমার ভুল হয়েছে। আর আপনি রাজ্যের সম্পদ আমার সামনে ধরে নিলেন। 

শিষ্যাদের প্রতি অনুরাগের প্রমাণঃ  শিষ্যের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ও অনুরাগের একটি অবিস্মরণীয় উদাহরণ আছে। তার এক শিষ্য অসুস্থ অবস্থায় শুয়েছিল এক পুরানাে ভাঙা মসজিদে। মসজিদের দরজা কপাটশূন্য। হু হু করে হিমেল হাওয়া ঢুকছে ঘরে। দরজায় কিছু ঝুলিয়ে দিয়ে বাতাস আটকানাে যাবে, তারও উপায় নেই। অথচ, অসুস্থ লােকটাকে ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচাতে হবে। হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) নির্বিধায় দাঁড়িয়ে রইলেন দরজায়-যতদূর সম্ভব ঠাণ্ডা বাতাস প্রতিহত করলেন। আর এভাবে রাত ভোর হয়ে গেল।

এবং আরও একটি উদাহরণ:

এক সফরে তার ভ্রমণ-সঙ্গী ছিলেন হযরত সােহায়েল ইবনে ইব্রাহিম (র)। হঠাৎ তিনি দারুন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আর তাঁর চিকিৎসার জন্য হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) তাঁর সর্বস্ব বেচে দিলেন। এমনকি গাধাটিও। আর দেশে ফেরার সময় কিছুটা সুস্থ, দুর্বল সােহায়েল (র)-কে কাধে নিয়ে তিনদিনের পথ অতিক্রম করলেন।

হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র)-এর হালাল খাদ্যাভ্যাসের কথা আগেই বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি কত সচেতন ছিলেন, তা জানা যখন তিনি বলেন যে, চল্লিশ বছর ধরে তিনি মক্কার ফল মুখে দেননি। কারণ? কারণ, ফলের বাগানগুলি তখন সেনা-বিভাগের লােকেরা কিনে নিয়েছিল অবৈধ উপার্জনের টাকায়। জীবনে তিনি বহুবার হজ্জে গেছেন-পায়ে হেঁটে প্রত্যেকবার। মক্কায় অবস্থানকালে তাঁর বয়স ছিল প্রায় পঞ্চাশ বছর। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়েও তিনি জমজম কূপের পানি পান করেননি। কেননা, কূপ থেকে পানি তােলার বালতিটা ছিল সরকারী।

হালাল রুজি-রােজগারের জন্য তিনি দিনের বেলায় ঘাস বা কাঠ কাটতেন। আর সেগুলির বিক্রয়লব্ধ অর্থ দ্বারা রুটি কিনে দরবেশদের খাওয়াতেন, নিজেও খেতেন। কখনও কখনও দিন- মজুরের কাজও করতেন।

একবার সন্ধ্যা উতরে গেল। তিনি ফিরলেন না। তার শিষ্যরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন। তারপর যার যা ছিল, তাই দিয়ে খাবার কিনে খেয়ে ঘুমিয়ে গেলেন। অনেক রাতে হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) বাসায় ফিরলেন। দেখলেন, সবাই ঘুমিয়ে গেছে। বড় কষ্ট তার। বেচারারা হয়তো তাঁর পথ চেয়ে চেয়ে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সঙ্গে আটা কিনে এনেছিলেন। কাউকে না জাগিয়ে নিজেই রুটি বানাতে গেলেন। কিন্তু মুশকিল হল আগুন নিয়ে। 

কিছুতেই আগুন জ্বলছে না। কত ফু দিলেন। তবুও জ্বলছে না। এমন সময় একজনের ঘুম ভাঙল। তিনি আবার অন্যদের জাগিয়ে দিলেন। মুর্শিদের কাণ্ড দেখে মুরীদরা বললেন, এতরাতে এ আপকি কী করছেন? তিনি যেন অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, আমার আজ খুব দেরি হয়ে গেল। দেখি তােমরা সব ঘুমে অচেতন। ক্ষিদেয় কত কষ্ট হয়েছে তোমাদের। তাই নিজেই রুটি তৈরি করতে লাগলাম। ভেবেছিলাম, রুটি হলেই তােমাদেরকে জাগাব। তার আগেই তােমরা জেগে উঠেছে।

মুর্শিদের এ ঋণ কী দিয়ে শােধ করা যায়, আল্লাহই তা জানেন-শিষ্যরা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলেন। মুর্শিদ না মুরীদ-কে কার খেদমত করবেন। চিরকালের জন্য এ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেছেন হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র)। তাঁর শিষ্য হওয়ার শর্ত ছিল বিচিত্র। তিনটি শর্ত আরােপ করতেন তিনি।

(১) আমি তােমাদের পরিচর্যা করব। আপত্তি করবে না। 

(২) নামাযের আযান আমিই দেব।

(৩) আমার যা খাবার জুটবে, তাই তােমাদের দেব। খেতে সঙ্কোচবােধ করবে না।

দীর্ঘদিন তার সংস্পর্শে থেকে এক সহচর বিদায় নিলেন। বিদায়ের প্রাক্কালে তিনি বললেন, হুযুর, আমি অনেকদিন আপনার সঙ্গে ছিলাম। আমার মধ্যে যে দোষ-ক্রটি দুর্বলতা দেখেছেন, দয়া করে বলুন। হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) উত্তর দিলেন, তুমি আমার সর্বক্ষণের সংবন্ধু। সুতরাং তােমার দোষ-ত্রুটি-দুর্বলতা আমার চোখে পড়েনি।

একটি বড় পরিবার। পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনেক। সকলের অন্ন জোটাতে কর্তা হিমশিম খেয়ে যান। একদিন তাে অন্নের সংস্থান করাই গেল না। ব্যর্থ, বিষণ্ন মানুষটি বাড়ি ফিরছিলেন। রাস্তায় হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র)-এর সঙ্গে দেখা। তাকে পরিবার-কর্তা বললেন, আপনাকে দেখে আমার হিংসে হয়। কেন, জানেন? আপনার সংসার নেই। 

তাই সংসারের চিন্তাও নেই। নিশ্চিন্তে দিব্যি রয়েছেন আপনি। আর আমি যে কী দুর্ভাবনায় দিন কাটাচ্ছি, সংসারী হলে বুঝতে পারতেন। হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন, ভাই, আমি সারা জীবন যে পূণা করেছি, সব তুমি নাও। আর তােমার আজকের এ ভাবনাটুকু আমার দিয়ে দাও।

খলিফা মােতাসেম বিল্লাহর সমকালীন লােক ছিলেন হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) একদিন খলিফা তাকে বললেন, আপনি অপরের জন্য কী করছেন আর নিজের জন্যই বা কী করছেন? হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) উত্তর দিলেন, পার্থিবজীবনে যারা ভােগবিলাসের কামনা করে, তাদের অনুকূলে আমি সেসব পরিত্যাগ করেছি । যারা পরকাল চায়, আমি তাদের দিকে চেয়ে তা থেকে ফিরে গেছি। আল্লাহর দীদার লাভ করব বলে তার ধ্যানে মগ্ন থাকার চেষ্টা করছি।

হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র)-এর কয়েকটি উল্লেখিত ঘটনাঃ এত বড় সাধক হওয়া সত্ত্বেও তিনি কিন্তু একটি ঘটনায় বেশ লজ্জা পান। এক ক্ষৌরকার তাঁর ক্ষৌরকর্ম করছিল। তাঁর এক শিষ্য বললেন, আপনার কাছে কিছু থাকলে একে মজুরি বাবদ দিয়ে দেবেন। হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র)-এর কাছে ছিল মুদ্রা-ভর্তি একটা থলে। তিনি সেটা ক্ষৌরকারকে দিলেন। এমন সময় এক ভিক্ষুক এসে ভিক্ষা চাইল । ক্ষৌরকার তাকে ঐ থলেটা দান করলেন।  

আর ব্যস্ত হয়ে উঠলেন হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র)। আরে, কর কী! ওতে যে সব সােনার মােহর রয়েছে। ক্ষৌরকার একটুকু বিচলিত না হয়ে বললাে, তাতে কী? ওতে সােনার মােহর রয়েছে তা আমি জানি। আর যাকে দান করলাম, সে-ও জানে। আপনার মনশ্চক্ষু এখনও উম্মিলিত হয়নি দেখা যাচ্ছে। যে লােক শুধু ধন-সম্পদে ধনী, সে প্রকৃত ধনী নয়। অন্তরের ধনে যে ধনবান, প্রকৃত ধনী তাকেই বলে।

বলা বাহুল্য, ক্ষৌরকারের কথায় বড় লজ্জিত হলেন। ধিক্কার দিলেন নিজের অন্তর ও প্রবৃক্তিকে। আসলে ক্ষৌরকার ও ভিক্ষুক যে তাঁকে শিক্ষা দিতে এসেছিল, তা বুঝতে তাঁর দেরি হল না।

রাজসিংহাসন ত্যাগ করে সাধনার পথে এসে তিনি কি কোন ব্যাপারে আনন্দ লাভ করেছেন? তাকে প্রশ্ন করা হয়। তিনি বলেন, বহু ব্যাপারে তিনি আনন্দিত হয়েছেন। একবার তিনি নৌ-যােগে কোথাও যাচ্ছিলেন। তাঁর ছেড়া ময়লা পোশাক আর রক্ষ চুল দেখে নৌকার অন্যান্য যাত্রীরা তাঁকে পাগল বলে মনে করে। একজন কৌতুকপ্রিয় রসিক ব্যক্তি তার মাথায় চুল ধরে টেনে বেশ মজা পাচ্ছিল। বারবার গলা ধাক্কাও দিচ্ছিল সে। সবাই বেশ মজা উপভােগ করছিল। তিনিও প্রবৃক্তির অপমানজনিত কারণে আত্মহারা হয়েছিলেন।

হঠাৎ নদীতে উঠল প্রবল ঢেউ। নৌকাটা আর সামলানাে যাচ্ছিল না। মাঝি বললাে, নৌকার ভার কিছুটা কমাতে পারলে হয়তাে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। না হলে যা অবস্থা-তাতে কী হবে বলা মুশকিল মাঝির কথা শুনে একটা লােক তার কান ধরে বললাে, যা ব্যাটা, নদীতে ঝাপ দে, নইলে ঠেলে ফেলে দেব। সে এতজোরে কান ধরে টানছিল যে, মনে হচ্ছিল কানটা বুঝি উপড়ে যাবে। এ সময় প্রবৃত্তির অপমান ও দীনতা দেখে তিনি প্রচুর আনন্দ পান। আর তখন আচমকা ঝড় থেমে যায়। নদী শান্ত হয়। তাকে আর ঝাপ দিয়ে নৌকার বােঝা কমাতে হল না। 


আরও একদিনের ঘটনা। তিনি বিশ্রাম নিতে এক মসজিদে ঢুকলেন। কিন্তু ওখানে যারা ছিল, তারা জংলী মনে করে তাকে কান ধরে মসজিদ থেকে বেরিয়ে যেতে বলল। তিনি শুধু রাতটুকু আশ্রয় দেবার জন্য খুব কাকুতি মিনতি করলেন। কিন্তু কে শােনে কার কথা। তারা তাকে দরজার কাছে টেনে এনে এমন জোর ধাক্কা দিল যে তিনি টাল সামলাতে না পেরে সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে লাগলেন। 

মাথায় দারুণ চোট লাগল । কিন্তু গড়াতে গড়াতে তাঁর মনে হলাে, প্রতিটি ধাপে মারেফাতের জটিল তত্ত্বের এক একটি স্তর তিনি যেন আয়ত্ত করে ফেললেন। এ দুর্দশার সময় এক রসিক পুরুষ তাঁর মাথায় প্রস্রাব ঢেলে দিল। এ সময় প্রবৃত্তির বেশ জব্দ হওয়ায় তিনি খুবই আনন্দ পান। আরও একটি ঘটনা।

পরনে তার চামড়ার জোব্বা। দারুণ ময়লা। উকুন থিক থিক করছে। তাঁরা এমনভাবে কামড়াতে শুরু করল যে, দুহাত দিয়ে তিনি গা চুলকাতে লাগলেন। চুলকাতে চুলকাতে অস্থির। তখন তার মনে এল অতীতের বাদশাহী জীবনের জরির কাজ করা রেশমি পােশাকের কথা। আর তখন, প্রবৃত্তির বেশ কিছু শিক্ষা হয়েছে। ভেবে তিনি প্রভূত আনন্দলাভ করেন।

কিন্তু প্রবৃত্তির মৃত্যু নেই। হঠাৎ হঠাৎ সে জেগে ওঠে। একবার আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হওয়ার জন্য তিনি গেলেন এক নির্জন প্রান্তরে। বেশ কিছুদিন কেটে গেল সেখানে। কিন্তু খাওয়া জুটল না। ওখান থেকে কিছু দূরে তার এক হিতৈষী ছিল। একবার ভাবলেন, আমি তাঁরই ওপর নির্ভর করলাম যিনি চিরঞ্জীব, অমর। তুমিও কৃত্রিম। প্রকৃত বন্ধুর কাছে কী খাওয়ার ইচ্ছা জানাতে হয়

এক দরবেশকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কিভাবে কোথা থেকে জীবিকা সংগ্রহ করেন? দরবেশ জবাব দেন, সেটা আমার জানার কথা নয়। যিনি আমাকে জীবিকা দেন, বরং তাকেই জিজ্ঞেস করুন।

একবার তিনি একটি দাস ক্রয় করলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তােমার নাম কি?

সে বলে, আপনি যে নাম ধরে ডাকবেন।

তুমি খাবে কি?

আপনি যা খেতে দেবেন।

তুমি পরবে কি?

আপনি যা পরতে দেবেন।

তােমার নিজের কী ইচ্ছা, বল না। ক্রীতদাসের আবার ইচ্ছা আছে নাকি?

তাঁর এ ধরনের কথাবার্তা শুনে মনে মনে তিনি নিজেকেই ধিক্কার দিলেন। তাঁর মনে হলাে, প্রকৃত দাসত্ব কাকে বলে, এখনও তার শেখা হয়নি। প্রবল কান্না এল তাঁর। আর এভাবে কাঁদতে কাঁদতে তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন।

কিভাবে তার সময় কাটে? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তার চারটি বাহন আছে। যেমন, (১) কৃতজ্ঞতা-আল্লাহ যখন কিছু দান করেন, তখন কৃতজ্ঞতার বাহনে চড়ে তিনি আল্লাহর দরবারে হাজির হন। (২) বিশুদ্ধ প্রেম-যখন উপাসনার উদ্দেশ্যে গমন করেন, তখন তাঁর বাহন হল বিশুদ্ধ প্রেম। (৩) ধৈর্য-যখন কোন বিপদ আসে জীবনে, তখন ধৈর্যের বাহনে চড়ে তিনি অগ্রসর হন। (৪) তওবা-আর যখন কোন পাপ কাজ করে ফেলেন, তখন তওবার বাহনে চড়ে তিনি আল্লাহর কাছে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

এক ব্যক্তিকে উপদেশ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, তুমি যে পর্যন্ত নিজের স্ত্রীকে বিধবা, সন্তানদের এতিম আর রাতের বিছানাকে কবর মনে না করবে সে পর্যন্ত তুমি নিজেকে সাধক পর্যায়ভুক্ত বলে মনে করবে না।

একবার এক সাধক-সমাবেশে গিয়ে বসতে যানে, তারা তাকে এই বলে বাধা দিলেন যে, তাঁর শরীরে এখনও বাদশাহীর গন্ধ আছে। দ্বিরুক্তি না করে তিনি দূরে গিয়ে বসলেন। আল্লাহর তরফ থেকে মানুষের মনের ওপর পর্দা পড়ে কেন?-তাকে প্রশ্ন করা হয়। তিনি বলেন, আল্লাহ যা ভালােবাসেন, মানুষ তার বদলে অন্য কিছু ভালােবাসে, তাই।

হযরত ইব্রাহিম আদহাম (রাঃ)-এর উপদেশঃ একমাত্র আল্লাহর সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করবে। আর সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব বর্জন করবে। একটি লােককে তিনি বলেন, তুমি যা বেঁধে রেখেছ, তা খুলে ফেল, আর যা খােলা আছে, তা বেঁধে রাখো। তিনি বললেন, বন্ধ টাকার থলে খুলে দান কর। আর অশ্লীল কথা বলা বন্ধ কর।

তওয়াফরত অবস্থায় তিনি একটি লােককে বলেন, যে পর্যন্ত না তােমার ভেতরের চারটি বস্তু বর্জন করে অন্য চারটি বস্তু অর্জন করবে, সে পর্যন্ত তুমি পূণ্যবানদের অন্তর্ভূক্ত হতে পারবে না। যেমন, (১) ধন-দৌলত ও প্রভুত্ব ছেড়ে দাসত্ব ও ফকিরী গহণ কর। (২) মান-সম্মানের আশা ছেড়ে দাও। অপমান ও হীনতা স্বীকার কর। (৩) নিদ্রা ও আলস্য ত্যাগ কর, কর্মতৎপর হও। (৪) অহমিকা বর্জন করে বিনয়ী হও।

সত্য-সন্ধিৎসু এক ব্যক্তির প্রতি তাঁর উপদেশঃ ১. তুমি যদি পাপকর্ম কর, তাহলে আল্লাহ প্রদত্ত রেজেক খাবে না। লােকটি বললাে রেজেক দাতা একমাত্র আল্লাহ। তাকে বাদ দিয়ে আর কার কাছ থেকে রেজেক গ্রহণ করব? হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) বললেন, তা ঠিক। তবে তুমি তার রেজেক খাবে অথচ তার অবাধ্য হবে, তা হয় না।

২. তুমি যদি পাপ করতে চাও, তাহলে আল্লাহর রাজ্য ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাও। কেননা, যার রাজ্যে বাস করবে তার বিরুদ্ধারণ করবে, এ হতে পারে না। লােকটি বলে, আল্লাহর রাজ্য ছাড়া অন্য কারও রাজ্য আছে কি কি? তিনি বললেন, তা যদি বুঝে থাক, তবে যেভাবে যা করা দরকার তাই কর। 

৩. তুমি যদি একান্তই পাপ করতে চাও, তাহলে এমন জায়গায় গিয়ে তা কর, যেন তিনি না দেখেন। লােকটি বলে, তিনি তাে সর্বত্রই বিরাজমান। আর সবকিছুই দেখতে পান। হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) বললেন, তুমি যার রুজি খাবে, যার রাজ্যে বাস করবে, তার সামনে বসে তাঁরই অবাধ্য হবে, এর চেয়ে অপরাধ আর বিশ্বাসঘাতকতা আর কী আছে?

৪. যখন মৃত্যুর দূত এসে উপস্থিত হবে, তখন তার কাছ থেকে তওবা করার সময় চেয়ে নেবে। লােকটি বললো, কিন্তু আজরাঈল কি তাতে রাজি হবেন? হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) বললেন, যদি সে কথা বুঝে থাক, তবে এখনই তওবা করে নাও।

৫. মৃত্যুর পর যখন মুনকির-নকীর কবরে প্রশ্ন করতে আসবে, তখন তাদের তাড়িয়ে দিও। লােকটি বলে, তা কি সম্ভব? হযরত ইব্রাহিম আদহান (র) বললেন, তা-ই যদি বুঝে থাক, তাহলে তাদের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নাও।

৬. রােজ কিয়ামতে আল্লাহ যখন পাপীদের জাহান্নামে নিয়ে যাবার জন্য ফেরেশতাদের হুকুম দেবেন, তখন তারা তােমাদের কাছে হাজির হলে বলবে আমি যাব না।

লােকটি বললাে, তারা তাে আমাকে জোর করে নিয়ে যাবে। হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) বললেন, তাহলে পাপ কাজ ছেড়ে দাও। তার কথা শুনে লােকটি বললাে, আপনি যা যা বললেন, তা কারাের পক্ষে সম্ভব নয়। হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) বললেন, তাহলে তুমি সমস্ত পাপকর্ম পরিত্যাগ কর। এবার লােকটি বললাে আমার জন্য তাহলে এ কাজটি করাই ভালাে। আর অন্যান্য কাজ অপেক্ষা এটি সহজতরও বটে। এ বলে সে তখনই তওবা করল। আর যাবতীয় পাপকর্ম থেকে বিরত হয়ে পুণ্যময় জীবনযাপন করতে লাগল।

কিছু লােক তাকে বললাে, আমরা আল্লাহর দরবারে দোয়া করি, অথচ তা কবুল হয় না কেন? তিনি বলেন, তার কারণ, আল্লাহকে তােমরা ভালাে করেই জানাে। অথচ তাঁর নির্দেশ পালন কর না। রাসূলুল্লাহকে (র) জানাে ও বিশ্বাস কর। অথচ তাকে অনুসরণ কর না। কুরআন শরীফ তেলওয়াত কর, অথচ তার ওপর আমল কর না। পুণ্যবানদের জন্য জান্নাত তৈরি হয়েছে। তােমরা তা ভালােবাবেই জান। অথচ নিজেরা পুণ্যবান হওয়ার মত কাজ কর না। 

পাপীদের জন্য জাহান্নাম সৃষ্টি হয়েছে, তা-ও তােমাদের জানা। অথচ পাপকর্ম থেকে তােমরা বিরত হও না। তােমরা জানাে, শয়তান তােমাদের শত্রু। অথচ তাকে শক্র মনে করে আসছে, অথচ তােমরা তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করছ না। মন্দ স্বভাব সংশােধন করে উত্তম স্বভাব অবলম্বন করছ না। নিজেদের বদভ্যাস আছে, অথচ অন্যদের খুঁত ধরতে যাও। ভেবে দেখ, এই যাদের অবস্থা, তাদের প্রার্থনা কি করে আল্লাহর দরবারে কবুল হবে?

তুচ্ছ প্রশ্নের ও তিনি অর্থ-গৃঢ় উত্তর দিতেন। একজন বললাে, মাংসের দাম খুব বেড়ে গেছে। কি করা যায় হুযুর? 

তিনি বললেন, মাংস খাওয়া বাদ দাও। তাতে দাম বাড়ুক বা কমুক, কিছু যায়-আসে না। হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) একবার আমন্ত্রিত হলেন। কিন্তু আমন্ত্রণস্থলে যেতে তাঁর কিছু দেরি হলাে। সবাই বলাবলি করতে লাগল, লােকটা ঐ রকমই। কথা দিয়ে কথা রক্ষা করার গুরুত্ব বোঝে না। এমন সময়ে তিনি হাজির হলেন। কথাগুলি তাঁর কানে গিয়েছিল। বললেন, নিয়ম হচ্ছে, মানুষ প্রথমে রুটি মুখে পুরবে, তারপর মাংস। কিন্তু তােমরা দেখছি, মাংসই প্রথমে মুখে নিচ্ছ। অর্থাৎ, একটু অপেক্ষা না করেই পরনিন্দা শুরু করে দিয়েছ।

জীর্ণ বস্তু পরিহিত অবস্থায় তিনি একবার এক হাম্মামখানায় প্রবেশ করলে সেখানকার লােক সাধারণ এক ভিক্ষুক মনে করে তাকে বাধা দিল। তখন তিনি একটি চমৎকার কথা বলেন। গরিব লােকদের উদ্দেশে বলেন, যখন শয়তানের ঘরে ঢােকার অনুমতি নেই, তখন উপাসনা ছাড়া কী করে আল্লাহর ঘরে ঢোকা যেতে পারে?


একবার হজ্জ মরসুমে একটানা তিনদিন উপবাসে কাটল তার। তখন শয়তান এসে বললাে, বলখের বাদশাহী ছেড়ে এভাবে কষ্টভােগ ছাড়া আর কিছু পেয়েছ কি? 

তিনি অভিমানক্ষু্ব্ধ কণ্ঠে আল্লাহকে বললেন, প্রভু গাে, আপনার এ বন্ধুর মনে কষ্ট দেবার জন্যই কি আপনি শয়তানকে পাঠিয়েছেন? আল্লাহর তরফ থেকে উত্তর এল, তােমার জামার পকেটে যা আছে ফেলে দাও। তাহলে এর কারণ বুঝতে পারবে। তিনি পকেটে হাত দিয়ে দেখলেন, দুটি রুপোর টাকায় হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) একটি ফলের বাগান পাহারা দিচ্ছেন। 

বাগানের মালিক তাঁকে কিছু মিষ্টি ডালিম আনতে বললেন। ডালিম আনা হলাে। মালিক সেগুলি কেটে খেলেন। খুব টক। বললেন, তুমি তাে বাগান পাহারা দাও। বাগানের ফলও খেয়ে দেখেছ। কোনটি টক, আর কোনটি মিষ্টি, নিশ্চয় বলতে পারবে। কিন্তু যেগুলি এনে দিলে তা বেশ টক। এর কারণ কী? তিনি বললেন, আপনি বাগান পাহারা দেবার জন্য আমাকে নিযুক্ত করেছেন, ফল খাবার জন্য নয়। কাজেই কোনটি টক আর কোনটি মিষ্টি, আমি কী করে জানব?

প্রহরীর কথায় মালিকের সন্দেহ হয়। তিনি বলেন, তােমার কথায় সততার যে সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, তাতে তােমাকে হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) মনে হচ্ছে। এ কথার উত্তর না দিয়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গে পাহারার কাজ ছেড়ে চলে গেলেন।

গভীর রাত। হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) নিদ্রাচ্ছন্ন। চমৎকার একটি স্বপ্ন দেখলেন। দেখলেন হযরত জিব্রাইল (আ) হাতে একখানি বই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি ফেরেশতা প্রধানকে জিজ্ঞেস কররেন, কী ওখানা? আর এ দিয়ে আপনি কি করবেন? জিব্রাইল (আ) বললেন, এতে আল্লাহর বন্ধুদের নাম লিখব। ইব্রাহিম আদহাম (র) বললেন, আমার নামটাও লিখবেন কি? তিনি বললেন, না। আপনি আল্লাহর বন্ধু নন। ইব্রাহিম আদহাম (র) হতাশ না হয়ে বললেন, তা না হলেও আমি তাঁর বন্ধুগণের বন্ধু তাে বটে। তাঁর কথা শুনে হযরত জিব্রাইল (আঃ) কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। পরে বললেন, আমি আপনার নামটিই সর্বপ্রথমে লিখবার নির্দেশ পেয়েছি।

এ স্বপ্ন-বৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন স্বয়ং হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র)। আরও একটি রাতের ঘটনা। তিনি রয়েছেন বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদে। মসজিদে কাউকে রাত কাটাতে দেয়া হতাে না। তিনিও তা জানতেন। তাই নিজেকে লুকিয়ে ফেললেন চাটাইয়ের মধ্যে। রাত তখন দুপুর। হঠাৎ মসজিদের দরজা খুলে যায়। 

আর চল্লিশজন জোব্বা পরিহিত অনুচর সঙ্গে নিয়ে এক বৃদ্ধ দরবেশ মসজিদে ঢুকে পড়লেন। তার পরণে জোব্বা। প্রথমে তাঁরা দুরাকায়াত নামায পড়লেন। তারপর বৃদ্ধ দরবেশ তার সঙ্গীদের দিকে মুখ করে বসলেন। এ সময় কেউ বললেন, আর মসজিদে আরও একজন লােক আছে। দরবেশ বললেন, হ্যা। সে ইব্রাহিম ইবনে আদহাম (র)। আজ চল্লিশ দিন ধরে সে উপাসনায় কোন স্বাদ পাচ্ছে না।

এবার চাটাই থেকে বেরিয়ে এলেন হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র)। তিনি বললেন, আপনার কথা সম্পূর্ণ সত্য জনাব। কিন্তু দয়া করে এর কারণটা বলুন। দরবেশ বললেন, আপনি একদিন বসরা শহরে খেজুর কিনেছিলেন। খেজুর বিক্রেতা যখন খেজুর ওজন করছিল, তখন একটি খেজুর নিচে পড়ে যাওয়ায় আপনি আপনার প্রাপ্য মনে করে সেটি খেয়েছিলেন। আপনি যে উপাসনায় স্বাদ পাচ্ছেন না, তার এই হল কারণ। দরবেশের কথা শুনে তিনি ভােরেই বসরা চলে যান। আর খেজুর বিক্রেতার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, খেজুর বিক্রেতা তার ক্ষমা প্রার্থনার কারণ শুনে অবাক হয়ে যান। সে বলে, পরের দ্রব্য হরণের অপরাধ যদি এতই গুরুতর হয়, তাহলে আমি না জানি কত অসংখ্য অপরাধ করেছি। এ বলে সে খেজুরের ব্যবসা ছেড়ে দেয়। আর তওবা করে আল্লাহর উপাসনায় আত্মনিয়ােগ করে। পরবর্তীকালে সে এক দরবেশ বিখ্যাত পরিণত হয়। একজন সৈনিকের সঙ্গে তাঁর একদিন কথােপকথন হয়।

সৈনিক। আপনি কে? হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র)। একজন দাস।

আপনার বাড়ি কোথায়?

ঐদিকে (কবরস্থানের দিকে ইশারা করে)।

আপনি আমার সঙ্গে উপহাস করছেন? সৈনিক ত্রুুদ্ধ হয়ে বলে। আর তার গলায় দড়ি বেঁধে বেত্রাঘাত করতে করতে রাস্তা দিয়ে টেনে নিয়ে যায়। লােকেরা সৈনিককে বলে, তুমি কার সঙ্গে কী ব্যবহার করছ। উনি ইব্রাহিম ইবনে আদহাম (র)। সঙ্গে সঙ্গে সৈনিক তার পায়ের তলায় পড়ে ক্ষমা চায়। 

ইব্রাহিম আদহাম (র) বলেন, তােমার অপ্রস্তুত হওয়ার কারণ নেই। আমি তােমার প্রতি রুষ্ট হইনি। বরং তুমি আমার প্রতি যে ব্যবহার করেছ, তার জন্য দোয়া করছি। কেননা, তোমার এ আচরণ আমার জান্নাতবাসের কারণ হয়েছে। অতএব দোয়া করি, আল্লাহর তােমাকেও জান্নাত নসীব করুন।

হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র)-এর কথায় আশ্বস্ত হয়ে সৈনিক বলে, হুযুর, আপনার নাম-ঠিকানা জানতে চাইলে আপনি অমন উপহাস করলেন কেন? তিনি বলেন, আমি মােটেই উপহাস করিনি বরং সত্য কথাই বলেছি। মানুষ মাত্রই আল্লাহর দাস। আর কবরস্থানও তার প্রকৃত বাসস্থান। কেননা, মানুষ দুনিয়াতে থাকে মাত্র কয়েকটি দিন। কিন্তু কবরে বাস করে রােজ কিয়ামত পর্যন্ত।

পথে একদিন এক মাতালের সঙ্গে দেখা। তার মুখভর্তি ধুলাে-মাটি ময়লা। বড় বিশ্রি। তিনি তার অবস্থা দেখে পানি এনে মুখ ধুয়ে দিলেন। বললেন, যে মুখ দিয়ে আল্লাহ পাকের নামেচ্চারণ হয়, তা অমন নােংরা করে রেখেছ কেন? মাতালের কোন জ্ঞান ছিল না। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন ইব্রাহিম আদহাম (র) চলে গেছেন। লােকে তাকে জানাল ইব্রাহিম ইবনে আদহাম (র) তাঁর মুখ পরিষ্কার করে গেছেন। 

আর এ কথা শুনে মাতালও তওবা করল। প্রতিজ্ঞা করল, জীবনে আর মদ ছোঁবে না। ঐ রাতেই হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) স্বপ্ন দেখলেন। আল্লাহর বলছেন, তুমি আমার নামের পবিত্রতা রক্ষা করার জন্য মাতালের মুখ ধুয়ে দিয়েছ। এর বিনিময়ে আমি তোমার অন্তর পরিস্কার করে দিলাম।

পবিত্র-হৃদয়ের ছোঁয়ায় সবকিছু পবিত্র হয়ে যায়। সামান্য একটি গাছও। বায়তুল মুকাদ্দাস সফরে হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) তাঁর ভ্রমণসঙ্গী হযরত মুহাম্মদ মুবারককে নিয়ে একটি ডালিম গাছের তলায় নামায পড়েন। নামায শেষে তারা রওনা দিচ্ছে, তখন ডালিম গাছের আবেদন শােনা গেল । আপনারা মেহেরবানী করে আমার দুটো ফল খেয়ে আমাকে ধন্য করুন। 

গাছের আবেদন সাড়া দিয়ে দুজনেই ফল খেলেন। ফলগুলি খুব টক। যাই হােক, কিছুদিন পর, ঐ পথে ফেরার সময় তারা সবিস্ময়ে দেখলেন, ছােট গাছটি এই কয়দিনে অনেক বড় হয়ে গেছে। আর তার ফলও বেশ সুস্বাদু হয়েছে। কথিত আছে, গাছটি নাকি বছরে দুবার ফল দিত।


পাহাড় চলতে শুরু করলাে। এক পাহাড়ে বসে কথা। হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) আর এক দরবেশ। দরবেশের প্রশ্ন : পূর্ণ আল্লাহওয়ালা ব্যক্তি হওয়ার পরিচয় কি? হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) উত্তর দিলেন, তিনি যদি পাহাড়কে চলতে বলেন, পাহাড় চলতে শুরু করে। আর, আশ্চর্যের কথা, তারা যে পাহাড়ের ওপর বসেছিলেন, তা চলতে শুরু করল। হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) বললেন, হে পাহাড়! আমি তাে তােমাকে চলতে বলিনি। তুমি চলতে লাগলে কেন? অমনি পাহাড় পূর্বের মতাে স্থির হয়ে গেল।

একবার তিনি চলেছেন নৌকাযােগে। হঠাৎ নদীতে উঠল ঝড়। নৌকা দুলতে লাগল। এই বুঝি ডুবে যায়। যাত্রীরা প্রাণভয়ে ভীত আর সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। তখন শােনা গেল অদৃশ্য লােকের শব্দ। তােমরা ভীত হয়াে না। তােমাদের নৌকোয় রয়েছেন হযরত ইব্রাহিম ইবনে আদহাম (র)।

আরও একদিন অনুরূপ অবস্থা। সেদিন অবশ্য তিনি ছাড়াও নৌকায় ছিল পবিত্র কুরআন শরীফ। তুফানে তরী তখন টালমাটাল, তখন হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র)-এর আকুল প্রার্থনা শােনা গেল। প্রভু গাে, আমাদের ডুবিয়ে মারবেন? সঙ্গে সঙ্গে সেদিনও ঝড়-তুফান থেমে যায়।

আরও একদিন। হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) যাবেন নদীর ওপারে। খেয়া নৌকায় পার হতে হবে। কিন্তু পারের কড়ি নেই। মাঝি তা দাবি করবেই। তিনি আর কী করেন। নদী তীরে দু রাকায়াত নামায পড়ে আল্লাহর কাছে মােনাজাত করলেন, আল্লাহ গাে, আমি নদী পার হতে চাই। অথচ আমার কাছে একটিও পয়সা নেই। কী হবে প্রভু? প্রার্থনা শেষ দেখা গেল, নদীতটের বালুকণা স্বর্ণরেণুতে পরিণত হয়েছে। আর তিনি তাই এক মুঠো তুলে খেয়া মাঝিকে দিলেন। পরম খুশিতে ডগমগ হয়ে মাঝি তাঁকে পার করে দিল

আরও একদিন। টাইগ্রীস নদীর তীরে বসে হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) তার পরনের ছেড়া পােশাক সেলাই করছেন আপন মনে। তা দেখে একটি লোক তাকে জিজ্ঞেস করে, বলখের সিংহাসন ত্যাগ করে আপনার কী লাভ হল বলুন তাে। ইব্রাহিম আদহাম (র) তার কথার উত্তর না দিয়ে হাতের সূচ ছুঁড়ে ফেললেন নদীতে। তারপর তাকে বললেন, তুমি ঐ সূচটি তুলে দিতে পার? লােকটি বলে, তা কী করে সম্ভব? তখন তিনি নদীকে কী যেন ইঙ্গিত করলেন। 

আর সঙ্গে সঙ্গে অনেক মাছ ভেসে উঠল পানির ওপর। প্রত্যেকের মুখেই এক-একটি সােনার সূচ। তিনি বললেন, আমি তাে সােনার সূচ চাইনি। নিজের সূচটিই চেয়েছি মাত্র। বলামাত্র একটি মাছ তাঁর সূচটি তাঁর সামনে ছুঁড়ে দিল। তিনি এবার লােকটিকে বললেন, দেখলে। রাজত্ব ছেড়ে দিয়ে আমি খুব তুচ্ছ জিনিসই লাভ করেছি, তাই না? বলা বাহুল্য, নিজের ভুল বুঝতে পেরে সে মহাসাধকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। নিবাের্ধ না হলে কী সে ঐ ধরনের প্রশ্ন করতে যায়?

হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) একবার চলেছেন কোথাও। সাথে বেশ কয়েকজন দরবেশ। তাঁরা পৌছালেন এক কেল্লায়। কেল্লার দরজায় অনেকগুলি কাঠের টুকরাে পড়েছিল। স্থির করলেন। রাতের দিকে কাঠের টুকরােগুলি জ্বালানাে হল। এক সাথী-দরবেশ বললেন, আমরা এখন যদি হালাল মাংস পেতাম, তাহলে দিব্যি রান্না করে খেতে পারতাম। হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) তখন নামায পড়ছেন। কথাটি কানে গেল তার। 

নামাজ শেষ করে তিনি বললেন, আল্লাহর অসীম শক্তি। ইচ্ছে করলে তিনি আমাদের জন্য হালাল মাংসের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। বলে তিনি আবার নামাযে রত হলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে দরবেশগণ বাঘের ডাক শুনতে পেলেন। আর দেখতে দেখতে একটি বাঘ এক বুনাে গাধাকে তাড়া করে সেখানে নিয়ে এল। তারা এই গাধাকেই জবেহ করে তার মাংস দিয়ে কাবাব বানিয়ে খেলেন। কাছে বসে বাঘটি সবকিছু দেখল।

একবার তিনি চলেছেন হজ্জের নিয়তে কাবার পথে। কয়েকজন সঙ্গীও রয়েছে যেতে যেতে একজন বললাে, আমি কপর্দকশূন্যে হুযুর। আমার কাছে কোন পাথেয় নেই। হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) বললেন, তােমার কি আল্লাহর ওপর এতটুকু ভরসা নেই? ধন-সম্পদের প্রতি এতই যদি তােমার আগ্রহ, তাহেল ঐ গাছটির দিকে তাকাও। তার কথা শুনে সাথী লােকটি দেখল, গাছটির মূল, কাণ্ড, শাখা-প্রশাখা, পাত সবকিছুই সােনার।

একবার কুয়াে থেকে পানি তুলবেন বলে তিনি বালতি নামালেন। বালতি উঠে এলে দেখা গেল, পানির বদলে উঠে এসেছে এক বালতি সােনা। তিনি আবার বালতি ফেললেন। এবার উঠে এল এক বালতি রূপাে। এবং আবারও বালতি নামালেন কুয়াের ভেতর। এবার উফল এক বালতি মােতি। তখন আল্লাহর দরবারে তিনি আরজ করলেন, প্রভু গাে, আপনি কি আমাকে পরীক্ষা করেছেন? সােনা-রূপা-মােতি নিয়ে আমি কী করব? পবিত্রতা অর্জনের জন্য আমার শুধু পানির প্রয়ােজন।

হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র)-এর ইন্তেকালঃ হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র) শেষ জীবনে পরিপূর্ণ নির্জনতায় ডুবে যান। সুতরাং তার মৃত্যুর কোন প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না। কোথায়, কখন, কিভাবে তাঁর মৃত্যু হয় কেউ জানতে পারেনি। কিন্তু মৃত্যুর পরমুহুর্তে একটি অদৃশ্য শব্দ বহু মানুষের শ্রুতিগােচর হয়েছিল। তা হয় এই যে, তােমরা জেনে রেখাে, দুনিয়ার শান্তি দুনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছে। 

এ আশমানী ঘােষণার মাধ্যমে পৃথিবীর লােকের কাছে তাঁর মৃত্যু-সংবাদ প্রচারিত হয়ে যায়। তিনি কোথা সমাধিস্থ হন, তা নিয়ে পণ্ডিত হলে মতপার্থক্য আছে। কেউ বলেছেন বাগদাদে, কেউ বলেছেন শামদেশে। শামদেশে হযরত লুত (র)-এর কবরের পামে তাঁকে দাফন করা হয় বলেও একটি কথা চালু আছে। একমাত্র আল্লাহ পাক জানেন, তাঁর প্রিয় বন্ধ কোথায়, পৃথিবীর কোন অংশের মাটিকে ধন্য করে শান্তির ঘুমে ঘুমিয়ে আছেন।

আরও পড়ুনঃ

* হযরত হাতেম আসাম (রাঃ) জীবনী

* হযরত দাউদ তায়ী (রাঃ) জীবনী

* বলখের বাদশাহ হযরত ইব্রাহীম ইবনে আদহাম (রাঃ) জীবনী

* হযরত ফোজায়েল ইবনে আয়াজ (রাঃ) জীবনী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ