বিখ্যাত মনীষী হযরত আবু সুলায়মান দারায়ী (র)
হযরত আবু সুলায়মান দারায়ী (র) শাম দেশের দারা নামক একটি গ্রামের অধিবাসী। এজন্য তিনি দায়ী নামে সুপরিচিত। হৃদয়ের পবিত্রতার জন্য তিনি সাধককুলে বিশিষ্ট হয়ে আছেন। কঠোর সাধনা ও উপবাসের জন্যও তিনি সুবিদিত। তাঁর কথা ছিল গভীর অর্থব্যঞ্জক মূল্যবান। তার সম্বন্ধে বলা হয়েছে, শরীয়ত ও মারেফাত সমুদ্রে তিনি যেন এক সুদক্ষ সাঁতারু।
তাঁর বক্তব্যের অভিনবত্বও উল্লেখযােগ্য। হযরত সুলায়মান দারায়ী (র)-এর এক শিষ্য তাঁকে বলেন, একরাত্রে নির্জনে নামায পড়ে তিনি খুব শান্তি ও তৃপ্তি পান। এ কথা শুনে তিনি বলেন, তুমি দীর্ঘদিন এ পথে থেকেও প্রকাশ্য ও নির্জনতার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারনি। মুমিন বান্দার জন্য দুয়েরই একরূপ হতে হবে। কেননা, আল্লাহর পথে চলার ক্ষেত্রে তাদের জন্য প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য কখনও কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।
প্রচণ্ড শীতের এক রাত। মসজিদে নামায পড়ছেন আবু সুলায়মান দারায়ী (র)। নামায শেষে যখন মােনাজাত করতে যাবেন, তখন একখানা হাত কাপড়ের অন্যখান তলায় ঢেকে রেখে,ওঠলেন আল্লাহর দরবারে। আর এভাবেই মােনাজাত শেষ করলেন। আর ঐ রাতেই তিনি স্বপ্ন দেখলেন, আল্লাহ বলছেন, তুমি যে হাতখানা তুলে মােনাজাত করেছিলে, সে হাতের পাওনাটা মিটিয়ে দিয়েছি। যদি অপর হাতখানা ওঠাতে, তাহলে তার পাওনাও পেয়ে যেতাে। এ স্বপ্নের পর তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, যত অসুবিধাই থাক, আর কোনদিন তিনি এ কাজ করবেন না।
এক রাতে স্বপ্নযােগে তিনি এক অনিন্দ্যসুন্দরী হুরকে দেখতে পান। হুর বলছেন, আপনি কী আরামে আছেন। এদিকে আমি প্রায় পাঁচশাে বছর ধরে আপনার বিরহে দিন গুনছি।
আরও এক রাতে তিনি এক চিরযৌবনা হুরকে স্বপ্নে দেখেন। অপরূপ ভঙ্গিতে তিনি তাঁর দিকে চেয়ে চেয়ে হাসছেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন, আপনার এ রূপরাশি এল কোথা থেকে? হুর জবাব দিলেন, আপনি এক রাতে কয়েক ফোটা অশ্রু ফেলেছিলেন। আপনার ঐ অশ্রপাতেই আমার রূপ এত বৃদ্ধি পেয়েছে। পাপীদের চোখের পানিতে হুরদের দেহ-সুষম কুসুমবর্ণে রঞ্জিত হয়। '
হযরত আবু সুলায়মান দারায়ী (র) তাঁর এক বন্ধুকে মক্কা শরীফে বারবার যম যম কূপের পানি পান করতে দেখে বলেন, কৃপের পানি যখন শেষ হয়ে যাবে, তখন কী করবে? সে বললে, আল্লাহ তােমাকে পুণ্যফল প্রদান করুন। আসলে আমি, এতদিন পুজো করে চলছিলাম। এই বলে সে কূপের এলাকা ছেড়ে চলে যায়।
কিছু লােক হযরত সালেহ ইবনে আবদুল করীম (র)-কে জিজ্ঞেস করে, আশা ও ভয়-এ দুটির মধ্যে কোনটি বেশি ভালাে? তিনি বলেন, দুটিই অন্তরের বস্তু, আলাে স্বরূপ। তবে আশা থেকে ভয়ের পাল্লাই ভারী। এ কথা যখন আবু সুলায়মান শুনতে পেলেন, তখন তিনি বললেন, আমার মতে, যাবতীয় উপাসনার ভিত্তি হলাে ভয়। কেননা, আশা উপাসনায় আলস্য এনে দেয়, মানুষকে উদাসীন করে। কিন্তু ইহকাল এ পরকালের সবকিছুর ভিত্তিই হলাে ভয়-ভীতি।
ভয়ের তুলনায় আশা যখন অধিক হয়, তখন অন্তরে আসে অবহেলা। অন্যদিকে, ভয়-বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উপাসনাও বৃদ্ধি পায়। হযরত লােকমান দায়ী (র)-এর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, লােকমান (র) তাঁর পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, আল্লাহকে এই পরিমাণ ভয় কর যেন তাঁর রহমত থেকে নিরাশ না হয়ে পড়। আবার আশা-আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতে গিয়ে যেন একেবারে নির্ভরও না হয়ে পড়। আহমদ খারী বলেন, আবু সুলায়মান এহরাম বাঁধার কালে লাব্বায়েক (আমি হাজির) বলতেন না।
তার কারণ তিনি বলতেন, আল্লাহ পাক হযরত মুসা (আ)-কে বলেন, আপনার অত্যাচারী উমতদের জানিয়ে দিন, তারা যেন আমাকে স্মরণ না করে । কেননা, যে অত্যচারী আমাকে স্মরণ করে, আমি অভিশাপের সঙ্গে তাকে স্মরণ করি। তিনি আরও বলতেন, আমি শুনেছি যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত অর্থ দ্বারা হজ্জ কর্ম সম্পন্ন করে ও লাব্বায়েক বলে। তখন তার উত্তরে বলা হয় না, তুমি হাজির হওনি। আর যে পর্যন্ত তুমি তােমার হাতের জিনিসের প্রতি দৃষ্টিপাত না করবে সে। পর্যন্ত তােমার মঙ্গল হয় না যেন।
(৩) নরম ব্যবহার করার অভ্যাস লােপ পায়। (৪) উপাসনাকে মনে হয় ভারী বস্তু। (৫) কুপ্রবৃক্তির তাড়না প্রবল হয়। (৬) ঘন ঘন মলত্যাগ করতে হয়, তাতে মসজিদের নিশ্চিন্ত নিয়ে উপাসনায় বিঘ্ন ঘটে। ক্ষুধা পরম উপকারী বস্তু। আল্লাহ তাঁর একান্ত প্রিয় দাস ছাড়া অন্য কাউকে ক্ষুধা সহ্য করার শক্তি দেন না। (১) ক্ষুধা পরকালের পরিতৃপ্তি সহকারে খাদ্য উপভোগের মূল চাবিকাঠি। (২) ক্ষুধা
মানুষের ঐহিক ও পারত্রিক প্রয়ােজন পূর্ণ করে। (৩) ক্ষুধার দ্বারা নফস দুর্বল ও আত্মা কোমল হয়। (৪) ক্ষুধার মাধ্যমে আশামানী জ্ঞান তথা গুপ্ত এ প্রকাশ্য জ্ঞানের দ্বার উস্মুত্ত হয়। হযরত আবু সুলায়মান দারায়ী (র) বলেন, সারাদিন ধরে ইবাদতের তুলনায় রাতে এক গ্রাস হালাল খাদ্য। গ্রহণ অনেক বেশি ভালাে। তিনি আরও বলেন, প্রবৃত্তিগত তাড়নার মােকাবিলায় তার শক্তিই প্রবল যার অন্তর আল্লাহর আলােয় আলােকিত।
ঐ আলাে মানুষকে দুনিয়ার দিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে আখেরাতের দিকে নিয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, যে লােক মাঝপথ দিয়ে প্রত্যাবর্তন করে সে কখনও আসল লক্ষ্যে পৌছাতে পারে না। তিনি বলেন, সারা জীবনে যে লােক সামান্য খুলুসিয়তও হাসিল করেছে, সে-ই সৌভাগ্যবান। তিনি আরও বলেন, মানুষ যখন ইসলাম অবলম্বন করে তখন সে নফসের তাড়নসমূহ ও ছলন-প্রবঞ্চনা থেকে মুক্তি লাভ করে।
তিনি বলেন, সত্যবাদী লােকের অন্তরে যা আছে, তা যদি প্রকাশ করতে চায় তাে যবান সাহায্য করে।
রেজা বা সন্তোষ সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য-কোন কোন লােক এমনও রয়েছে, যারা রেজা বা সন্তোষের ক্ষেত্রে ধৈর্যকেও লজ্জার কারণ বলে মনে করেন। বরং তারা রেজা বা স্বীকৃতির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে ব্যবহার করেন। অর্থাৎ বিপদে এ ভাব প্রকাশ করেন না যে, আমি ধৈর্য অবলম্বন করি। পক্ষান্তরে, রেজা বা আল্লাহর কাজের স্বীকৃতিতে আমার আমি ভার মােটেই নেই। তাঁর দ্বারা প্রভু যা করান তাতেই খুশি। মূলকথা, ধৈর্যের সম্বন্ধ বান্দার সাথে আর রেজার সম্বন্ধ আল্লাহর সঙ্গে।
আল্লাহর দরবারে জান্নাতের আকাঙ্ক্ষা ও জাহান্নামের মুক্তি কামনা না করে তাঁর খুশিতে নিজেকে বিলিয়ে দেয়াই প্রকৃতি রেজা। ধৈর্য অবলম্বনকারী বিপদ-আপদ সহ্য করে নেয় দায়ে পড়ে। মনে তার আনন্দের কোন অস্তিত্ব থাকে না। পক্ষান্তরে যার মধ্যে রেজা থাকে, সে যেন অবস্থাকে স্বীকার করে নেয়।
বিনয় বা নম্রতা সম্বন্ধে তিনি বলেন, নিজের কোন ব্যাপারে গর্ব বা অহমিকা প্রকাশ না করাকেই বলে সম্রতা। মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত তার নফসকে না চিনে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার মধ্যে তা আসে না। যােহদ বা ত্যাগ সম্বন্ধে তিনি বলেন, যেসব বস্তু মানুষকে আল্লাহ থেকে দুরে নিয়ে যায়, সেসব বস্তুকে যে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, তাকে যােহদ বা ত্যাগ বলে। ত্যাগের নিদর্শন হলাে নিকৃষ্ট বস্তুর মােকাবিলা করতে গিয়ে উৎকৃষ্ট বস্তুর প্রতি প্রলুব্ধ না হওয়া।
* শুধু মুখে ত্যাগ স্বীকার করাও সােনা-রুপার চেয়েও দামী।
* পার্থিব মােহই যে-কোন পাপের উৎস।
* যে কোন বিপদ-বিপর্যয়কে আল্লাহর ইচ্ছা মনে করে আল্লাহ ছাড়া সব কিছুতেই পরিত্যাগ করার নামই তাসাউফ।
* ক্ষুধা, উপবাস উপাসনার জন্য জরুরী।
* পার্থিব বিষয়াদি নিয়ে অধিক চিন্তা-ভাবনা করা পারলৌকিক বিষয়ের ওপরে পর্দা স্বরূপ।
* ধৈর্যে জ্ঞান ও চিন্তা বাড়ে আর ধ্যানে বাড়ে 'আল্লাহর ভয়।
* চোখে কান্নার এবং মনে চিন্তার অভ্যাস কর।
* আল্লাহকে চিনতে হলে মন থেকে অন্য সব চিন্তা দূর করে ফেলতে হবে।
* যে উপদেশ-দাতা খোঁজে সে যেন দিবারাত্রির পরিবর্তনের প্রতি লক্ষ্য করে।
* বান্দা যতক্ষণ ইবাদতে লিপ্ত থাকে, ফেরেশতাগণও ততক্ষণ জান্নাতের বাগিচায় তাদের প্রতিটি ইবাদতের বিনিময়ে এক একটি বৃক্ষরোপণ করেন। যখন সে উপাসনা থেকে বিরত হয়, তখন ফেরেশতাগণও অবসর গ্রহণ করেন।
* যে উপাসনা দ্বারা পৃথিবীতে স্বাদ পাওয়া যায়না, সে উপাসনা দ্বারা পরকালেও প্রতিদান মিলবে না। তৃপ্তিই হল উপাসনার স্বীকৃতি ও লক্ষণ।
* যাহেদ বা ত্যাগীদের শেষ সােপান মুতাওয়াকেলীনদের প্রথম সােপান।
* আল্লাহ আরিফ বা জ্ঞানী ব্যক্তিদের স্বপ্নের মাধ্যমে এমন দরজা দান করেন, মূর্খদের নামাযের মধ্যেও তা লাভ হয় না। আরিফগণের বাতেনী চোখ যখন খুলে যায়, তখন জাহেরী চোখ বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ জাহেরী চোখ দ্বারাও তখন তারা শুধু আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছু দেখতে পায় না।
* আল্লাহর নৈকট্য লাভ তখনই হয়, যখন দ্বীন-দুনিয়াকে আল্লাহর হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। মারেফাত চুপ থাকার নিকটবর্তী।
* যার আন্তর আল্লাহর আলােয় আলােকিত, তার অন্য কিছুর প্রয়ােজন নেই। যে উপাসনায় কষ্ট সহ্য করে। তার মুক্তির জন্য উসিলা হয়ে যায়।
(১) ধৈর্যের মত উত্তম বস্তু আর নেই। তবে ধৈর্য দু রকমের। (১) যে কাজের প্রতি আসক্তি নেই, তাতে ধৈর্য ধারণ করা (২) কাজের জন্য প্রবল উম্মুখতা অথচ আল্লাহর বিধানে নিষিদ্ধ, এরূপ ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করা।
* যে ব্যক্তি আত্মিক শ্রম দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে সে নিঃসন্দেহে জান্নাতের যোগ্য হয়ে যায়।
* তােমার প্রিয় বন্ধুও যদি ক্রোধ বা বিরক্তি বশত তােমার মতের বিপরীত কোন কথা বলে,তবে তাকে কোন ভালাে-মন্দ কথা বলবে না। কেননা, হতে পারে সে তখন তােমার প্রতি অধিকতর কঠিন বাক্য প্রয়োগ করে বসবে।
হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (র) বলেন, আবু সুলায়মান দারায়ী (রাঃ) অত্যন্ত পরহেজগার ও সর্তক ব্যক্তি ছিলেন। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেন, আমি সুফী-দরবেশদের কাছে সে সব কথা শুনতাম, তার অনুকূলে কুরআন হাদীস থেকে সাক্ষ্য পাওয়া না গেলে আমি আমল থেকে বিরত থাকতাম।
তিনি সাহাবী হযরত মাআয ইবনে জাবাল (র) থেকেও কিছু কিছু জ্ঞান ও বিদ্যা অর্জন করেন তনি মুনাজাতের সময় বলতেন, হে দয়াময়! যে আপনার বিধি নিষেধ অমান্য করে, সে আপনার খেদমতের উপযুক্ত হতে পারে না।
অন্তিম মুহুর্তে তিনি তাঁর শিষ্যদের বলেন, আমি এমন এক প্রভুর কাছে চলেছি, যিনি ছােট ছােট পাপের হিসেব রাখেন ও বড় বড় পাপের শাস্তি বিধান করেন। এটিই তাঁর শেষ কথা। তার মৃত্যুর পর কেউ স্বপ্নযােগে তাঁর কাছে থেকে জানতে পারেন যে, তিনি আল্লাহর দয়া ও রহমত লাভ করেছেন। কিন্তু তাঁর খ্যাতিও সুনাম কিছুটা ক্ষতির কারণ হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ
* বলখের বাদশাহ হযরত ইব্রাহীম ইবনে আদহাম (রাঃ) জীবনী
* হযরত ফোজায়েল ইবনে আয়াজ (রাঃ) জীবনী
0 মন্তব্যসমূহ