নতুন পোস্ট

6/recent/ticker-posts

বিখ্যাত মনীষী হযরত দাউদ তায়ী (রাঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী বাংলা

হযরত দাউদ তায়ী (রাঃ)

বিখ্যাত মনীষী হযরত দাউদ তায়ী (রাঃ) জীবনী

বিখ্যাত মনীষী হযরত দাউদ তায়ী (রাঃ)এক জন শ্রেষ্ট সাধক ছিলেন তা এখান থেকে জানা যায়। কে যেন কাঁদছে। আর কাঁদতে কাঁদতে বলছে, তােমার কি এমন কোন মুখ ছিল যে তার ওপর মুক্তিকা মিশ্রিত হয়নি। এবং তােমার কি এমন চক্ষু ছিল যা জমিনে নিক্ষিপ্ত হয়নি। 

বিচিত্র কান্না। আরও বিচিত্র কথাগুলি। কথাগুলির মর্ম অনুধাবন করতে পারলেন না এক ব্যক্তি। চলে এলেন হযরত আবু হানিফা (র)-এর দরবারে। আবু হানিফা (র) দেখেলেন, মর্মপীড়ার ছাপ

 রয়েছে তার সারা মুখজুড়ে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে তােমার? তুমি এত বিমষ কেন? তিনি জানালেন, দুনিয়া সম্পর্কে তাঁর আর কোন উৎসাহ নেই। আর মনের মধ্যে যে চলছে, তা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কোনও বইয়ে তিনি তার অর্থ খুঁজে পাননি। কোন সমাধানই তার মনঃপূত হয়নি। ইমাম আবু হানিফা (র) তাঁকে পরামর্শ দিলেন, তিনি যেন মানুষের সংসর্গ থেকে দূরে থাকেন। বাড়ির মধ্যে নিরিবিলিতে একাগ্র সাধনায় মগ্ন হন।

ইমাম আজম আবু হানিফা (র)-এর নির্দেশে তিনি তাই করলেন। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে তিনি বাড়ির নির্জন পরিবেশে নিরিবিলি উপাসনায় নিমগ্ন থাকলেন। আর এভাবে কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন হযরত ইমাম আবু হানিফা (র) তাঁর নিকট হাজির হয়ে বললেন, আর এভাবে থাকার দরকার নেই। তুমি এখন অভিজ্ঞ শিক্ষকগণের কাছে গিয়ে মারেফাত বিদ্যা গ্রহণ কর।

তদনুযায়ী তিনি প্রায় এক বছর ধরে ইমাম মুরশিদগণের দরবারে যাওয়া-আসা করতেন। অবশ্য তিনি নিজে কিছুই বলতেন না। তারা যা বলতেন চুপচাপ বসে তা শুনে যেতেন। এভাবে এক বছর পূর্ণ হলে তার মনে হলাে যেন ত্রিশ বছরের সাধনা সফল হয়েছে। 

তারপর তিনি যান হযরত হাবীব রায়ী (র)-এর কাছে। তার সাহচর্যে থেকে তিনি এমন এক অবস্থায় উপনীত হন যে, বাইরের বইপত্র তার কাছে গৌণ মনে হয়। সব বই পানিতে নিক্ষেপ করে তিনি আবার নির্জন সাধনায় নিমগ্ন হন। আর আল্লাহর রহমতে সিদ্ধিলাভ করেন।

আত্মসমর্পিত এই নীরব সাধকের নাম হযরত দাউদ তায়ী (র)। সাধনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন নেতৃস্থানীয়। বিশেষত ফেকাহ শাত্রে তাঁর স্থান ছিল শীর্ষে। ইমাম আজম আবু হানিফ (র)-এর তিনি এক সুযােগ্য শিষ্য। দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে তিনি তার কাছ থেকে তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেন। হযরত ফোজায়েল আয়াজ ও হযরত ইব্রাহিম আদহাম (র)-এর সঙ্গে ও তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। আর আগেই বলা হয়েছে, হযরত হাবীব রায়ী (র) ছিলেন তাঁর মারেফাতের মুরশিদ।

পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি বিশ দিরহাম পান। আর বিশ বছর ধরে তিনি তা নিজের কাজে জমা রাখেন। তিনি বলতেন, এগুলাে রেখেছি আমার উপাসনার একাগ্রতা অক্ষুন্ন রাখতে। একটি মুহুর্ত তিনি নষ্ট করতেন না। এমনকি খেতে বসে রুটি ইত্যাদি না চিবিয়ে পানিতে ভিজিয়ে শরবতের মতাে পান করতেন। বলতেন, রুটি চিবিয়ে খেতে যে সময় ব্যয় হয়, তাতে পবিত্র কুরআনের অন্তত পঞ্চাশটি আয়াত পাঠ করা যায়।

একদিন আবুবকর আইয়াশ তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখেন, এককানি রুটি হাতে নিয়ে তিনি চুপচাপ কাঁদছেন। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, রুটি হালাল না হারাম তা জানা নেই। তাই ইতস্তত করছি। একদিন অন্য একজন দেখেন, একটা পানির পাত্র রােদে রেখে দিয়েছেন। 

তিনি বললেন, পানি রােদে রেখেছেন কেন? গরম হয়ে যাবে যে! হযরত দাউদ তায়ী (র) বললেন, যখন পানি রাখি তখন ওখানে ছায়া ছিল। পরে রােদে এসেছে। কিন্তু এখন পাত্রটি তুলে নিয়ে ছায়ায় রাখতে আমার লজ্জা হয়। কেননা আল্লাহ মনে করতে পারেন, তার ধ্যান বন্ধ রেখে আরামের তাগিদে আমি সেটি অন্যত্র সরিয়ে রেখেছি।

হযরত দাউদ তায়ী (র)-এর পৈতৃক বাড়িটি ছিল পুরাতন, কিন্তু বৃহৎ। বাড়ির এক অংশ ভেঙে পড়ায় তিনি অন্য অংশে বাস করতে থাকেন। কিছুদিন পর সে অংশটি ও ধ্বসে যায়। আর তিনি আশ্রয় নেন বাড়ি দরজায়। কেউ তাকে জিজ্ঞেস করেন, বাড়িটা মেরামত করছেন না কেন? তিনি জবাব দেন, আমি আল্লাহর কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, পার্থিব জগতে আমি কোন বাড়ি নির্মাণ করব না।

 আরও একজন বাড়ির দুরবস্থা বিষয়ে তার দৃষ্টি আকষর্ণ করলে তিনি বলেন, বিশ বছর ধরে এ বাড়ির দিকে আমার নজর নেই। আমার খেয়াল ও দৃষ্টি অন্যদিকে। একবার কয়েকজন লােক তাকে বলে, আপনি এভাবে মানুষের সংশ্রব সংসর্গ ছেড়ে দিয়েছেন কেন? তিনি বলেন, কার সংশ্রবে যাব বল? 

যদি আমি আমার চেয়ে কমবয়সী লােকের কাছে যাই, বায়ােজ্যেষ্ঠ বলে তারা আমাকে ধর্মোপদেশ দেবে না। আর যদি বড়দের কাছে যাই, তাহলে তারা দোষত্রুটি শুধরে না দিয়ে আমার সঙ্গে স্নেহপূর্ণ ব্যবহার করবে, আমাকে নির্দোষ-নিখুঁত মনে করবে। অতএব লােকের সংশ্রবে আমার কী লাভ! তাকে আবারও জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি এখনও শাদী করছেন না কেন?

তিনি বলেন, আমি একটি মহিলার সঙ্গে প্রতারণা করতে পারব না। কী রকম? শাদীর পরে তার খােরপাশের দায়ীত্ব নিতে হবে। সেটা আমার দ্বারা হবে না। আপনি মুখের দাড়িতে চিরুনি ব্যবহার করেন না কেন? তাঁর উত্তর: আমার সময় কই?

জ্যোৎস্নার আলোেভরা এক রাত। বাড়ির ছাদে উঠে তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। আর আকাশের অসংখ্য গ্রহ-তারা বিষয়ে চিন্তা করছেন। হঠাৎ দেখা গেল, তিনি কাদছেন। আর কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। পতনের শব্দে আশেপাশের লােকেরা ভাবল, হয়তাে ছাদে চোর উঠেছে। তড়িঘড়ি ছাদের ওপরে উঠে এসে তারা দেখে, হযরত দাউদ তায়ী (র) পড়ে রয়েছেন। তারা বলে, আপনাকে এভাবে কে ফেলে দিল? তিনি বললেন, তাতাে বলতে পারিনে। কেননা, আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম।

শােনা যায়, তিনি অনবচ্ছিন্নভাবে রােযা রাখতেন। এক গ্রীষ্মের দুপুরে রোদে বসে তিনি উপাসনা করছেন। মা তাকে ছায়ায় বসতে বললেন। কিন্তু তিনি বললেন, আমার আরামের উদ্দেশে স্থান পরিবর্তন করতে তার লজ্জা হয়। বাগদাদ শহরের লােক তাকে বড্ড জ্বালাতে শুরু করে। অতিষ্ঠ হয়ে তিনি আল্লাহর দরবারে বলেন, দয়াময়, আপনি আমার পরনের কাপড় খানি নিয়ে নিন। 

তাহলে আমি আর জামায়াতে অংশ নিতে পারব না। মানুষের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ ও হবে না। আল্লাহ তার প্রার্থনা পূরণ করেন। একদিন সত্যিই তার পরনের কাপড় হারিয়ে যায়। তখন গভীর নির্জনে ইবাদত-উপাসনা করার অঠেল সুযােগ এসে যায়।

হযরত দাউদ তায়ী (র) ছিলেন চিন্তাশীল, বিষন্ন মানুষ কোন সময়ে তাঁকে প্রসন্ন দেখাত না। তিনি বলতেন, প্রতি মুহুর্তে মনে যার আল্লাহর ভয়, সে প্রসন্ন থাকবে কি করে? কিন্তু একবার এক দরবেশ তাকে প্রযুদ্ল দেখে তার কারণ জিজ্ঞেস করেন। তিনি চমৎকার জবাব দেন। বলেন, আল্লাহর প্রেমের শরাব পান করে নেশাচ্ছন্ন হয়ে তিনি আনন্দ অনুভব করছেন।

ঘটনাচক্রে তিনি যদি লােকজনের ভিড়ের মধ্যে পড়ে যেতেন, তাহলে 'ঐ সৈন্য আসছে, বলতে বলতে দৌড়ে পালাতেন। তারা জিজ্ঞেস করত, কার সৈন্য আসছে? তিনি বলতেন, কবরস্থানের

মৃতদেহ সৈন্য। তিনি প্রচুর অমূল্য উপদেশ দিয়ে গেছেন। যেমন, 

(১)-দুনিয়া থেকে রােযা রাখ। আর পরকালে গিয়ে ইফতার করা। 

(২) কুবচন থেকে বিরত থাক। 

(৩) সৃষ্টি থেকে দূরে থাক। 

(৪) দ্বীনকে দুনিয়ার ওপর গুরুত্ব দাও। আর সম্ভব হলে দুনিয়াকে ভুলে যাও। 

(৫) মৃত্যুকে ঈদের উৎসব মনে কর। আর বাঘ দেখে মানুষ যেমন পালিয়ে যায়, তেমনি দুনিয়াদার লােকদের থেকে পালিয়ে যাও। 

(৬) দুনিয়াকে ভালােবাসে, তেমনি ধর্মকর্মের জন্য তুমি ও দুনিয়াকে পছন্দ কর।

(৭) মৃতব্যক্তিগণ তােমার জন্য কবরে অপেক্ষা করছে। 

(৮) যে ব্যক্তি অপরকে তওবা করায় ও সৎ কাজের নির্দেশ দেয়, অথচ নিজে তা পালন করে না, তাঁর উপমা সে শিকারীর মতাে যে নিজে শিকার করে অথচ অন্য লােকে কাবাব খায়। 

(৯) তুমি যদি শান্তিকামী হও, তাহলে দুনিয়ার কাছ থেকে বিদায় নাও। আর যদি পরকালের সম্মান চাও, তবে ইহকালের অহমিকা ত্যাগ কর ।

একবার খলিফা এসেছেন হযরত দাউদ তায়ী (র)-এর সঙ্গে দেখা করতে। সঙ্গে রয়েছেন সে আবু ইউসুফ (র)। কিন্তু তিনি তাদের ভেতরে আসার অনুমতি দিলেন না। অগত্যা খলিফা ধরলেন তাঁর জননীকে। তিনি যেন এ ব্যাপারে একটু সুপারিশ করেন। কিন্তু মায়ের সুপারিশও তিনি আগ্রহ করলেন। সাফ বলে দিলেন, অত্যাচারীর নিকট তাঁর কোন প্রয়ােজন নেই। 

তার মা তখন উপায়ান্তর না দেখে আল্লাহর কাছে মােনাজাত করলেন, মায়ের নির্দেশ পালন করা আপনার বিধান। খলিফার কাছে আমার কোন পার্থিব প্রয়োজন নেই। শুধু তাকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়াই আমার ইচ্ছা। হযরত দাউদ তায়ী (র) মায়ের এ মুনাজাত শুনে বাধ্য হয়ে খলিফাকে ভেতরে আসার অনুমতি দিলেন।

খলিফা ভেতরে এসে তার সামনে বসলেন। কিন্তু কোন কথাবার্তা নেই। একটি শব্দহীন সময় পার হয়ে গেল। অবশেষে বিদায় নেবার জন্য খলিফা উঠে দাঁড়ালেন। আর একটি স্বর্ণমুদ্রা তাঁর সামনে রেখে বললেন, এটি গ্রহণ করুন। আমার হালাল উপার্জন। এতে কোনরকম দোষত্রুটি নেই। হযরত দাউদ তায়ী (র) বললেন, এটি আপনি তুলে নিন। আমার অর্থের প্রয়ােজন নেই। 

আমার বাড়িখানা বৈধ মালপত্রের বিনিময়ে বিক্রি করেছি। তাতেই আমার চলছে। আল্লাহকে বলেছি, যেদিন মালপত্র শেষ হয়ে যাবে, তিনি যেন সেদিন আমাকে তাঁর কাছে ডেকে নেন। পৃথিবীর কারাে কাছে আমি হাত পাততে চাই না। আশা করি আল্লাহ আমাকে প্রার্থনা পূরণ করবেন। খলিফা বাধা হয়ে মুদ্রাটি তুলে নিয়ে চলে গেলেন।

ইমাম আবু ইউসুফ (র) হযরত দাউদ তায়ী (র)-এর এক অনুচরকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, সংসার খরচের জন্য কী পরিমাণ টাকা তার আছে। তিনি বললেন, দশ দিরহাম রুপাের টাকা এখনও হাতে আছে। আর দৈনিক এক দিরহাম খরচ হয়। এরপর একদিন ইমাম আবু ইউসুফ (র) মেহরাবে পিঠে লাগিয়ে মসজিদে বসে আছেন। 

হঠাৎ বলে উঠলেন, আজ দাউদ তায়ী (র) ধরাধাম ত্যাগ করেছেন। পরে জানা গেল, তার অনুমান সত্য। তাকে জিজ্ঞেস করা হলাে, এখানে বসে তিনি কী করে এ খবর পেলেন। ইমাম ইউসুফ (র) বললেন, হিসেব করে দেখলাম, তার দৈনিক খরচের টাকা ফুরিয়েছে। আর আমি ভালাে করেই জানি, হযরত তায়ী (র)-এর প্রার্থনা কখনও বৃথা যায় না।

হযরত দাউদ তায়ী (র)-এর ইন্তেকালঃ

ইমাম ইউসুফ (র) দাউদ-জননীকে জিজ্ঞেস করে তার ওফাতের বিবরণ শুনলেন। হযরত দাউদ তায়ী (র) সারা রাত ধরে নামায পড়েছেন। শেষ রাতে সে যে সেজদায় গেলেন, আর উঠলেন না। অনেকক্ষণ পর, ফজরের সময় হলে তার মা তাঁকে নামাযের সময় হয়েছে বলে জাগাতে গেলেন। কিন্তু ডাকাডাকির পরও তাঁর মাথা যখন মাটি থেকে উঠল না। তখন তিনি তাঁর কাছে গিয়ে দেখলেন, তিনি আর নেই। সবাইকে ছেড়ে নিঃশব্দে তাঁর প্রভুর কাছে ফিরে গেছেন।

আরও পড়ুন

* হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রাঃ) জীবনী

* হযরত আবু সুলায়মান দারায়ী (রাঃ) জীবনী

* হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রাঃ) জীবনী

* বলখের বাদশাহ হযরত ইব্রাহীম ইবনে আদহাম (রাঃ) জীবনী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ